আম হচ্ছে এমন এক সুষম ও সুস্বাদু ফল যে, এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যিনি আম খেতে পছন্দ করেন না। আমি তো আম পেলে সব খাবার ছেড়ে দিতে পারি। আমাদের একটা ভ্রমণ দল আছে। যারা হুটহাট বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাই। এখন সময়টা আমের। তাই আম বাগানে যাবো আম খেতে।
কোথায় যাবো ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্ত হয় আমরা যাবো আমের রাজধানীতে।
আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় দর্শনীয় স্থান আছে অনেকগুলো। ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ছোট সোনা মসজিদ, তোহাখানা, নাচোল রাজবাড়ী, শাহ নেয়ামতুল্লাহ এর মাজার, চামচিকা মসজিদ, দারাসবাড়ি মসজিদ, স্বপ্নপল্লী, ধানিয়াচক মসজিদ, রহনপুর নওদা বুরুজ, নীলকুঠি, মহানন্দা নদী, শুড়িলার তেঁতুল গাছ, টাংঘন পিকনিক পার্ক ও কানসাটের জমিদার বাড়ি।
আমরা কতটা দেখতে পারবো জানি না। ভ্রমণ মাত্র একদিনের। তবে আম বাগানে বনভোজন হবে।
রাত ১১টার ট্রেনে চেপে বসলাম আমাদের ১৮ জনের টিম। পদ্মা এক্সপ্রেস। বেশ দ্রুতগামী ট্রেন। ট্রেন ভ্রমণ আমার কাছে সব সময় আরাম ও আনন্দের।
তবে ট্রেনে আমরা সরাসরি চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাচ্ছি না। যাচ্ছি রাজশাহী।
সেখান থেকে প্রাইভেটে করে যাবো চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
রাতের খাবার জন্য ব্যবস্থা করা হলো ঢাকার বিখ্যাত কাচ্চি ভাই বিরিয়ানি। ট্রেন ছাড়ার পর খেয়ে নিলাম। তারপর ঘুম। যদিও টানা ঘুম হয় নাই। ভ্রমণে তা বোধ করি কারোই হয় না। যেটুকু হয় সেটুকুই প্রাপ্তি।

সকাল সাড়ে পাঁচটায় রাজশাহী স্টেশনে থামলো ট্রেন। আমাদের জন্য বাইরের বাস স্ট্যান্ডেই দাঁড়ানো ছিলো পূর্ব নির্ধারিত দুইটা প্রাইভেটকার।
কারে চড়ে রেলগেট পেরিয়ে যেতে লাগলাম আমরা। রাজশাহী শহর পেরিয়ে আমরা যাবো কানসাট।
বেশ পরিচ্ছন্ন গোছানো শহর। রাজশাহী সেনানিবাস দেখা গেলো হাতের ডানে। মূল সড়কের মাঝে কেবল ডিভাইডার না, তাতে দৃষ্টিনন্দন সাজ সজ্জা ও গাছ। একদম ধুলোবালিহীন। যা নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় মনে হচ্ছে।
সকালের নির্মল বাতাস অনুভব করছিলাম।
আহা পবিত্র সকাল। বাংলাদেশের সবচে পরিষ্কার শহর হিসেবে রাজশাহীর সুনাম আছে। এজন্যই বাতাসে এতো শুদ্ধতা।
কানসাট যেতে প্রায় ৭০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। গাড়ি যাচ্ছে যানজটহীন রাস্তা ধরে।
দুইপাশে বিস্তৃত ফসলের মাঠ।
ছাড়া ছাড়া কিছু পাঠক্ষেত ছাড়া ফসলের মাঠ শূন্য।
কোথাও কোথাও দল বেঁধে চড়ে বেড়াচ্ছে মহিষ।
