২০১৭ মে মাসের কোনো এক বিকেলে কথা বলছি। কাফি কাল আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে যাচ্ছি। তুমিও যাচ্ছ আমাদের সঙ্গে। রেডি থেকো। ফোনের ওপাশ থেকে আমার আড়মোড়া ভেঙে দিয়ে বলল যোবায়ের মাহমুদ। অনেকদিন কোথায়ও যাওয়া হয় না। কেমন জানি ঘুমিয়েই ছিলাম। নেতিয়ে গিয়েছিলাম। যোবায়ের মাহমুদের কথা শোনে যেন জিয়ে গেলাম।
হু অবশ্যই যাবো। ইনশা-আল্লাহ। তো আমরা যাচ্ছি ক’জন?
আমি, জুনায়েদ আহসান ভাই, রাকিব, আহমাদ যুবায়ের তুমিসহ পাঁচজন।
পরদিন সকাল সকাল আমরা গাজীপুরের বাসে চেপে বসি। গন্তব্য গাজীপুর।
সাফারি পার্ক চেনো? বললাম পাশে বসা যোবায়ের মাহমুদকে।
না, চিনি না। বাইরের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো মাহমুদ।
তাহলে বাকি তিনজনের কেউ তো আলবত চেনে। জুনায়েদ ভাই, আহমাদ যুবায়ের ও রাকিব; তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, না, আমরা কেউ-ই চিনি না। তবে এটা জানি পার্কটা গাজীপুরে।
হায়! হায়! বলে কী! আমরা কেউ চিনি না। তাহলে কী হবে? আমার চেহারায় আতঙ্কের রেখা এঁটে গেল।
জুনু ভাই আমাকে বরাভয় দিয়ে বলে উঠলেন, আরে কাফি এটা তো কোনো বাইরের রাষ্ট্র নয় যে আমাদের হুমভয়ার্ক করে আসতে হবে। আমেরিকার আমাজন-ও তো নয় যে পার্ক খোঁজে বের করতে শার্লক হোমস লাগবে। বরং এটা আমাদের সোনার দেশ। চিরচেনা বাংলাদেশ। দেখবে ঠিকই খুঁজে নেব। গাজীপুর তো!
জুনায়েদ ভাইয়ের কথায় কিছুটা আশ্বাস পেলেও এভেবে আমি খানিকটা চিন্তিত ও লজ্জিত, এটা কোনো কথা! গন্তব্যের নাম জানি কিন্তু পথ চিনি না। অবশ্য এটা দাদাদের দেশ নয় এবং দাদারাও এখানে থাকে না যে, তারা উল্টাপাল্টা পথ বাতলে দেবে। বরং এটা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। সবুজ শ্যামল দেশ। এখানকার মানুষগুলোর মনও সবুজ। পরোপকারী। জিজ্ঞেস করলে ঠিক ঠিক বলে দেবে।

দুই.
শেষমেশ জিজ্ঞেস করে সিএনজি ধরে পৌঁছালাম সাফারি পার্কের দ্বারপ্রান্তে। ভাড়া মিটিয়ে কাউন্টারে গেলেন জুনু ভাই। সঙ্গে গেল যোবায়ের মাহমুদ। আমি, আহমাদ যুবায়ের ও রাকিব; আমরা তিনজন হাঁদারামের মতন দাঁড়িয়ে আছি। পুরো সফরে আমরা হাঁদারামই ছিলাম। সবকাজ করেছেন জুনু ভাই ও মাহমুদ।
বিশাল গেইট। বেশি আড়ম্বরতা নেই। তিনটে লম্বা গাছের মতো কিছু দাঁড় করিয়ে গেইট তৈরি। তিনটি গাছের দুই ফাঁকে দুটি বড় মাকড়সা জালসহ দাঁড়িয়ে আছে। গেইটের দু’পাশে দুটো বিশাল দেহ ওয়ালা হাতি দাঁত দুটো বের করে শুঁড় শূন্যে উঠিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গেইটের ওপর সুন্দর করে লেখা ‘স্বাগতম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, গাজীপুর’।
যাইহোক, ঢুকলাম ভেতরে। যেন সবুজের রাজ্যে পদার্পণ করলাম। সবুজের গালিচা বিছানো এক বিশাল মাঠ। সবুজ গাছ। গাছের পাতা সবুজ। এ যেন সবুজে মাখামাখি। কিন্তু যে দু-তিনটে ফুল ফুটেছে তাদের পোশাক লাল। ফুল-ও বেয়াদব! মা-বাবা পাড়াপড়শি সবাই সবুজ হলেও সে লাল হয়ে বসে আছে! যাক, এটা তার ব্যাপার। আমি নাক গলাচ্ছি কেন!?
