তিন বছর বয়সে চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলাম আমি। এসেছিলাম বাবা-মা বোনদের সাথে সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে। বাবা রেলওয়েতে চাকরী করতেন বিধায় তাঁর একটি কোয়াটার ছিল চাইগারপাস এলাকায়, সেখানেই ছিলাম আমরা। সেই ১৯৯৭ সাল থেকে।
চট্টগ্রাম দারুণ সুন্দর একটি শহর। তখন আরও সুন্দর ছিল। বিশেষ করে রেলওয়ে এলাকাটা ছিল দারুণ সুন্দর। ছিমছাম, গোছানো একটি এলাকা। চট্টগ্রামের উত্তরটা পাহাড়ঘেরা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, মাঝে প্রচুর ছোট-বড়-মাঝারী টিলা আর সমতলের সমাহার। রয়েছে খরস্রোতা নদী কর্ণফুলি। আর রয়েছে বারো আওলিয়ার মাজার শরীফ। হযরত বায়েজিদ বোস্তামির মাজার শরীফও রয়েছে, রয়েছে হযরত শেখ ফরিদের চশমা। এটি একটি উষ্ণ প্রস্রবন, যা থেকে বারো মাস সমান গতিতে পানি প্রবাহিত হয়, এবং জনগণের বিশ্বাস- এই পানি পানে নানান অসুখ-বিসুখ থেকে নিরাময় লাভ করা যায়।
চট্টগ্রাম গর্বিত মাস্টার দা সূর্যসেনের জন্মভূমি এবং বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রভূমি বলে। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কথা কে না জানে, এই চট্টলার বীর কন্যা ছিলেন তিনি। আরও কত কত কারণে চট্টগ্রাম বিখ্যাত হয়ে রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কারে ভূষিত ব্যক্তি মোহাম্মদ ইউনুসও এই চট্টলার সন্তান। আমিও গর্বিত যে তিনি যে স্কুলের ছাত্র ছিলেন, সেই চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলাম আমিও।
উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের যেমন ঋদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, তেমনি ঐতিহ্য রয়েছে সংস্কৃতি চর্চায়। এখানে গান-বাজনা, নাটক, নৃত্যকলার ব্যাপক চর্চা হতো সেই পুরোনো আমল থেকে। সঙ্গীত পরিষদ এবং আর্যসঙ্গীত প্রতিষ্ঠান দুটো এক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। এখনও রাখছে।
আর ওই যে রেলওয়ের কথা বলছিলাম- এখানে ছিল আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার। সি. আর. বিল্ডিং এখনও রয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। রেল কোম্পানি তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসস্থানের যেমন সুন্দর ব্যবস্থা করেছিল, তেমনি ব্যবস্থা করে দিয়েছিল খেলাধুলা এবং সংস্কৃতি চর্চার। খেলার জন্য চট্টগ্রামে ছিল (এখনো আছে) পলোগ্রাউন্ড। আর সংস্কৃতি চর্চার জন্য কর্মকর্তাদের অফিসার্স ক্লাব-কর্মচারীদের ওয়াজিউল্লাহ ইন্সিটিটিউট। এই ইন্সটিটিউটটি নানান দিক দিয়ে সমৃদ্ধ ছিল। এখানে বেশ ঋদ্ধ একটি পাঠাগার ছিল। বিলিয়ার্ড টেবিল ছিল, ছিল গান-বাজনার সকল রকম সুবিধা; নাটক ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য চমৎকার একটি মিলনায়তনও ছিল সেখানে।

