এখন মধ্য রাত। নদীর বুকে ভেসে চলেছে একটি ডিঙ্গি নৌকা। তাবৎ পৃথিবীর নীরবতা আর নিস্তব্ধতা যেন ঘিরে আছে নদীপাড়ের ছনের অন্ধকার ঘরগুলোয়। অনবরত ফিনফিনে বাতাসের দলে ঘুরে ফিরে আসে ধমকা হাওয়া। ঝড় হতে পারে, হতে অয়ারে ঝড়ের আশঙ্কায় জেলে পাড়ার সবকটি নৌকা নদীতে ভাসবে ভাগ্যের খুঁজে। মাছেদের পছন্দ উত্তাল ঢেউ আর অনাবিল পানির মিতালি। এই সময়টাই মোক্ষম তা হোক মাছেদের কাছে কিংবা জেলেদের কাছে। এ পুরো ব্যাপারটাই যাদের কাছে অবিচার মনে হচ্ছে তারা হল বয়স্ক হারুন আর তার পুত্র সোনাই।
খুব গুছিয়ে জাল ফেলতে ফেলতে দূর নদীর পাড়ে চোখ বুলাচ্ছে হারুন। কোনো নৌকায় লন্টন জ্বলছে কিনা, আবার কোনোটা গা ভাসিয়ে দিলো কিনা। নাহ কারো আসা যাওয়া চোখে পড়ছে না। মাঝে মাঝে একটা আহাজারি কানে লাগে, ওটা একটা পাগলি বুড়ির। হারুনের মনে হয়, বালিশ চাপা দেয়ার মতো নিরবতা যেখানে চেপে আছে, তার কাছে এ আহাজারি কিছুই না। বুক কাঁপে শুধু সোনাইয়ের, এই বুঝি বুড়ি সবার ঘুম ভাঙল। বাড়ি ফিরেই তাকে শাসাবে বলে মনে মনে ঠিক করলো সে। বাবার সাথে মাছ ধরতে এসে সোনাইয়ের নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই, গলুইয়ে মাছ ভরা ছাড়া। আর জাল ফেলার সময়টাতে নিচু স্বরে জিকির করা; আল্লাহ…আল্লাহ…। স্রষ্টার প্রতি যার এতো ভরষা, তারই আবার এতো অভিযোগ। অভাব যাদের কোলে পিঠে মানুষ হয়েছে, স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ তারা খুব কমই পায়।
সে রাতে জালে বেশ মাছ ঊঠলো। বাজারে নেই মাছের দাম। এমন আনন্দ আর বেদনার দোলাচলে বাড়ির পথে নৌকা ঘুরালো হারুন। এদিকে আলো ফুটতে বাকি আর কিছু সময়। সে রাতে আর ঝড় হলো না। খেয়ে পড়ে বাঁচা জীবনের সুখটুকু চিনতে শুরু করেছে সোনাই, সে ভাবে এটাই বুঝি জীবন। মাথা ঘুরিয়ে বাবাকে দেখলো সে, যার চোখ ফিকে হয়ে গেছে বার্ধক্যের ছাপে। সোনাই কান পেতে শোনে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। এটাই জেলেদের জীবন সংগীত, চলার পথে ঠাই।

১.