আর একটা ফসলের চাষ দেখা গেলো লক্ষণীয় মাত্রায়। ড্রাগন ফল। বিদেশী ফল। এখন দেশেই প্রচুর চাষ হয়। বেশ মূল্যবান খাদ্য ও পুষ্টিগুণ বল এটা। গোপালপুর গোদাগাড়ি পার হতে হতে ঘড়িতে দেখলাম প্রায় ৭টা বাজে।
আমরা কানসাট যেতে যেতে জেনে নিলাম
কানসাট আম বাজার সম্পর্কে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে বসে বাংলাদেশের বৃহত্তম আমের বাজার।
আমের মৌসুমে দেশের এই আম বাজারে প্রায় শত কোটি টাকার উপরে আম বেচাকেনা হয়।
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে অনেক আমের বাজার থাকলেও কানসাট আমের বাজার পাইকারি বাজারের জন্য সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাত। যাচ্ছি আমরা কানসাট। পেটের ক্ষুধা জানান দিচ্ছে, নাশতা চাই। সকালের নাশতা খেতে হবে। নাশতার জন্য নির্ধারিত আছে কালাই রুটি। শুনেছি স্থানীয় নাশতা হিসেবে এটা বিখ্যাত।
কিন্তু ক্ষুধা আর দেরি মানছে না। আমরা মহানন্দা ব্রিজের উপর ওঠার আগেই গাড়ি থামিয়ে ডাব খেয়ে নিলাম একটা করে। বেশ মিষ্টি জলের ডাব।

মহানন্দা নদী ছোট নদী। এর মূল অংশ ভারতে। পঞ্চগড় হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এসেছে।
পদ্মা নদীর উপনদী হচ্ছে এই মহানন্দা। আমরা দুপুরের গোসল করবো এই নদীতে।
মহানন্দা নদীর ব্রিজ পার হতে হতে সময় দেখলাম সকাল আটটা।
আরো কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম শিবগঞ্জ প্রবেশ করেছে আমাদের গাড়ি।
আর দশ কিলো গেলেই কানসাট বাজার।
শিবগঞ্জ ঢোকার পর থেকেই দুইপাশে কেবল আম বাগান দেখছি। বিশাল বিশাল সব আম গাছ।
আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি আমের রাজ্য কানসাট বাজারে।
ভ্যান এ করে শত শত লোক আম নিয়ে আসছে বিক্রির জন্য।
আমাদের গাড়ি আমের গাড়ির মাঝে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এতো এতো আম একসাথে আমি আর কোথাও দেখি নাই। এরা কি আম শুধু চাষ করে, নাকি খায়ও, আমি এখানকার হলে ভাত মাছ ছেড়ে কেবল আম খেতাম।
আমাদের গাড়ি থামলো লিটনের হোটেলের সামনে।
নাশতা খাবো এখানেই। কালাই রুটি, গরুর গোশত, মরিচের ভর্তা অর্ডার করা হলো।
আসার পথে কলা নিলাম আমরা।
স্থানীয় কলা। বেশ বড় আর সুন্দর দেখতে। খেতেও মজা।
আমরা একদম জম্পেশ একটা নাশতা করলাম।
কালাই রুটির সাথে মরিচ ভর্তা এখানকার স্পেশাল। শুকনো মরিচ, প্রচুর লবণ, পেঁয়াজ আর সরিষার তেল তৈরি করা হয় এই ভর্তা। সাথে গরুর মাংসের ভুনা।
আমরা প্রায় সবাই বড় সাইজের দুটো করে রুটি খেলাম।
নাশতা পর্ব শেষ করে আবার গাড়িতে।
পরের গন্তব্য, ভোলাহাট।
সেখানেই আমাদের বনভোজন হবে।
আম বাগানে রান্না হবে। আর আম খাওয়া হবে ইচ্ছে মতো। এই পথেও যেতে যেতে দেখলাম প্রচুর আম গাছ, আম বাগান।
একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম।
বেশ কিছু আম গাছের আম গুলোতে একটা করে প্যাকেট বাঁধা, ভেতরে আম রেখে বাইরে প্যাকেট কেন! খোঁজ নিয়ে জানলাম এতে করে আমের রংটা বেশ ভালো হয়। পোকার আক্রমণ থেকেও রক্ষা হয়।
বিশেষ করে রফতানি করার উদ্দেশ্যে যেসব গাছের আম রাখা হয়, তাতেই এই বিশেষ যত্ন।
আমাদের গাড়ি যেতে যেতে একটা সরু রাস্তায় ঢুকে পড়লো। কিছুদূর যাওয়ার পর চোখে পড়লো শিকারপুর বিদ্যালয়ের প্রবেশ দ্বার।
গ্রামের অসাধারণ মায়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাঁশঝাড়, পুকুর, হাঁস, আঁকাবাঁকা পথ।
শাপলার ছোট বিলও চোখে পড়লো।
পথের দুই পাশে আম গাছ ছাড়াও আছে খেজুর গাছ।
এরপর আমরা পেরিয়ে গেলাম গোলাপ বাজার।
এই দিকে গ্রামের বাড়িঘর দেখলাম প্রায় সব ইটের তৈরি। মাটি, টিন, কাঠ এর বাড়ি চোখে প্রায় পড়লো না। বোঝা যাচ্ছে স্থানীয়রা অতটা দরিদ্র না হয়তো। তাদের আয়ের মাধ্যম ভালোই আছে। যে অঞ্চল আমের রাজধানী হিসেবে খ্যাত, তাদের অভাবী হবার কথাও না।
বড়গাছি হাট পেলাম যাওয়ার পথে।
এখানে একটা চা বিরতি দরকার। থামলো আমাদের গাড়ি। রোজ ক্যাফে ঢুকে আমরা খাঁটি গুড়ের চা খেলাম। আর খেলাম স্থানীয় পেয়ারা সন্দেশ।
কেউ কেউ বলে দম মিষ্টি।
আমরা ভোলাহাট উপজেলায় পৌঁছতে পৌঁছতে সময় হলো সকাল সাড়ে ১০টা।
চা বিরতির পর আমরা আবার যেতে থাকলাম আমাদের বনভোজনের আম বাগানের দিকে।
আমরা আরো প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে যেতে যেতে কিছু মাটির বাড়ির দেখা পেলাম। গরুর গোয়াল, ঘুটে, নাড়ার পাল, দীঘি, ছাগল, রাজহাঁস এর পাল। সব মিলিয়ে সত্যিকারের গ্রাম্য পটভূমি যাকে বলে।
ফতেহপুর খাসপাড়া পেরুচ্ছি আমরা।
মেডিক্যাল গেট পেরিয়ে হলদিগাছি গ্রামের উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। প্রচুর আম গাছের সারি।
ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশন এ এসে থেমে গেলো আমাদের গাড়ি। ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশন বিরাট আমের হাট।
আপাতত এখানেই আমরা আম কিনবো আর আম খাবো।
বেশ কিছু সময় ঘুরে ঘুরে।
ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশন থেকে আমরা প্রায় ২৫ মণ আম কিনলাম। উল্লেখ্য এখানে প্রায় ৫২ কেজিতে এক মণ। বিষমুক্ত প্রিমিয়ার কোয়ালিটির হিমসাগর আম।
এইখানে আমাদের অনেক বেশি সময় লেগে গেলো। আম কিনে প্রসেস নিজেদের ঠিকানায় কুরিয়ার করার প্রক্রিয়া করতে বেলা দুইটা বেজে গেলো।
আম নেয়ার পাশাপাশি আম খাওয়া হলো টুকটাক।
কারণ হাটে পাকা আম খুব একটা নাই।
এরপর আমরা আম বাগানের দিকে গেলাম। সেখানে রান্না হচ্ছে দেশি হাঁস। খাসি, মাছ, ভাত। সেখানেই আমাদের খাওয়ার জন্য রাখা হয়েছে গাছপাকা স্পেশাল আম। ভোলাহাট গিলাবাড়ির ইন্ডিয়ার বর্ডার।