আমার আব্বা মোহাম্মদ আব্দুস সালাম রেলওয়ের হেডকোয়াটারে সেকশন সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে চাকুরীরত ছিলেন- আমি সেই আমার শৈশবের কথা বলছি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আব্বাকে দেখেছি ওই ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটের অর্থাৎ কর্মচারীদের ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। এবং রিয়াটারমেন্ট পর্যন্ত (১৯৬৮) সাধারণ সম্পাদকের পদেই আসীন ছিলেন তিনি।
চট্টগ্রামের সংস্কৃতি চর্চার কথা আগেই বলছি। এই ক্লাবটি ছিল অন্যতম প্রধান চর্চাকেন্দ্র- চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক জগতের একটি পীঠস্থান। এখানে প্রতিমাসে নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হতো, আমার মনে পড়ে। আব্বা নাটক খুব পছন্দ করতেন। নিজে অভিনয় না করলেও তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় নাটকগুলো নিয়মিত মঞ্চায়ন হতো। নামকরা অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন- সর্বজনাব আব্দুল জব্বার, সিকদার সাদেক নবী ও তাঁর স্ত্রী, ডা. বারী, টি এইচ ভূইয়া, মতিউর রহমান প্রমুখ। আর সবচেয়ে বিখ্যাত যে ব্যক্তিটি তখন দাপিয়ে বেড়াতেন তিনি ছিলেন যাত্রাসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস।
আমার মা শামসুন্নাহার বেগমেরও খুব প্রিয় ছিল নাটক দেখাটা। প্রতিটি নাটকই তিনি দেখতেন। আর বাবা মায়ের একমাত্র পুত্র হিসেবে আমি মায়ের আঁচল ধরে গিয়ে হাজির হতাম ইন্সটিটিউটের মিলনায়তনে। অসংখ্য নাটক আমি দেখেছি এই মঞ্চে সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে। তখন সব সামাজিক নাটক মঞ্চস্থ হতো- বেশির ভাগই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প থেকে, কখনো বিধায়ক ভট্টাচার্যের নাটক, আবার কখনো নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের আর নীহার রঞ্জন গুপ্তের তো বটেই। এসকল নাটকের প্রায় সবটাতেই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতেন এক অনন্য নাট্য ব্যক্তিত্ব অমলেন্দু বিশ্বাস। তিনি চাকরী করতেন পোর্ট রেলওয়েতে। রেল এবং পোর্ট তখন একসাথে ছিল। তাই তিনি নিয়মিত ছিলেন এই মঞ্চে।
আমি সেই ছোটবেলা থেকেই বুঝি আর না বুঝি, মুগ্ধ হয়ে গিলতাম এই ব্যক্তিটির অভিনয়। যেমন সুন্দর দেহসৌষ্ঠব, তেমনি চেহারা। কণ্ঠের বলিষ্ঠতা তো সব কিছুকে ছাড়িয়ে যেত। অভিনয় তো তুলনাহীন- আর উচ্চারণ অসাধারণ। চট্টগ্রামের মানুষ অথচ বিশুদ্ধ প্রমিত বাংলায় অভিনয় এবং আবৃত্তি করতেন তিনি। আমার সেই বয়সেই মনে হতো ওঁর মত অভিনয় করতে পারতাম যদি! মঞ্চে উঠলেই করতালিতে মুখরিত হতো মিলনায়তন। সেই করতালি আজও অনুরণিত হয় আমার কর্ণকুহরে।
