ভোর পাঁচটা। কোটচাঁদপুর স্টেশনে মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে। কারও হাতে ব্যাগ-সুটকেস, কারও মাথায় বস্তা, কেউ আবার স্কুলের ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়ে দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে। কুলিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। কে আগে যাত্রীদের বোঝা বহন করবে। বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে স্টেশনের এ মাথা থেকে ও মাথা। হঠাৎ তিন বছরের এক বাচ্চা তার সঙ্গীদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সিমেন্টের শক্ত শানের উপর। তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে উঠে বাচ্চাটা। মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে কোলে তুলে নেয় ছেলেকে। বাম পায়ে ও কপালে থেঁতলে গেছে একটু। কেউ বা পানি, কেউ বা ব্যথা উপশমের মলম লাগাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। আধঘুমে থেকে এ-সবই প্রত্যক্ষ করছিলো পাশের পিলারের কোণে শুয়ে থাকা অনিকেত।
অনিকেতের বয়সের হিসেবটা আনুমানিক চার পাঁচের মধ্যেই হবে। সে নিজেও জানে না তার জন্মতারিখ বা সালটা। কী করে এ স্টেশনে আসলো, কে-ই বা আনলো তাকে, তার কিছুই জানে না সে। আর জানলেও ক্ষুদ্র স্মৃতিতে ধরে রাখার সাধ্য নেই তার। বোধশক্তি হওয়ার পর থেকে সে জানে এ স্টেশনই তার বাড়ি-ঘর, পিতা-মাতা, পরিবার। কে তার বাবা-মা, পরিবার পরিজন এসবের কিছুই জানে না সে। অথবা জানার প্রয়োজনও হয়নি। তার দিন কাটে যাত্রীদের বোঝা বহন করে, কাগজ- বোতল কুড়িয়ে, স্টেশনে থাকা যাত্রীদের থেকে টাকা বা এটা-ওটা চেয়ে। কেউ বা ধাক্কায় দূরে তাড়িয়ে দেয়। কারও বা সদয় দৃষ্টি পড়লে দু’ চারটা পয়সা হাতে দিয়ে সহানুভূতির দৃষ্টি ফেলে। এভাবেই অর্ধপেটে, অনাহারে দিনাতিপাত করতে হয় তাকে।

আপন বাবা মা, পরিবার পরিজন না থাকলেও সঙ্গীর অভাব হয় না অনিকেতের। তার বয়সী অনেক ছেলেমেয়েই এ স্টেশনের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যারা আশ্রয়, পিতা-মাতাহীন। আর করিম চাচা তো আছেন-ই। যিনি নিজ সন্তান থেকে বিতাড়িত হয়ে এ স্টেশনে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে। করিম চাচা যেদিন দু’ চার পয়সা বেশি ভিক্ষা করতে পারে, সেদিন তাঁর থেকে অনিকেতই বেশি খুশি হয়। কারণ অনিকেতের পেটে সেদিন লুচি, ডালের বড়া জোটে। করিম চাচা সন্তানস্নেহেই দেখে অনিকেতকে। তবে সে সুখও অনিকেতের কপালে বেশি দিন স্থায়ী হলো না। পৌষের শীতের প্রথম ধাক্কাতেই অশীতিপর করিম চাচা চোখ বুঝলেন। সাথে সাথে শেষ হয়ে গেল অনিকেতের পিতৃস্নেহের অধিকার, ভালোবাসা। চারিদিকের এতো এতো আয়োজন, হট্টগোল থাকতেও নিজেকে একা, নিস্তব্ধ, গতিহীন লাগতো তার। অনিকেত বাবা মায়ের স্নেহ ভালোবাসা পায়নি, করিম চাচাই বাবা মায়ের শূন্যস্থান পূরণ করে। তাঁর অনুপস্থিতি অনিকেতকে সম্পূর্ণ একা করে দিলো।
চরম বাস্তবতা ঘিরে ধরলো তাকে। এখন লুচি, ডালের বড়া তো দূরের কথা, একবেলা খাবার জোগাড় করতেই তার জীবনীশক্তি ফুরিয়ে যায়। স্টেশনের খাবারের দোকান, যাত্রীদের ফেলে দেওয়া খাবারের দিকে ক্ষুধাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখের ক্ষুধা মিটলেও পেটের ক্ষুধা মিটে কার সাধ্য! ফেলে দেওয়া খাদ্যই এখন একমাত্র উপাদেয় অনিকেতের। তবুও তা সবসময় পাওয়া যায় না। এ তো খাবারের জোগাড় হয় কোনরকমে। কিন্তু থাকার জায়গা! বোধশক্তি হওয়ার পর থেকে এ স্টেশনেই তার বসবাস, তার বাড়িঘর। আর দশটা ছেলের মতো তার নেই কোনো নিজস্ব বাড়ি-ঘর। বাবা হয়তো মিলিয়েই ছেলের নামটা রেখেছিল অনিকেত। এ নামের সাথে ভাগ্যটাও হয়ে গেল আশ্রয়হীন, গৃহহীন।
এমন হাজারও অনিকেত আজ তার স্টেশনের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশের অন্যান্য স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, ফুটপাথ, বস্তিতে। যারা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ভিক্ষা থেকে শুরু করে খুনের সাথেও জড়িয়ে আছে। এমন হাজারো অনিকেতেরও তো ইচ্ছে করে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে, একটু শান্তির পরশ পেতে। যেখানে গভীর ঘুুমে আচ্ছন্ন অনিকেতকে কেউ বলবে না, এই ব্যাটা উঠ্, এখানে ঘুমাস কোন সাহসে!!

Share.

মন্তব্য করুন