যেটাকে ভাগ করেছে মহানন্দা নদী।
এই নদীতেই হবে আমাদের গোসল।
আম বাগানে পৌঁছে জানতে পারলাম এটা ৩০০ বিঘা জমির একটা আম বাগান।
কাজী জালাল সাহেবের আম বাগান এটা।
এখানে বেশির ভাগ আম গাছের ডাল এতো নিচে যে মাথায় আমের টোকা লাগে। মাথা নুইয়ে হাঁটতে হয়। আমরা আমাদের বনভোজনের মূল এরিয়ায় আসলাম। রান্না প্রায় শেষ।
তবে শুরুতেই গাছপাকা টসটসে আম নিলাম খাওয়ার জন্য। আনলিমিটেড আম। একটা দুইটা করতে করতে কম করে হলেও দশটা আম খেয়েছি আমি।
সাথের সবার অবস্থা প্রায় কাছাকাছি। আম বাগানে বসে খাওয়ার গাছপাকা আম খেতে যে কী মজা তা এখানে না এসে কেউ বুঝবে না।
এরপর শুরু হলো আমাদের মহানন্দা নদীতে গোসল পর্ব। আহা নদী। আহা আনন্দ।
নদীর জলে আমরা সবাই নিজের ক্লান্তি ধুয়ে ফেললাম। টানা এক ঘণ্টা গোসল হলো।
তবে খুব বেশি দূরে সাঁতরাতে পারি নাই।
প্রথমত নদীর স্রোত ও গভীরতা অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত নদীর অর্ধেকটা ইন্ডিয়ার, বাকি অর্ধেকটা আমাদের। তাই নদীর মাঝে যাওয়া বা সাঁতার কাটা নিষেধ।
দুপুরের খাওয়ার আয়োজন ছিলো দারুণ।
তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে আম খেয়ে পেট এতো লোড হলো যে আমি শুধুমাত্র হাঁসের দুই টুকরো মাংস ছাড়া আর কিছু খেতে পারি নাই।
বিলের রুই মাছ, গরুর গোশত, চাটনি, বুটের ডাল, দই, সব ছিলো। তা প্লেটেই রয়ে গেলো।
তবু আফসোস নাই।
আমের রাজ্যে আম খেয়েছি। তবে সত্য কথা হচ্ছে, বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। এতোটা আম একসাথে খাওয়া ঠিক হয় নাই। ইন্ডিয়ার বর্ডার পিলার।
গেলাম পিলার দেখার জন্য। পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই ইন্ডিয়ার মাটিতে দুই পা রেখে আসলাম।
এপার বাছুর বান্দা বর্ডার।
ওপারে ভারতের মাল্দা।
এতোটা কাছাকাছি ওদের বিএসএফ ক্যাম্প যে এই জায়গায় একটু বেশি সময় থাকতে দেখলে কপালে খারাপি আছে। তাই আমরা যত দ্রুত সম্ভব ফটোসেশন করে বেরিয়ে এলাম।
আম বাগানের বনভোজন এখানেই শেষ।
এর মধ্যে দেখলাম একজন কিশোর ছেলে অদূরেই গাছ থেকে ঝরে পড়া পাকা আম কুড়োচ্ছে।
আমাদের টিমের দুজন ওকে ইশারা করে আম খেতে চাইলো। ছেলেটা নির্দ্বিধায় এগিয়ে দিলো তিনটা গাছ পাকা আম। যদিও আমরা খাওয়ার পর পেট এতো ভরেছে যে বাড়তি কিছু খাওয়া সহজ না, তবু এক রকম চোখের ক্ষুধা থেকেই একটু একটু করে খেলাম।
আম বাগানের বন ভোজন ও আম ভোজন মিলিয়ে অসাধারণ এক ভ্রমণ শেষ করে রাতের ফিরতি ট্রেনে ফিরে এলাম যে যার বাসায়। ওদিকে কুরিয়ারে পাঠিয়ে দেয়া আম বাসায় আসবে শিগগিরই।

Share.

মন্তব্য করুন