রমিজের বাবা-মায়ের সংসার খুব কষ্টে চলে। রমিজ বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সংসারের অভাব-অনটনে রমিজ সহ রমিজের বাবা-মা অনাহারে থাকে প্রায়ই। রমিজের বাবা দিনমজুর। একদিন ভারী কাজ করতে গিয়ে মেরুদণ্ডে আঘাত পায় তাই রমিজের বাবা এখন তেমন বেশি কাজ করতে পারে না। অনেক কষ্টে রমিজের মা মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে দৈনিক সামান্য কিছু টাকা আয় করে। রমিজদের সংসার চলতে ভীষণ কষ্ট হয়। রমিজ পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। লেখাপড়ার দিকে তার ভীষণ ঝোঁক। রমিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতে তার বাবা-মায়ের অনেক কষ্ট হয়। রমিজ সংসারের অভাব-অনটন দেখে মনে অনেক কষ্ট পায় কিন্তু কোন উপায়তো নেই। দুই বছর পর রমিজ সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। বাবা-মায়ের তথা সংসারের চরম দুর্ভোগ আরো বেড়ে চলছে। রমিজকে দেখে এলাকার অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে। স্কুলের সহপাঠীরা রমিজকে দেখে কেউ কেউ পাগল বলে কারণ রমিজ তালি মারা পোশাক পরে। চরম দরিদ্রতার কারণে রমিজের বাবা রমিজকে পড়াশোনা বাদ দিতে বললো। পড়ালেখা বাদ দেয়ার খবর শোনে রমিজের চোখে পানি চলে আসলো। সংসারের অভাবে রমিজের বাবা রমিজকে একটি খাবার হোটেলে টাকা আয়ের জন্য ভর্তি করে দেয়। কিন্তু রমিজ চুপে চুপে ক্লাসের বইগুলো বাড়ি থেকে একটি বস্তায় ভরে সেই হোটেলে নিয়ে গেলো। হোটেলে রমিজের কাজ চলতে থাকে আর মাস গেলে হোটেলের মালিক কিছু টাকা দেয়। এ টাকা রমিজ তার বাবা-মাকে পাঠিয়ে দেয়। টাকা পেয়ে রমিজের বাবা চাল কিনে আর হালকা বাজার করে। কখনো কখনো বাজার না করে ঔষধ ক্রয় করে। মাঝে মাঝে রমিজ বাড়িতে এসে অসহায় বাবা-মাকে দেখে যায়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে রমিজ বই পড়ে। হোটেলের মালিক অনেক সময় রমিজকে পড়াশোনা করতে দেখে ভীষণ বকা দেয়। তবুও রমিজ পালিয়ে পালিয়ে বই পড়ে। রাতে ঘুমানোর সময় পেয়ে না ঘুমিয়ে রাত জেগে জেগে বই পড়ে। পরীক্ষার সময় এলে হোটেল থেকে ছুটি নিয়ে স্কুলে এসে পরীক্ষা দেয়। রেজাল্ট রমিজের খুব ভালো হয়। রমিজের বাবা-মা যদিও অর্থের অভাবে রমিজকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে হোটেলে পাঠায় কিন্তু এখন ছেলের রেজাল্ট দেখে খুব খুশি। ক্লাসের পরীক্ষায় রমিজ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলে বিদ্যালয়ের সব ছেলে-মেয়েরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আলোচনা চলতে থাকে সবার ঘরে ঘরে। রমিজের বাবা-মা কী কষ্ট করে সংসারে। ওদের ভালো ঘর-বাড়ি নেই। ঘর থেকে পানি পড়ে বৃষ্টিতে। খেতে পারে না, অনাহারে থাকে। রমিজ হোটেলে কাজ করে খায় কিন্তু রমিজ কিভাবে এতো ভালো রেজাল্ট করে? সবার চোখ বড় হয়ে গেলো। পরীক্ষা দিয়ে রমিজ আবারও সেই হোটেলে কাজ করতে চলে যায়। স্কুলে বই উৎসবে রমিজ উপস্থিত থাকতে পারে না হোটেলের কাজের চাপে। রমিজের বাবা স্কুলে উপস্থিত থেকে বই গ্রহণ করে রমিজকে হোটেলে বই পাঠিয়ে দেয়। এভাবে রমিজের জীবন চলতে থাকে, পড়ালেখাও চলতে থাকে। পরবর্তী ক্লাসগুলোতে রমিজ সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হতে থাকে। তিন বছর পরের কথা। রমিজ এস.