সকালের আলো ফুটেছে আগেই। ছনের ঘরে আলো ঢুকে যায় বিনা অনুমতিতেই। আট-দশ ঘরের ছেলেপুলে জোড়ো হয়েছে উঠোনে। কান ভারি করা হই-হুল্লোড়ে সোনাই আর ঘুমুতে পারে না। পাছে স্কুলে যাবার তাড়া। এই জেলেপল্লীতে যে কজন স্কুলে যায় সোনাই তাদের অন্যতম, ডানপিটেও বটে। তবে জেলেপাড়ার গড়পড়তা সংস্কৃতির অনেকেটা বাইরে থেকে গেছে সোনাই। তার বয়সী ছেলেরা রাতভর মাছ ধরে। রোজ সকালে বাজারে মাছ বিকিয়ে তবেই বাড়ি ফেরে ওরা। তারপর লম্বা ঘুম। বিকেল হতেই সন্ধ্যে অবধি তাস খেলে যে যার ঘরে ফিরে যায়। বয়স বাড়লে তাদের জীবনে আসে নারী আর নেশা। এ যেন জীবনের খোলসে আটকে পড়া।
এতসব জীবনের অনুকূলতায় প্রতিকূলতা টেনে এনেছে হারুন। হারুনই এ তল্লাটের সবচাইতে শিক্ষিত, যে মোটে পড়তে পারে। জীবনের করাঘাত আর দারিদ্র্যতার রোশানলে চাপা পড়েছিল হারুনের পাহাড়সম সম্ভাবনা। বেঁচে থাকার প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের মরে যেতে হবে এই হারুনের জীবনবোধ। নিজের সব স্বপ্ন-স্বাধীনতা বিলিয়ে দিয়েছেন মা হারানো সোনাইয়ের জীবনে।
দু-চারটে পান্তা ভাত মুখে দিয়ে স্কুলের পথ ধরলো সোনাই। সাথে দীপু আর মন্টু। দীপু তার খুব কাছের বন্ধু, যার সাথেই সবকিছুতেই তাল মিলিয়ে চলে সে। আর মন্টু হল সোনাইয়ের পোষা কুকুর। এদিক-ওদিক ছুটে এগুচ্ছে সে। রাস্তার অন্যসব কুকুরদের এলাকায় গিয়ে রেষারেষি করাই তার অন্যতম কাজ।
স্কুলের কাছাকাছি যেতেই বাবার সাথে দেখা। বাজারের ব্যাগ থেকে দুজনকে দুটো পেয়েরা দিতে দিতে বললেন, ‘হেডমাস্টার সাহ বললেন কি, এবার যদি পরীক্ষায় ভালো করতে পারিস তবে শহরের মিশনারীতে পড়তে পারবি’।
সোনাই ভেঙচি কেটে বললো, ‘গতবারও তো বললে এই কথা, কই কিছু হল না তো?’
হারুন এবার জোর দিয়ে বলল, ‘এবার হবেই বাপ হবে, ভালো মতো পইড়ে পরিক্ষাটা দে’, বলে হারুন আর দাঁড়ালো না।
এদিকে পুরোদমে ক্লাস চলছে। দীপুর ক্লাসে মন নেই। দোতলা করিডোর পেরিয়ে সবশেষের ক্লাসরুমটা তাদের। স্কুলটা একটা টিলার ওপর হওয়াতে আশপাশের সব কিছুই চোখে পড়ে। পাহাড়ি সরু রাস্তা, বিশাল একটা দীঘি ও তার আরো দূরে উপজাতি পাড়া। এসব দেখেই নাকি ঘণ্টার পর ঘন্টা পার করে দেয়া যায়, দীপু বলে।
‘টিফিনে যাবি নাকি ওদিকটায়?’ আচমকা বলে ঊঠে সোনাই। একথা শুনে দীপুর চোখ দুটো জ্বলে উঠে, চমকে যায় সে। বলে,’ বেশ তো। চ…ল।