সেই সময় আমার ছিল একজন জানের দোস্ত। মিন্টুু তার নাম। আমি রবি। আমাদের ভাব সবার মুখে মুখে ছিল পাড়ায়। মানিকজোড় বলে খ্যাত ছিলাম আমরা। এই মিন্টু আর কেউ নয়, আমাদের জামালুদ্দিন হোসেন। ওর বাসা ছিল আমাদের পাড়াতেই, ঠিক আমাদের বাসার পেছনটায় একটু উঁচু স্থানে। ওর বাবা সিদ্দিক হোসেন সাহেব মাঝেমধ্যে অভিনয় করতেন তখন। সেই সূত্রে মিন্টুরও অভিনয়ের প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল। আর আমি অমলেন্দু বিশ^াসে মোহিত, অনুপ্রাণিত কিছু একটা করার জন্য। বয়স তখন আমাদের দশের কোটায়। ভীষণভাবে আমরা আলোড়িত নাটক নিয়ে। কীভাবে নাটক করা যায়। অর্থাৎ মঞ্চে অভিনয় করতে পারি কীভাবে। ঘটনাক্রমে এসময়ে আমার এক মামা, জনাব মাহবুব হাফিজ ঢাকা থেকে কাস্টমস এর প্রিভিন্টিভ অফিসারের চাকরী নিয়ে চট্টগ্রাম আসেন এবং আমাদের বাসাতেই থাকতেন। তিনিও নাটকের ব্যাপারে ছিলেন বেশ উৎসাহী। আমি আব্বাকে যে ইচ্ছায় কথাটা প্রকাশ করতে ছিলাম অপারগ, সেটা বললাম মামাকে- অভিনয় করবো নাটকে।

তোমরা কর, আমি ডাইরেকশন দেব।
মামার উৎসাহ ছিল আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তিনিই নাটক চূড়ান্ত করলেন- ছোটদের টিপু সুলতান। শুরু হল আমাদের মহড়া। মামা বেশ যাত্রা ঢঙে আমাদের শেখাতেন- কতটা আমরা নিতে পেরেছি তা আজ আর বলতে পারবো না।
বাড়িতে খবর হয়ে গেল, আমরা মঞ্চ তৈরি করে নাটক করবো। সেটা পাড়াতেও প্রচার হতে দেরী হলো না। সবাই অপেক্ষায়- পুঁচকেরা কী নাটক করে দেখবে তারা। এমনিতে রেল কলোনীর বাসিন্দারা ক্লাবের সদস্য হিসেবে নিয়মিত নাট্য-দর্শক। সুতরাং তাদের উৎসাহ হওয়াটা স্বাভাবিকই।
প্রথমে পার্ট নিয়ে একটু টানাহ্যাঁচড়া চললো। আমি বলি- মিন্টু তুই টিপু কর, মিন্টুু বলে তুই কর। শেষ পর্যন্ত মামাই সমাধান করলেন- মিন্টু বেশ লম্বাটম্বা আছে- ওই করুক টিপু।
ব্যাস শুরু হয়ে গেল মহড়া। আরও কয়েকজন জুটিয়ে ফেললাম আমরা অন্যান্য চরিত্রের জন্যে। মামা বেশ কায়দা করে আমাদের শেখাতে লাগলেন। যাতে তাঁর বদনাম না হয়। ভীষণ সিরিয়াস তিনি তখন।
আব্বাকে কিছুই বলিনি, আম্মার কাছে যদি শুনেও থাকেন তিনিও উচ্চবাচ্য করেননি এ নিয়ে। কারণ নাটক তাঁর খুব পছন্দের বিষয় ছিল, আগেই বলেছি।
যতই মঞ্চয়নের দিন আসতে লাগলো, আমাদেরও দুরু দুুরু করতে লাগলো বুক। প্রয়োজনীয় পোশাক আর প্রপস্ (প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম) জোগাড় চলতে লাগলো- সবই মামার নির্দেশনায়। পাজামা, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, কোট, মালা, টুপি- তলোয়ার ছিল পিচবোর্ডের উপর রঙ করা। জুতোর ওপর কাল কাগজ মুড়ে একধরনের রাজকীয় ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করার প্রয়াস পেয়েছিলাম আমরা।

এলো মঞ্চায়নের দিন। মঞ্চ হবে আমার বাড়ির পাশে খালি জায়গাটাতে। আমাদের কোয়াটারগুলো বানানো হয়েছিল খুবই সুন্দর ডিজাইনে, দুটো কোয়াটারের মাঝে বেশ অনেকটা খালি জায়গা, সেখানে আগর-আম-জাম-কাঁঠালের গাছ।
