চুইং গাম। নাম শুনেই জিভটা নিশপিশ করে ওঠে বন্ধুদের। মিষ্টি। বাহারি রঙ ও স্বাদে ভরপুর। হাতের কাছে পেলেই লুফে নিতে ইচ্ছে করে। গাপুস গুপুস চিবোতে পারলেই মজা লাগে। দোকানে গেলে পছন্দের তালিকায় প্রথম থাকে চুইং গাম। তাইতো বায়না ধরি আমরা বাবা-মা’র কাছে। অনেক সময় ধরে চিবানো আর বাবল ফোলানেতে এর কোনো জুড়ি নেই। তাই বলে শুধু ছোট্ট বন্ধুরা চিবোয় তা নয়। তরুণ ও মধ্যবয়স্করাও বারংবার চুইং গাম চিবোয়। কেউ আনন্দে চিবোয়। কেউ সময় কাটাতে। কেউ দীর্ঘ সময় গলা ভিজিয়ে রাখতে। আবার এমনও মজার কা- ঘটেছে যে, ইউরোপের দেশে সেলিব্রেটি ব্যক্তিদের মুখের ফেলে দেয়া চুইং গাম কুড়ানো হতো। এরপর তা বিশাল টাকার অংকে নিলামে তোলা হতো বিক্রির জন্য। আজ শোনাবো সেই চুইং গামেরই এক মজার ইতিহাস।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, উত্তর ইউরোপের লোকেরা একধরনের গাছের ছাল চিবোতেন। সময়টা এখন থেকে নয় হাজার বছর আগের। কেন তারা অই গাছের চিবোতেন? গবেষকরা এর দুটি কারণ রয়েছে বলে মনে করেন। প্রথমত এটি চিবানোর ফলে তারা স্বাদ পেতেন। দ্বিতীয়ত: দাঁতের ব্যথা সারাতে তারা এমনটি করতেন। এদিকে রয়েছে আমেরিকা মহাদেশের প্রাচীন মায়া সভ্যতা। তাদের মাঝেও চুইং গাম চিবানোর আলামত পাওয়া যায়। মায়া সভ্যতার লোকেরা ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা মেটাতেই গাছের চাল চিবোতেন। তাদের অই গাছের নাম স্যাপোডিল্লা। এই গাছ থেকে উৎপন্ন হয়ে জমে যাওয়া রস চিবাতো তারা। অবাক ব্যাপার একইভাবে মেক্সিকোর বিখ্যাত আজটেক সভ্যতাও চিবিয়ে খেতো স্যাপোডিল্লা গাছের জমে যাওয়া রস।

চুইং গাম চিবানোর আবার নিয়ম কী! আগেই তো বলেছি গাপুস গুপুস চিবোতে পারলেই মজা লাগে। চিবানোর কোনো বিশেষ নিয়ম না পাওয়া যায় না। তবে আজটেক সভ্যতায় চুইং গাম চিবানোর একটি নিয়ম ছিল। নিয়মটি এরকম ছিল যে, শিশু ও অবিবাহিত নারীরা সবার সামনেই চিবোতে পারতেন। বিবাহিত নারী ও বিধবাদের ক্ষেত্রে নিয়ম ছিল ব্যক্তিগত পরিসরে উপভোগ করার। এরা নিজেদের মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে এমনটা করতেন। আর পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের একেবারে আড়ালে চিবোনোর নিয়মটি ছিল খুব কঠিন। এ জাতীয় পুরুষদের উদ্দেশ্য ছিল দাঁত পরিষ্কার করা।

পাইন গাছের সদৃশ ‘স্পরুস ট্রি’র গাছের রস চিবানোর চল ছিল উত্তর আমেরিকায়। পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয়রা সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে। এবং তারাও চিবানোর সংস্কৃতি চালু রাখে। ১৮৪০ সালে উত্তর আমেরিকায় জন কার্টিস নামের এক ব্যক্তি প্রথমবারের মতো চুইং গাম নিয়ে ব্যবসার চিন্তা-ভাবনা করেন। তিনি স্পরুস গাছের রস সংগ্রহ করে সেটি গরম পানিতে সিদ্ধ করতেন। এরপর সেই রস জমিয়ে সুবিধা মতো পিচ করে নিতেন। কেটে কেটে ছোট ছোট টুকরো করতেন। পরে সেগুলোতে ভুট্টার ময়দা মাখিয়ে দিতেন। যাতে একসাথে অনেকগুলো রাখলে একটির সাথে আরেকটি লেগে না যায়। এভাবে হাতে তৈরিকৃত চুইং গাম শিল্পের শুরু হয়। তবে স্বাদ খুব একটা আকর্ষণীয় ছিল না। যার কারণে তিনি ও তার পরের উৎপাদকরা প্যারাফিন তেলসহ বিভিন্ন উপাদান যোগ করার সিদ্ধান্ত নেন।