যেই বলা সেই কাজ। সবার চোখ এড়িয়ে স্কুলের পেছনের দেয়াল টপকে বেরিয়ে পড়লো দু’জন। দু’জনের হাতেই বাঁশের কঞ্চি। ঘন ঝোঁপ ঝাড়ে ভরা সরু রাস্তার দু’পাশ। এলোপাতাড়ি লতাপাতা সরিয়ে এগুতে লাগলো তারা। বিষাক্ত সাপ, কাটায় ভরা লতাগাছ আর ক্ষতিকর কতকিছুই তো থাকতে পারে এখানে। কিছুদুর এগোতেই চোখে পড়লো দীঘিটা। কি স্বচ্ছ তার জল আর সারা গায়ে ফুটে আছে অগণিত পদ্মফুল। আঁজলা ভরে পানি খেলো দু’জন। তীব্র রোদে ঘেমে নেয়ে যাবার জোগাড়। হাঁটুপানিতে নামলেই পদ্মফুলের সারি সাজানো আছে।
দীপুর আর তর সইলো না, বলল,‘কয়েকটা ফুল নিলে মন্দ হতো না রে সোনাই’।
সোনাই রেগে বলল,‘বাড়াবাড়ি করিস না সোনাই। টিফিনের পরেই অংক স্যারের ক্লাস। দেরী করলে পিঠের চামড়া থাকবে না’।
কে শোনে কার কথা, সোনাইয়ের বারণে কান না দিয়ে পানিতে নেমে পড়লো দীপু। এক পা যখনই এগুতে যাবে তখন দেখলো বিশাল এক গোখরা সাপ পদ্মফুলের চারপাশ পেঁচিয়ে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে। সাতপাঁচ না ভেবে দু’জন দিলো ভো দৌঁড়। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে এলো পাহাড়ের উঁচু চূড়াটায়, কাছেই উপজাতি পাড়া। এ যেন অপার সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি। যতদূর চোখ যায় চোখে পড়ে সুঊচ্চ পাহাড় আর নাম না জানা হরেক রকমের গাছে। হটাত দেখলে মনে হবে আকাশ ছুয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। যেন আকাশের খুঁটি।
দূরে চোখে পড়ছে মিশনারি স্কুল, যাকে ঘিরে আছে গাঢ় সবুজ বন-বনানী। স্কুলের অদুরেই নজরে আসে বাঁশঝাড়। কত লোককথা আর বানোয়াট গল্প এখানে প্রচলিত আছে তা কানে আসলে পিলে চমকে ঊঠে। দিপু আর সোনাই এসবে কান দেয় না। জেলেপাড়ায় এমন কতশত ভয় তারা মাড়িয়ে চলে তার কোনো হদিস নেই।
পায়ের দিকে চোখ পড়তেই চোখ ছানাবড়া হলো তাদের। হাঁটুর নিচ থেকে কয়েকটা জোঁক আষ্টেপৃষ্টে আছে। রক্ত খেয়ে বেশ তরতাজা হয়ে ফুলে ঊঠেছে একেকটা। মুখের থুতু আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে জোঁক ছুটাতেই বেশ সময় লেগে গেলো।
স্কুলের কথা মনে পড়তেই সোনাই বলে ঊঠলো,‘সময় তো ম্যালা হল রে। আজকে আর রক্ষে নেই’। বলেই দুজন বাতাসের গতিতে রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগলো। সাঁই সাঁই করে বাতাস বইছে, সূর্যও হেলে পড়েছে। উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে, সাইকেল চালানোর মতো দুহাত সামনে বাড়িয়ে এগুচ্ছে তারা। মুখের ভ্রুম-ভ্রুম শব্দ ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে আসছে পাহাড় থেকে পাহাড়ে।

২.