ফলের মৌসুমে আমাদের কি যে আনন্দ হতো গাছের ফল পেড়ে খেতে। তো, সেই গাছের তলায় আমাদের জানালার পাশে বাঁধা হলো স্টেজ। চৌকি দিয়ে। মামার চৌকিটা নিলাম প্রথমেই, আমাদের কাজের ছেলেটাও নেয়া হলো। মিন্টুও এনে দিয়েছিল একটা চৌকি। চৌকি পেতে তার ওপর বিছানো হয়েছিলো সতরঞ্চি। আম্মার কাছ থেকে আবদার করে বের করে আনা হয়েছিল এগুলো। আরও আছে- কয়েকটা শাড়ি এনে মঞ্চের পাশের উইংস তৈরি করা হয়েছিল চমৎকার করে। সামনের পর্দাটা হলো বিছানার চাদর দিয়ে। সেটা তারে সেফটিপিন দিয়ে দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। দুই মাথায় দুটো দড়ি বেঁধে রাখা হলো একপাশে। পর্দা খোলা এবং বন্ধ করার জন্যে। আর বাড়ির চেয়ার-টেবিল ওগুলো তো এলোই, সে কথা আর বলবো কি! আম্মার অনেক বকুনি খেয়েছি কিন্তু বুঝেছি, তার পেছনে ছিল প্রশ্রয় এবং আশ্রয়। এই হলো মা। বাপ দূরে দূরেই থাকলেন- নাটকটা দেখেনওনি- বোধহয় আমি লজ্জা পাবো সেই ভেবে।
বাড়ি থেকে লম্বা তার টেনে এনে ইলেকট্রিক আলোর ব্যবস্থা করা হলো মঞ্চে এবং দর্শকের বসার স্থানে। সঙ্গীতটঙ্গিত তো নেই- কোথায় পাবো তখন এসব! চিৎকার করে করে সব ঘোষণা হয়েছিল- মামা ছিলেন একাই একশ। তাঁর ব্যস্ততা দেখে সবাই নিশ্চয় ভেবেছিল কী বিশাল এক যজ্ঞ হতে চলেছে। কে যেন একটা হারমোনিয়াম এনেছিল জোগাড় করে, সেটাও মাঝে মধ্যে প্যাঁ-পোঁ করে বাজিয়ে সাড়া ফেলা হলো এলাকায়।
কী অভিনয় করেছি না করেছি জানি না। নাটক হলো। আমাদের রেল কলোনীর অনেক খালা-চাচীরা এলেন বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে- কারণ তাঁরা দু’পয়সা চার পয়সা চাঁদা দিয়েছিলেন। আব্বার কিছুু সহকর্মী প্রতিবেশীও এলেন মজা দেখতে। আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধব এলো আমরা কেমন বাজে অনুষ্ঠান করি তা সচক্ষে দেখতে। কারণ ওই নাটক মঞ্চয়নের কারণে আমরা হয়ে গিয়েছিলাম অনেকের হিংসার পাত্র। সে অবশ্য কিছুকালের জন্য মাত্র।
নাটক শেষে রাতে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম- কেমন হয়েছে আমার অভিনয়। মা কি খারাপ বলতে পারেন। তিনি খুশি আমার অভিনয়ে সেটাই বললেন।
পরদিন রাতে বাসায় ফিরে আব্বা আম্মাকে বলছিলেন, শুনলাম।
‘তোমার ছেলের অভিনয় কেমন হয়েছে?’
‘খুব সুন্দর। আম্মার অভিব্যক্তি।’
‘নিচের কোয়ার্টারের হোসেন সাহেব বসছিলেন- রবির অভিনয় নাকি অভিনয়ই মনে হয়নি।’

একথা শুনে মন খুব খারাপ হয়েছিল আমার। দমে গিয়েছিলাম মনে মনে। কিন্তু ছাড়িনি অভিনয়। ক্লাস টেনে উঠে খোদ ওয়াজিউল্লাহ মঞ্চে অভিনয় করলাম- তারপর কলেজে- এরপর বুয়েটে এসে ঢাকায়- তারপর কত কত ব্যানারে। থিয়েটার গ্রুপ নাগরিকের আমি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্রমে টেলিভিশন, রেডিও, চলচ্চিত্রে- কতকিছু।
গ্রুপ থিয়েটার করতে এসে ওয়ার্কশপ-সেমিনারের মাধ্যমে পরিচিত হলাম বিশে^র কিছু বিখ্যাত নাট্যতত্ত্ববিদের বিষয়ে। জানলাম অভিনয় কী। মানে মোটামুটি একটা ধারণা হলো অভিনয় সম্বন্ধে।
তাঁদের সবারই বক্তব্যের মূল কথা হলো- `To Act is not to act” অর্থাৎ অভিনয় না করাটাই অভিনয়। এ তথ্য জেনে মনে পেলাম শান্তি ও স্বস্তি এবং তখন থেকে এ ধারণাটাই হৃদয়ে ধারন করে রাখার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
শুরুর কথা বলা হল, শেষ কতদূরে যাবে তা অজানা এখনো।

Share.

মন্তব্য করুন