সবুজ মাঠের মাঝে মাঝে লাল পাকা ইটের সরু রাস্তা আঁকাবাঁকা হয়ে শুয়ে আছে। শুধু মাটির রাস্তাও আছে। তাদের বললাম, সোজা হয়ে শোও। কথা শুনল না। এদেরকেও বেয়াদব মনে হলো। আবার রাস্তার পাশ ঘেঁষে ঘেঁষে খয়েরি রঙের বেঞ্চি পাতা। তারা যেন নীরবে ঘুমোচ্ছে। বেঞ্চিগুলো আমার মনে ধরেছে। বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। শিল্পীর প্রশংসা করতেই হয়।
একটু সামনে ডানদিকে একটি পুকুর। ছোট। কিন্তু দেখতে মিষ্টি। পুকুরের চার পাশে দেহরক্ষীর মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট গাছ। নাম জানি না। তবে গাছগুলো সুন্দর। আমাদের দেখে পুকুরটা যেন হেসে দিলো। বেশ দুষ্টু হয়েছে ভেবে ছোট্ট একটি পাথরের কণা মেরে সুড়সুড়ি দিলাম পুকুরকে। সে নেচে উঠল। পুকুরকে পেছনে ফেলে একটু এগুতেই চোখ পড়ল একটি গেইটে। যা উঁচু-নিচু ছোট ছোট পাহাড় দিয়ে তৈরি। মেইন গেইট এর কাছে নত হবে। বেশ সুন্দর। গেইটের দু’পাশে গলা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দুটো জিরাফ। ইট-পাথরে গড়া। গেটের ঠিক ওপরে একটি সিংহ দাঁড়িয়ে আছে। (কিন্তু বর্তমানে এটি নেই।) তার নিচেই লেখা SAFARI KINGDOM-এ ঢুকলাম এ গেইট দিয়ে। পার্কটা বিশাল জায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। ৩৮১০.০ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের মাস্টার প্ল্যানের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। তবে পার্কে বেশ ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। মানুষ যে খুুব একটা আছে এমন নয়। যত ভেতর যাচ্ছি ততই জনমানবশূন্য হয়ে উঠছে পার্ক।
আরেকটু এগুতেই সামনে পড়ল টিকিট কাউন্টার। ছোট ট্রলার দিয়ে রয়েল টাইগার দেখানো হবে। একটা বড় পুকুরের মতন। দেখতে ছোটখাটো একটা বিল। তার মাঝখানে ভেসে ওঠা দ্বীপের মতো একটি উঁচু জায়গা। ওই দ্বীপেই গড়ে উঠেছে ছোটখাটো একটা জঙ্গল। আর ওখানেই টাইগারদের বসবাস। ট্রলার দিয়ে দ্বীপের চারপাশ পর্যটকদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হয় ওই ছোট্ট বনের টাইগারদের। এতেই পর্যটকরা মহাখুশি। আর টাইগাররাও এভেবে মুদিত হয় যে, কিছু আদম সন্তান আমাদের ভয়ে দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে!