প্রাণপণ ছুটতে ছুটতে সোনাই আর দিপু ক্লাসে এসে ঢুকলো পেছনের দরজা দিয়ে। ঘেমে নেয়ে একাকার দু’জন। বিকেলের রোদের তেজ সবে মাত্র কমতে শুরু করেছে। স্যারের চোখ ফাকি দিয়ে সীটে গিয়ে বসতেই হঠাত কানে বাজলো মৃদুলের চিৎকার, ‘এই যে স্যার সোনাই এসেছে’।
তার আকস্মিক চিৎকারে ক্লাসে বাজ পড়ার মতো একেবারে সব নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। কিছু ভেবে না পেয়ে সোনাই সামনের দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো স্যারের রুক্ষ চাহনি, তিনি যে কোনো কারণে রেগেমেগে আগুন তা তার চেহেরাতেই ফুটে জেতে’। পাশেই দাড়িয়ে চোখ মুছছে রোমান। অবস্থা বেগতিক দেখে সোনাই গিয়ে দাঁড়ালো স্যারের সামনে। কথা বলছে না সে। মনে মনে ভাবতে লাগলো, তাহলে কি স্যার জেনে গেলো পাহাড়ে যাওয়ার ঘটনা? এই ভয়ে সোনাইয়ের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। নিজের বুকের ধুকধুকানি নিজেই যেন শুনতে পাচ্ছে। এদিকে ক্লাসেও কোনো সাড়াশব্দ নেই কারো। আচমকা হাতে বেত নিয়ে গজগজ করতে করতে সোনাইয়ের দিকে ছুটে এলেন স্যার, কিছু বুঝে উঠার আগেই বেতের সপাং সপাং আওয়াজে ভারি হয়ে ঊঠলো ক্লাসের পরিবেশ। মারের হাত থেকে বাঁচতে সোনাই মরিয়া হয়ে বললো, ‘আমি কিছু করি নি স্যার’।
পেছন থেকে মৃদুল বলে উঠলো,‘না স্যার, আমি দেখছি রোমানের ঘড়ি পকেটে নিয়ে স্কুলের পেছনের দেয়াল টপকে যেতে’।
এ কথায় স্যার যেন আরো খেপে গেলো তার উপর, দাঁত খটমট করতে করতে বললো,‘ঘড়ি কোথায় রেখেছিস বল?’
একদিকে উপর্যুপরি মার আর অন্যদিকে ভয়ে বিহ্বল সোনাই অস্ফুট কন্ঠে বললো,‘আমি কিছুই জানি না স্যার’।
‘তোকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখছি শহরে গিয়ে আমাদের নাম উজ্জল করবি, আর তুই ঘড়ি চুরি করে বেড়াচ্ছিস’, বলেই স্যার সজোরে বেত চালাতে লাগলেন এলোপাতাড়ি। স্যারের এই বিদ্রুপ শুনে ক্লাসের অনেকে হেসে উঠলো।
স্যার সবাইকে ধমক দিয়ে বললেন,‘চুপ একদম’।
অপমান আর অপবাদে সোনাইয়ের চারপাশ যেন দুলতে শুরু করলো। চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলো সে। টলমল চোখে জানালার বাইরের দিকের পাহাড়টাকেও সে আর দেখতে পাচ্ছে না। পারছে না কিছু ভাবতে। মুহূর্তেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে। জানালার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে ধমকা হাওয়ার দল। দূর পাহাড়ে হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে, সে হাওয়া এসে লাগছে সোনাইয়ের সারা শরীর জুড়ে। তার আর কিছু মনে নেই।

৩.
সোনাইয়ের যখন জ্ঞান ফিরলো তখন ঘন রাত, রাতের গায়ে ভর করেছে এক নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতার বুক ছিড়ে বেরিয়ে আসছে জেলেপাড়ার নানা উপখ্যান। নদীতে জোয়ার হচ্ছে, বৃষ্টিও ছিলো হয়তো। ঘরের কোণে জ্বলছে ছোটো কুপি। তার আবছা আলোয় চোখ মেলে তাকালো সোনাই। বাবার মুখই প্রথমে দেখতে পেলো সে। তিনি বোধহয় কাঁদছেন। সোনাইয়ের নিদারুন কষ্ট আর অপমানও যেন তার গায়ে লেগেছে তা তার চোখে মুখে সুস্পষ্ট। মাথার শিয়রে বসে আছে হারুন, তার চারপাশ ঘিরে আছে অনেকেই। সবাইকে চেনা যাচ্ছে না। দমকা হাওয়ায় কুপিটা বেসামাল হয়ে জ্বলছে। গুমট পরিবেশে সবাই যেন সোনাইয়ের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় আছে।
