আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলায় ফাতেমার একটা উদ্ভাবনী প্রযুক্তি শিক্ষকমণ্ডলীসহ দর্শনার্থীদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ফাতেমা যন্ত্রটার নাম দিয়েছে মি. শব্দখেকো! এর বিশেষত্ব হলো এটি আশপাশের ২০০ বর্গফুটের মধ্যে যেকোনো শব্দকে নিমেষেই গায়েব করে দিতে পারে। শব্দ হজম করা এই যন্ত্রটিকে ফাতেমা তৈরি করেছে কয়েকটি ট্রানজিস্টার, চৌম্বকদণ্ড, ব্যাটারিসহ আরো কিছু পুরনো ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে।
এর নেপথ্যে অবশ্য অন্য একটা কারণ আছে। ফাতেমাদের বাড়ির পাশে দীর্ঘদিন ধরে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছিল। ইটভাঙা মেশিনের একটানা অসহ্য শব্দে কান মাথা ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়! ওদিকে আবার সামনে তার বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষায় খারাপ করলে সুমন স্যার তাকে আস্ত রাখবেন না। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে সে পড়াশোনায় কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিল না। প্রথমে যন্ত্রটা এত ভালো কাজ না করলেও শব্দ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। পরীক্ষামূলকভাবে আরেকটি যন্ত্র অনামিকাকে দিয়েছে ফাতেমা। অনামিকা প্রায়ই ঠিকমত স্কুলের পড়া তৈরি করে আসতে পারতো না। জিজ্ঞেস করলে বলে ওদের পাশের বাসার ভাড়াটিয়া দম্পতির সবসময় ঝগড়া-ঝাঁটি লেগেই থাকে। একটু পরপরই ভেসে আসে চিৎকার-চেঁচামেচি আর হই-হুল্লোড়ের শব্দ। এখন নাকি সেসব যন্ত্রণা থেকে অনামিকাও নিস্তার পেয়েছে ফাতেমার আবিষ্কৃত এই যন্ত্রের সুবাদে।
সামনে ফাতেমার বার্ষিক পরীক্ষা। পড়ার টেবিলে মুখ গোমড়া করে বসে আছে সে। আর হাই তুলে বারবার পড়ার টেবিলের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর পর ফাতেমার মা এসে পড়ার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। পড়া বাদ দিয়ে ঝিমুতে দেখে ওর মা গেলেন রেগে। এত করে বলি বিকেলে একটু ঘুমাও। না, ওনার সব সময় এটা ওটা বানানোর ধান্ধা। দিনে ঘুমানোর নামই নেই। বলি বিজ্ঞানীদের কি বিকেলে ঘুমানো বারণ!
ফাতেমার বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ দেখে ওর মা যে একেবারেই খুশি নন তা কিন্তু নয়। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে বাড়ির ছোটখাটো কোন ইলেকট্রনিক্সের সমস্যা হলে ফাতেমা নিজেই ঠিক করে ফেলতে পারে। তবে তার কথা আগে পড়াশোনা। স্কুলে ভালো করতে না পারলে এসবের কোনো দামই যে থাকবে না! ফাতেমার মা ওদের স্কুলেরই ইংরেজির শিক্ষক।
সবকিছু ঠিকমতোই চলছিল। কিন্তু মাঝখানে বাগড়া দিয়ে বসলেন মা। কথা ছিল ছোটমামা এবার স্পেন থেকে আসার সময় ফাতেমার জন্য একটি অত্যাধুনিক রোবট নিয়ে আসবেন। যে পড়াশোনাসহ দৈনন্দিন কাজে ফাতেমাকে সাহায্য করবে। কিন্তু ফাতেমার মা শর্ত জুড়ে দিয়েছে পরীক্ষায় প্রথম হতে পারলেই কেবল ছোটমামা রোবট নিয়ে আসবে। অগত্যা রাত জেগে পড়াশোনা করে সেই প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে ফাতেমা।
-‘ঠক…ঠক…ঠক…।’ দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলতেই ফাতেমা বিস্ময়ে একেবারে থ মেরে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে জলজ্যান্ত একটি রোবট। রোবটের পিছন থেকে নাটকীয় ভঙ্গিতে মাথা বের করলেন ছোটমামা। ফাতেমা চেঁচিয়ে আম্মুকে ডাকতে চাইলো। কিন্তু ওর গলার স্বর যেন আটকে গেছে। মুখ দিয়ে কোনো কথাই সে উচ্চারণ করতে পারলো না।
-‘রোবট দেখেই এত খুশি। মামাকে আর দরকার নেই! এই আমি চললাম!’ বলেই ছোটমামা কৃত্রিম রাগ দেখানোর ভঙ্গিতে উল্টো ঘুরে চলতে শুরু করলো। হাজার বলেও তাকে আর ফেরানো গেল না। ছোটমামার স্বভাবই এমন। একটু পরেই চকোলেটের প্যাকেট নিয়ে এসে বলবেন এটা আনতে ভুলেই গিয়েছিলাম। বলেই হেসে ফেলবেন। ছোট মামার নাম রফিক। রফিক অর্থ বন্ধু। সত্যি মামাটা বন্ধুর মতোই।
রোবটটাকে ভিতর নিয়ে এলো ফাতেমা। সবকিছু ইনস্টল করাই ছিল। রোবটটির পোশাক এবং বেশভূষা মেয়েদের মতো হওয়ায় ফাতেমা খুবই খুশি হলো।
-‘হাই, ফাতেমা! কেমন আছো তুমি?’