কী মনে করে যেন আমরা উঠিনি ওই ট্রলারে। দেখিনি ছোট্ট বনের টাইগারদের। রাকিব প্রবল আগ্রহ দেখালেও আমাদের অনাগ্রহের কাছে তার আত্মসমর্পণ করতে হলো। জুনু ভাই ও দুই যুবায়েরের কাছ থেকে অনেক কিছু শুনতে হলো রাকিবকে। তুমি কি এখন বাচ্চা… ইত্যাদি। আমি বাকসংযম করে রাকিবকে প্রবোধ দিয়ে আমরা সামনে এগুলাম।

তিন.
আরেকটু দূরে খালের মতো লম্বা নালা নিভৃতে শুয়ে আছে। পানি নেই বেশি একটা। ওই নালার মাঝে মাঝে পারাপারের জন্য বাঁকা মেঠোপথ উঠেছে। মাটির শোয়া ব্রিজ বলা যেতে পারে। রাকিব, জুনু ভাই, আমি এরপর আহমাদ যুবায়ের সিরিয়াল ধরে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ওই মাটির বাঁকা ব্রিজে। আর এ মোমেন্টামকে ক্যামেরা বন্দী করেছে যোবায়ের মাহমুদ।
আরেকটু সামনে যেয়ে দেখি মানুষের ভিড় লেগে আছে। আমরাও গেলাম ওই ভিড়ে। দেখি বাঁশ কাঠ ও ওপরে বন বা খেড় দিয়ে দোচালার মতো তৈরি করে পুল বানিয়ে রেখেছে। নিচে পানি। পুকুর কিংবা বড় নালা হবে। সবাই ওই পুলের দু’পাশ দিয়ে ঝুঁকে নিচের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। কী যেন দেখছে আর হিহি করে উঠছে। আমরাও তাকালাম। একি! এতো সুন্দর সুন্দর মাছ। লাল লাল মাছ। ঠিক লাল না, কমলা রঙের মাছ। সবাই ওই মাছের খাবার কিনে ওপর থেকে নিচে নিক্ষেপ করছে, আর মাছেরা একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই খাবার লুফে নিচ্ছে। দেখতে কী যে সুন্দর লাগছে! আমরাও মাছের কিছু খাবার কিনে দিলাম তাদের। তারা ঝাঁপাঝাঁপি করে ওই খাবার খাচ্ছে!
পার্কওয়ালাদের কী সূক্ষ্ম বুদ্ধি। ওরা মাছ পালছে। কিন্তু মাছকে এমন পদ্ধতিতে সাজিয়ে রেখেছে যে, পর্যটকরাই নিজের টাকা খরচ করে ওই মাছদের জন্য খাবার কিনে খাওয়াচ্ছে! বিনা খরচে বিনা কষ্টে দ্বিগুণ লাভ!
আরেকটু এগুতেই দেখি মানুষের মতো উন্মুক্ত হাঁটছে বানর! অনেকগুলো। মানুষ তাদের বাদাম দিচ্ছে। দিচ্ছে কলা চিপস; যার কাছে যা আছে তাই দিচ্ছে বানরদের।
আমি আবার সাহসিকতা দেখানোর জন্য আগ বাড়িয়ে ব্যস্ত থাকা একটি বানরকে পা দিয়ে খোঁচা মেরে বললাম, কিরে ছুঁচো বানর! এত কেন খাস, তাও আবার অন্যদের থেকে চেয়ে চেয়ে? তোদের লজ্জাশরম কি লোপ পেয়েছে?