চোখ খুলতেই দেখে একটা শরীর দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো, আহাজারি করে বলল, ‘আমি বুজতে পারিনি বাপ, আমারে মাফ করিস বাজান’। সোনাই বুজলো এটা রফিক স্যার। সে ইতস্ততভাবে উঠে বসার চেষ্টা করলো। কিছুদুর থেকে মতিন ডাক্তার তড়িঘড়ি করে বলল,‘উঠতে হবে না বাবা, তোমার বিশ্রাম দরকার’। ঘরের একপাশে মাথা নিচু করে বসে আছে দীপু। নিজের অপরাধবোধ আর নিরবুদ্ধিতার জন্য হয়তো সে কিছু বলতে পারছে না। ক্লাসের ঘটনাটা এত দ্রুতই হয়ে গেলো যার দোষ কোনোভাবে দিপুকে দেয়া যায় না আর সোনাই তো তাকে চেনেই।
সোনাইয়ের এখন অনেকটা ভালো লাগছে, তার উপর আজ অনেক পরিশ্রম হয়েছে পাহাড়ে গিয়ে। পিঠের অনেক জায়গায় ব্যাথা রয়ে গেছে এখনো। পাশ ফিরেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।
পরদিন ঘুম ভাঙলো মন্টুর খুনসুটিতে। সোনাইয়ের পায়ের কাছে আধশোয়া হয়ে মুখ ঘষছে সে। সোনাই আর ঘুমুতে পারে না, তার না উঠা পর্যন্ত এমনই করে যাবে সে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে পুরো ঘরময় নকশা করে রেখেছে তীব্র আলোকচ্ছটা। আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াতেই চোখ পড়ে উঠোনে, ক্লাসের কয়েকজন ছেলেসহ দাঁড়িয়ে কথা বলছে তার বাবা। ঘটনা কি হলো তা জানতেই পা বাড়াতেই দেখলো, ওরা ফিরে যাচ্ছে। হারুন হাতে জাল নিয়ে তা উঠোনে ছড়িয়ে দিতে দিতে বলল, ‘রেডি হয়ে নে, স্কুলে একটা মিটিং ডাকছে নাকি। হেডমাস্টার ডেকে পাঠালো। ‘একথা শুনে বুকটা ধক করে ঊঠলো তার। হারুন ছেলের অস্বস্তি বুঝতে পেরে বলল, ‘মিথ্যে কখনো সত্য হয় না বাপ, অপবাদ গায়ে মাখালেই তো বিপদ’। সোনাই আর কথা বাড়ায় না, বাবাকে অনুসরণ করে সামনে পা বাড়ায়। বাবার বিশ্বাসই যেনো তার সহায় সম্বল।
স্কুলের বড় মাঠ পেরোতেই সামনে পড়ে হেডমাস্টারের অফিস, বড় রকমের জটলা বেঁধেছে ভেতরটায়। ভীড় ঠেলে এগোতেই হারুনকে বসার জায়গা করে দিলো হেডমাস্টার। সোনাই এককোণায় দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। রোমানের বাবা, রফিক স্যার, মতিন ডাক্তারসহ সকলেই উপস্থিত। সবার মনে একই প্রশ্ন যে, কি হতে যাচ্ছে এখানে? হালকা গলা ঝেড়ে সবার মনোযোগ কাড়লেন রফিক স্যার। বললেন, ‘গতকাল কোনো সত্যতা যাচাই ছাড়া আর বিনা দোষে সোনাইয়ের উপর অবিচার করেছি আমি। আমি সবার ক্ষমাপ্রার্থী’। তার কথা শেষ হতে না হতেই একটা হট্টগোল শোনা গেলো। ভীড় ঠেলে ¤্রদিুলকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক, হতদন্ত হয়ে বললেন, ‘এটা গতকাল মৃদুলের ব্যাগে পেয়েছি আর আমি সব শুনেছি। এবার মৃদুলকে যা শাস্তি দিবেন, দিন। বাবা হিসেবে এতটুকুই করতে পারি’।
নিজ ঘড়ি চিনতে পেরে রোমান চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘এই তো, এটাই তো আমার ঘড়ি’।
একথা শুনে উপস্থিত সকলে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে হেডমাস্টারের পায়ের কাছে বসে পড়লো মৃদুল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘স্যার আমার ভুল হয়েছে। আমি না বুঝে এমনটা করেছি। আমাকে মাফ করে দিন স্যার’। অপ্রস্তুত হেডমাস্টার সাহেব মৃদুলকে দাড় করিয়ে বললেন, ‘আরেহ কি করছো, কি করছো…। ভুল তো মানুষই করে। ভুল যখন বুঝতেই পেরেছো তাহলে আবার শাস্তি কিসের?