এস.সি পরীক্ষা দিবে। হোটেলে কাজের চাপে রমিজের চেহারায় কষ্টের ছাপ দেখা যায়। তবুও রমিজ হাল ছাড়েনি। নিজের গোছানো টাকা দিয়ে ক্লাসের বিভিন্ন বই কিনে হোটেলের এক রুমে সেগুলো পড়তে থাকে আর রাতে হোটেল মালিকের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজের টাকা দিয়ে কেনা টর্চ লাইটের আলোতে পালিয়ে পালিয়ে কষ্ট করে বই পড়ে। শোধুমাত্র পরীক্ষার সময় হোটেলের মালিকের কাছ থেকে বাড়িতে মা-বাবার সাথে দেখা করার কথা বলে ছুটি নিয়ে পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষা শেষে আবার কাজে যোগ দেয়। এভাবে রমিজ এস.এস.সি পরীক্ষায় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণ করে। এস.এস.সি রেজাল্ট বের হলে দেখা যায় এলাকার মধ্যে রমিজই সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে। সবাইতো হতবাক, আশ্চর্য। যারা রমিজকে বিদ্রুপ করেছে তারা এখন কী করবে? সবাই দিশেহারা। কী হয়ে গেলো? গরিব সংসারে বেড়ে ওঠা রমিজ কিভাবে এত ভালো রেজাল্ট করলো? মূলত সব-ই রমিজের কষ্ট-সাধনার ফল। হোটেলের মালিকের কানে রমিজের এ কথা পৌঁছলে সেও অবাক হয়। হোটেল মালিক বললো, আর পড়াশোনার দরকার নেই। লেখাপড়ায় অযথা সময় ব্যয় না করে আমার হোটেলে রমিজ তুমি অধিক মনোযোগী হও। দরকার হয় তোমাকে বেশি বেতন দিবো। কে শোনে হোটেল মালিকের কথা? রমিজ এইচএসসি ভর্তি হয়ে যায়। না খেয়ে টাকা জমিয়ে জমিয়ে বই ক্রয় করে। রমিজ আগের মত রাতে ঘুমানোর নাম করে পালিয়ে পালিয়ে রাত জেগে জেগে হোটেল মালিকের চক্ষুর আড়ালে পড়াশোনা করে। সকাল হলে আবার কাজ শোরু করে বিরামহীনভাবে একেবারে রাত দশটা পর্যন্ত। এভাবে সফলতার সাথে রমিজ এইচ.এস.সি পাস করে। খবর শোনে হোটেলের মালিক হোটেল থেকে রমিজকে বের করে দিলো। হিংসায় হোটেল মালিকতো রেগেমেগে আগুন। ভাবতে লাগলো কিভাবে একজন দিনমজুরের ছেলে রমিজ এতো ভালো রেজাল্ট করে? কিভাবে এইচ.এস.সি পাস করে? রমিজ হোটেল ত্যাগ করে একটি বিস্কুট কোম্পানিতে টাকা আয়ের জন্য ভর্তি হলো। নিজের গোছানো টাকা দিয়ে সরকারি চাকরি প্রাপ্তির আশায় বিভিন্ন বই কিনে তা পড়তে থাকে। এরই মাঝে ভাগ্যক্রমে রমিজ দেশের নামীদামি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ভর্তির সুযোগ লাভ করে। রমিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন কেবলমাত্র শোরু। অনার্স পড়াশোনার পাশাপাশি চলতে থাকে সরকারি চাকরি পাওয়ার সাধনা আর গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার স্বপ্ন। বিস্কুট কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত টাকা তার মা-বাবাকে পাঠিয়ে দেয় আর কিছুটা নিজের পড়ালেখার জন্য রেখে দেয়। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধাপে ধাপে অনার্স ও মাস্টার্স- এ কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। রমিজের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের খবর শোনে বাবা-মা কেঁদে দিলেন। এ হলো সফলতার কান্না। পরীক্ষায় এমন রেজাল্ট শোনে এলাকায় রমিজের সহপাঠী ও বন্ধুরা কেউ কেউ হিংসার আগুনে জ্বলছে। কী থেকে কী হয়ে গেলো? রমিজ কিভাবে এসব অর্জন করতে পারলো? রমিজের ডিগ্রি অর্জনের খবর শোনে এলাকার মেম্বার ও চেয়ারম্যান অনেক আর্থিক অনুদান দিলো। এসব টাকা রমিজ মোটেও বাজে খরচ না করে সরকারি চাকরি প্রাপ্তির জন্য বিভিন্ন বই কিনলো। ভালো চাকরি নিতে হবে এই আশা তার মনে। বাবা- মায়ের মুখে হাসি ফোটাতেই হবে এ স্বপ্ন রমিজের। এজন্য সে রাত-দিন বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে থাকে । পত্রিকা পড়ে। সাধারণ জ্ঞানের বই পড়ে। চাকরি পেতেই হবে এজন্য সে বইয়ের উপর লেগেই থাকে। বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে রমিজ তাতে আবেদন করে। রমিজ বিস্কুট কোম্পানির কাজ থেকে অব্যাহতি নেয়। বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছে চলে গেলো । নিজ এলাকায় কয়েকটি টিউশনি করিয়ে বাবা-মাকে সংসারে সহায়তা করে আর নিজের খরচ চালায়। বিসিএস পরীক্ষার দিন পরীক্ষা কেন্দ্রে রমিজ আশা ভরা মন নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। রমিজ পালাক্রমে বিসিএস পরীক্ষার প্রথম ধাপ প্রিলিমিনারি ও দ্বিতীয় ধাপ লিখিত পরীক্ষায়ও টিকে যায়। পরে তৃতীয় পর্ব মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করে। দীর্ঘ বিরতির পর রেজাল্ট প্রকাশ হলে রমিজ মোবাইলে এসএমএস দেখল, সে বিসিএস প্রশাসনিক ক্যাডারে সফলতা অর্জন করে।
মোবাইলে এসএমএস দেখে রমিজতো বিশ্বাসই করতে পারছিল না। খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে সবাইতো আশ্চর্য। বাবা-মায়ের মুখে শুধু হাসি আর হাসি। কয়েক মাস পর রমিজ ডাকযোগে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করার চিঠি পায়। বাবা-মাকে সাথে নিয়ে রমিজ সরকারি চাকরিতে যোগদান করে। রমিজের চাকরি চলতে থাকে। কয়েক বছর পর পদোন্নতি পেয়ে আরো বড় কর্মকর্তা হয়। রমিজ ঢাকায় বড় নামীদামি জায়গায় প্লট কিনে বসতি স্থাপন করে। অমূল্য সম্পদ মা-বাবাকে সেখানে নিয়ে যায়। মা-বাবাকে রমিজ বললো, আর তোমাদের কোনো কষ্ট করতে হবে না। রমিজ বাজারের দামি মাছটি কিনে মা-বাবার জন্য নিয়ে আসে। রমিজের জন্মস্থান যেখানে অর্থাৎ যেখানে রমিজের শৈশব কেটেছে, রমিজ সেখানে একটি পোশাক ফ্যাক্টরি তৈরি করে। এলাকার বেকার ছেলেদের সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। এলাকায় যারাই রমিজকে হিংসা ও বিদ্রুপ করতো, অবহেলা করতো আজ তারাই রমিজের পোশাক ফ্যাক্টরিতে কাজ করে টাকা আয় করছে। রমিজকে এখন তারা খুব ভক্তি করে আর পিছনের কথাগুলো মনে করে নিজেরা অনেক ব্যথিত হয়। রমিজের সেই বাল্যকালের বন্ধুরা একে অপরকে বলাবলি করতে লাগলো, আসলেই আমরা ভুল করেছি, অন্যায় করেছি রমিজের সাথে। রমিজকে দেখে কতইনা বিদ্রƒপ করেছি আমরা। আমরা কত ভালো পোশাক পরতাম, ভালো খাওয়া-দাওয়া করতাম। অতিরিক্ত আরাম- আয়েশের কারণে বেশিদূর যেতে পারি নাই আর রমিজ তালিমারা পোশাক পরে অনাহারে থেকে হোটেলে কাজ করে এখন বড় মাপের সরকারি কর্মকর্তা। এলাকার সবার মুখে গরিব রমিজ এখন বড় সাহেব নামে পরিচিত।

Share.

মন্তব্য করুন