তখনকার মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট এ্যান্টনিও লোপেজ ডি সান্তা আন্না ছিলেন নির্বাসিত। নিউ ইয়র্কের থমাস অ্যাডামস নামের একজন ব্যক্তির সাথে তার দেখা হয়। প্রেসিডেন্টের কাছে থাকা স্যাপোডিল্লা গাছের নির্যাস থেকে উৎপাদিত চুইং গাম ‘চিকল’ থমাস অ্যাডামসের নজরে আসে। তারা দুজনে মিলে ‘চিকল’ নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা করেন। নির্বাসিত প্রেসিডেন্ট লোপেজের ভাবনা ছিল রাবারের বিকল্প হিসেবে আমেরিকায় তারা চিকলের প্রসার ঘটাবেন। কিন্তু তাদের পরীক্ষাগুলোতে আশানুরুপ ফল না আসায় হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু থমাস অ্যাডামস বুঝতে পারেন, চিকল যদি উন্নতমানের চুইং গাম তৈরিতে ব্যবহার করা যায়, তাহলে ভালো সম্ভাবনা আছে। সেই চিন্তা থেকে ১৮৮০ সালের দিকে থমাস একটি কোম্পানি খুলে বসেন। তার কোম্পানি চিকল থেকে তৈরিকৃত চুইং গাম পুরো আমেরিকায় সরবরাহ করতো।

বিশ শতকে এসে চুইং গামের বাজার বড় হতে থাকে। উইলিয়াম রিংলে জুনিয়র নামের একজন ব্যক্তি আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় সাবান বিক্রি করতেন। তিনি তার সাবান বিক্রিতে এক কৌশল করেন। বিক্রি বাড়াতে তিনি ক্রেতাদের বিভিন্ন বাড়তি সুবিধা দিতেন। ক্রেতারা যদি কোনো পাইকারি হারে নির্দিষ্ট পরিমাণ সাবান কিনে নিতো, তবে তিনি বেশ কিছু বেকিং পাউডারের ক্যান ফ্রি দিতেন। এই কৌশল অবলম্বনের পরবর্তীতে দেখা গেল বাজারে সাবানের চেয়ে বেকিং পাউডারই বেশি বিক্রি হচ্ছে। এরপর তিনি সাবান বাদ দিয়ে বেকিং পাউডারের বিক্রি শুরু করেন এবং এবারও বাড়তি সুবিধা হিসেবে ক্রেতাদের কিছু চুইং গামের প্যাকেট ফ্রি দিতেন। এ কপর্যায়ে বাজারে কিন্তু চুইং গামের বিশাল চাহিদা তৈরি হয়ে যায়। ১৮৯৩ সালের দিকে তিনি চুইং গাম তৈরির দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন (জ্যুসি ফ্রুট এবং রিংলে’জ স্পিয়ারমিন্ট)। চুইং গামের বিজ্ঞাপনের পেছনে তিনি বিপুল অর্থ ব্যয় করেছিলেন। এটি পরে তাকে আমেরিকার অন্যতম সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করে।
১৮৮৫ সাল থেকে ফ্র্যাঙ্ক ফ্লিয়ার নামের একজন ব্যক্তি তার নিজস্ব কোম্পানি থেকে চুইং গাম উৎপাদন করে আসছিল। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোর চেয়ে ভিন্ন ঘরানার কিছু বিক্রির চিন্তা করেন। সেই মোতাবেক ১৯০৬ সালে তিনি বাবল গাম বাজারে আনেন, যার নাম দিয়েছিলেন ‘ব্লিবার-ব্লাবার’। কিন্তু এটি সেভাবে বাজারে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি।

কিন্তু ১৯২৮ সালে ফ্র্যাঙ্ক ফ্লিয়ারের প্রতিষ্ঠানের ওয়াল্টার ডাইমার নামে এক কর্মীর তৈরিকৃত বাবল গাম আরও বেশি উন্নত হয়। ডাইমার তার উৎপাদিত বাবল গামের নাম দেন ‘ডাবল বাবল’। এই বাবল গাম বাজারে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন স্বাদ ও বর্ণের চুইং গাম তৈরি করে চলেছে।

Share.

মন্তব্য করুন