-‘কে…কে কথা বলে?’ এদিক ওদিক তাকিয়ে কউকে না দেখে ফাতেমা বুঝতে পারে রোবটটিই তার সাথে কথা বলছে।
-‘আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? তোমার নাম কী?’
-‘খুব ভালো আছি। আমার নাম রোবিয়া। তোমার বার্ষিক পরীক্ষা কত তারিখ থেকে শুরু হবে আপা?’
-‘তুমিই বলো দেখি কৃত্রিম বুদ্ধিমতী রোবট রোবিয়া!’
-‘হা হা হা! ডিসেম্বরের দুই তারিখ থেকে তোমার পরীক্ষা। আমি তোমাকে একটু যাচাই করে দেখছিলাম। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’
– ‘আমারও তোমাকে খুব ভালো লেগেছে। আচ্ছা তুমি কী কী কাজ করতে পারো?’
-‘তোমার কী করতে হবে সেটা আগে বলো। আচ্ছা পড়া বাদ দিয়ে কথা বলতে দেখে তোমার আম্মু বকবে না তো!’
– ‘তাইতো! দাঁড়াও দরজার পাশে শব্দখেকো যন্ত্রটা চালু করে দিয়ে আসি।’
– ‘শব্দখেকো যন্ত্র! সেটা আবার কী?’
ফাতেমা তাকে যন্ত্রটা দেখিয়ে বলল, ‘এর নাম মি. শব্দখেকো। আমাদের কথা দরজার বাইরে যাওয়ার আগেই সে গায়েব করে দিবে। ফলে বাইরে থেকে কেউ আমাদের কথা শুনতেই পাবে না।’
-‘বড়দের এভাবে ধোঁকা দেওয়া ঠিক নয় ফাতেমা। এক্ষুনি আমি তোমার আম্মুকে ডেকে নিয়ে আসবো। হা…হা…হা…।’ বলেই রোবট রোবিয়া হাসতে শুরু করলো। সেই যান্ত্রিক হাসি ফাতেমার কাছে বড়ই বিদঘুটে লাগলো। ফাতেমা তার দিকে তাকিয়েই বেশ ভড়কে গেল।
-‘অমন করে হেসো না তো! আমার ভয় লাগছে। তোমাকে এখন অন্যরকম দেখাচ্ছে কেন! একটু আগে কী সুন্দর লাগছিল।’
-‘হা…হা…হা…। আমি এমনই। গিরিগিটির মত রঙ পাল্টাই। চলো আমরা ছাদে যাই। তোমাকে তারাদের সাথে পরিচিত করে দেব।’
– ‘না, না! মা বকবেন।’
– ‘আরে কেউ জানবেই না। তোমার শব্দখেকো যন্ত্র আছে না!’ বলে কৃত্রিম স্বরে হাসতে লাগলো রোবট রোবিয়া।
ফাতেমা ভয় পেলেও সম্মোহিতের মত রোবটের পিছু পিছু ছাদে গেল।
– ‘আকাশের নক্ষত্রের দিকে চেয়ে রোবট বলল, জানো ফাতেমা! জাহাজের নাবিকেরা একসময় নক্ষত্র দেখে পথ নির্ধারণ করতেন। তোমাকে আগে সেইসব তারাদের চিনিয়ে দেই চলো। ঔ যে উত্তর গোলার্ধের বিখ্যাত তারামণ্ডলী সপ্তর্ষিমণ্ডল। এর মধ্যে একটি ছোট মণ্ডল আছে যেখানে দুটি উজ্জ্বল তারা ধ্রুবতারার সাথে একই সরলরেখায় রয়েছে। অন্যান্য নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে আছে ক্যাসিওপিয়া, অ্যান্ড্রোমিডা, পারসিউস, বৃষ, কালপুরুষ, মৃগব্যাধ, মিথুন। বেতেলজিউস হলো কালপুরুষ মণ্ডলের উজ্জ্বলতম তারা, দ্বিতীয় উজ্জ্বলতম তারা রিজেল। আরও কয়েকটি উজ্জ্বল তারা হলো ক্যানোপাস, ভেগা, ক্যাপেলা, আর্ক টরাস, রেগুলাস, এলডেব্রান ইত্যাদি।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো রোবিয়া।
– ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আজ অনেক কিছু শিখলাম তোমার কাছে।’
-‘তারার দেশ আমার খুবই প্রিয়। তোমাকেও আমি সেখানে নিয়ে যেতে চাই। যাবে তুমি?’