হেডমাস্টারের এমন সমাধানে সকলের মাঝে যেন স্বস্তি বয়ে গেলো। পরিস্থিতি সামলে এলে হেডমাস্টার ঘোষণা দিলেন, ‘পরীক্ষা ভালো ফলাফলের সুবাদে সোনাইয়ের সকল খরচ স্কুল বহন করবে আর বিনা খরচে শহরের মিশনারীতে পড়ার সুযোগ পাবে’। এ খবরে তুমুল করতালিতে চারপাশ যেন মুখরিত হয়ে উঠলো।
এদিক ওদিক তাকাতে সোনাইয়ের চোখে পড়লো বাবার মুখ। তিনি হাত তালি দিচ্ছেন, মুখে হাসি তবে তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে আনন্দ অশ্রু।

৪.
মাস দুয়েক পর। সোনাইয়ের বাড়ির সামনে তার নাম ধরে চেচাতে লাগলো দীপু আর মৃদুল। ‘কিরে তোর হলো টা কি? মানে আজকেও তোর দেরী করা চাই। গাড়ি দাড়িয়ে আছে তো, মিস করলে বুঝবি মজা। আমরা গেলাম’, এক নিশ্বাসে সব কথা বলে হাটা দিলো মৃদুল। তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ যেন উপচে পড়ছে।
‘আসছি…আসছি…..”, বলেই হাতের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে আসলো সোনাই, পিছে হারুন এসে এটা ওটা গুছিয়ে দিতে লাগলো।
স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে মিশনারী স্কুলের বাস। তাদের স্কুল থেকে এবার সর্বোচ্চ চান্স পেয়েছে, প্রায় ২০ জন। দিপু আর সোনাইকে বিদায় দিতে এসেছে পুরো জেলেপাড়া। সব মিলিয়ে এক এলাহি কাণ্ড।
বাবাকে বিদায় দিতে গিয়ে কেঁদে ফেললো সোনাই, হারুন নির্বিকার। শান্ত গলায় বলল, যা বলেছি তা মনে আছে তো?
সোনাই বলল, ‘হুম, থাকবে’। সে আর কথা বলতে পারছে না। সে বাসে উঠতেই বাস ছেড়ে দিলো। পেছন থেকে অনেকের শোরগোল কানে আসছে। কেউ হাত নাড়িয়ে কিংবা গলা উঁচিয়ে নাম ধরে ডেকে বিদায় জানাচ্ছে। সোনাইয়ের মনে হচ্ছে আর কখনোই তার ফিরে আসা হবে না; কারণ এইবারই তার কোনো কারণে বাড়ি ছাড়া। এখন বাবার একটা কথা খুব মনে পরছে তা হল, ছেড়ে যাওয়া মানে বারবার ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি করা।
সাঁই সাঁই করে ছুটে চলছে বাস। বাস যত দ্রুত চলে ততই দ্রুত পিছে পড়ে যায় দুরের পাহাড় আর তার ভাঁজে ভাঁজে পড়ে থাকা অখ্যাত উপজাতি পাড়া। সোনাই আরেকবার জানালার বাইরে তাকানোর চেস্টা করলো। একে একে সবাই চলে যেতে লাগলো শুধু হারুন আর মন্টু দাড়িয়ে আছে ছায়ার মতো। এই দুপুরের রোদে হারুনকে আরো বৃদ্ধ লাগছে। তার গায়ে যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে সোনাইয়ের সব স্বপ্ন আর আকাঙ্খা। সোনাই আর তাকাতে পারে না। তার সামনে শুধুই ভবিষ্যৎ, তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আদর্শ মানুষের প্রতিচ্ছবিরা আর তাকে প্রেরণা দিয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ছে বাবার শপথ।

Share.

মন্তব্য করুন