বানর বেটা আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল। হয়তো তার গায়ে কাঁটার মতন বিঁধছে আমার বুলি।
ভেবেছিস আমি ভয় পাব? দু’হাতে দুঁ’হাটু ধরে সামান্য নুয়ে একটু দূরে বানরের দিকে তাকিয়ে বললাম, হুম, কী! খুব লেগেছে? বলার সাথে সাথে বেটা বানর আমার দিকে তেড়েফুঁড়ে আসতে লাগল। হয়তো আমার কথা বাক্যবাণ হিসেবে নিয়েছে বানর। আমি তো দৌড়। কিন্তু ওই বেটা কিছুতেই আমার পিছু ছাড়ছে না। হায় হায়! কী মুসিবত। মান-সম্মান সব প্লাস্টিক! যত মানুষ ছিল সবাই বানরের কা- দেখে হিহি করে হেসে দিলো। কিন্তু আমার কান্না পাচ্ছে। কারণ বানর তখনো আমাকে দৌড়াচ্ছে।
এক-দুই মিনিট আমাকে দৌড়িয়ে এবার থেমেছে বানর। ততক্ষণে আমার সব…! আমি হাঁপাচ্ছি। মনে মনে কান-ও ধরেছি। আর কোনোদিন কোনো বানরের সাথে বাঁদরামো করব না। এখনো মাঝে মধ্যে গুগল ড্রাইভে গিয়ে ওই বানরের ছবিটা দেখি। ছবিটি জুনায়েদ ভাই কখন যে তোললেন! ছবিতে দেখা যায় আমি একটু দূরে দু’হাতে দু’হাঁটু ধরে একটু নুয়ে বানরের সাথে কথা বলছি। আমার পাশে রাকিব এর পর দুই যোবায়ের যার যার মতো দাঁড়িয়ে। আর বানর ক্যামেরার সামনে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ও-ও হাঁপাচ্ছে বোধ হয়।
আরেকটু ভেতরে যেতেই চোখ আটকে গেল বিশাল এক কুমির দেখে। হাঁ করে শুয়ে আছে। মানুষ কুমিরের ওই হাঁ করা মুখ দিয়েই ভেতরে যাওয়া-আসা করছে। আমরাও গেলাম। কারণ ভেতরে একটি ছোট পার্ক। বাচ্চাদের। আর পার্কের গেইট-ই হলো ওই কুমিরের মুখ। আরে আপনারা ভয় পাবেন না। ওই কুমিরটা ইট-সিমেন্টের তৈরি। তাইতো দুই যোবায়ের ও রাকিব কুমিরের ওপর উঠতে পেরেছে। হাঁটাহাঁটি করতে পেরেছে মাথা থেকে পা অবধি।
হাতে সময় কম থাকায় আর ভেতরে যাওয়া হয়নি। দেখা হয়নি আরো বহু প্রাণী। লম্বা শুঁড় বিশিষ্ট বিশাল দুই দাঁতওয়ালা হাতির পিঠে হয়নি ওঠা। দেখা হয়নি আরো অনেক কিছু। আসরের আগ মুহূর্তে আমাদের পার্ক বিচরণ সাঙ্গ করে বের হয়ে আসি। গেইটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়ার গাড়ি। এবার রাকিব গোঁ ধরল সে ঘোড়ার গাড়িতে উঠবেই। কারণ পার্কে তার একটি কথাও রাখা হয়নি। আমরা সবাই তার রোখ মেনে নিলাম। পূরণ হলো তার শেষ ইচ্ছে। সাথে সাথে আমাদেরও। আমরাও যাচ্ছিলাম ঘোড়ার গাড়িতে চড়তে। কিছুসময় ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে মিরপুরের গাড়িতে চেপে বসলাম।
যতটুকু দেখেছি আমি মুগ্ধ হয়েছি। পার্কটা আমার কাছে অসম্ভব ভালো লেগেছে। এর অন্যতম কারণ হলো, পার্কটা সবুজে মাখামাখি। সবুজ দেখলেই আমার মন ভরে যায়। হয়তো সবুজ দেশের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা এর অন্যতম কারণ। আরো দৃষ্টি কেড়েছে টাইগারদের দ্বীপ। যদিও যাওয়া হয়নি। বানরদের বিচরণ আর আমার শিক্ষা তো আছেই! কোনোদিন যদি আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে যাওয়ার ফুরসত পাই তাহলে পুরো পার্কটাই দেখে আসব। ইনশা-আল্লাহ।

Share.

মন্তব্য করুন