– ‘তারার দেশ! তুমি রোবট নাকি ভূত! সত্যি করে বলো!’ ভয়ে জড়িয়ে এল ফাতেমার কণ্ঠ।
– ‘হা হা হা! আমার পরিচয় তুমি এখনই জানতে পারবে। আমার পিঠে উঠে শক্ত করে গলাটা ধরে বসে পড়ো।’ বলে রোবট বিকটভাবে হেসে ফাতেমার দিকে অগ্রসর হতে লাগলো।
রোবটের দিকে চেয়ে এবার ভয়ে রীতিমতো কাঁপতে শুরু করলো ফাতেমা। এটাতো মামার সেই সুন্দর রোবট নয়। কেমন কুৎসিত দেখাচ্ছে এখন। বুকের হাড্ডি দেখা যাচ্ছে, মুখের গর্তে শুধু দাঁত দেখা যাচ্ছে। চোখের কোটর শূন্য। কঙ্কালসার শরীর নিয়ে ফাতেমার দিকে এগোতে এগোতে বিকট স্বরে হাসতে থাকলো একটু আগের সেই সুদৃশ্য রোবট রোবিয়া।
ফাতেমার সারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেছে। কাউকে ডাকার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে সে। এটা কি সত্যি রোবট নাকি ভূত!
হঠাৎ কারো কথার শব্দে ধড়ফড় করে জেগে উঠলো ফাতেমা। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো সকাল সাতটা। তার মানে এতক্ষণ ধরে স্বপ্ন দেখছিল সে। রাতে পড়তে পড়তে টেবিলে মাথা রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরই পায়নি। ভয়ে সমস্ত শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। পরিচিত কারো কণ্ঠস্বর শুনে কান খাড়া করলো ফাতেমা। দুরুদুরু মন নিয়ে বাইরে এসে দেখলো সত্যি সত্যিই ছোটমামা! তাজ্জব ব্যাপার! মামা কখনো আগে না বলে আসে না। ফাতেমা তার রুমেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। বাবা-মার সাথে কুশলাদি বিনিময় করছে ছোটমামা। ফাতেমার বাবা বললেন, ‘কিরে বলা নেই, কওয়া নেই! সাত সকালে হুট করে এসে হাজির। ফোন-টোন দিলে তো আমরা এয়ারপোর্টে যেতে পারতাম।’
‘দুলাভাই, আপনি ভালো তো! সাত সকালে আপনাদের জ্বালাতে চাইলাম না। আমাদের বিমান শেষ রাতে ল্যান্ড করেছে। তা ছাড়া আমার ভাগনিকে সারপ্রাইজ দেবো বলে কাউকে জানাইনি। কোথায় সে রাজকন্যা?’
ফাতেমা আর দেরি না করে মামাকে সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো।
মামা সালামের জবাব দিয়ে বলল, ‘ফাতেমা মামণি কেমন আছো? তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি দেখো।’ মামা বলার আগেই ফাতেমার চোখ চলে গেছে দরজার পাশে দাঁড়ানো বোবটের দিকে। এটাও স্বপ্ন কিনা পরীক্ষা করার জন্য ফাতেমা গায়ে চিমটি কাটলো। ব্যথা পেয়ে উহু বলে উঠলে মা বলে উঠলো, ‘তোর আবার কি হলো?’
ফাতেমার বিস্ময়ের পালা যেন শেষই হতে চায় না। সে রোবটের কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখলো। আড়চোখে একবার মামার দিকেও তাকালো। রাগ করে আবার চলে যাবে না তো! না, মামা বাবার সাথে কথা বলছে। ফের সে রোবটের দিকে তাকালো। ফাতেমার মনে হলো যেন রোবটটি তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

Share.

মন্তব্য করুন