তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বর্তমান বিশে^র সবচেয়ে আলোচিত ও প্রভাবশালী মুসলিম নেতা। তিনি তার সুদৃঢ় নেতৃত্বে তুরস্ককে যেমন বিশ^ দরবারে সম্মান ও মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে নিজের অবস্থানও সংহত করেছেন। এজন্যই এরদোগানের সমর্থকরা তুরস্ককে অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে তুলনা করে তাকে ‘সুলতান’ নামে অভিহিত করে থাকে। এরদোগানের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির পরিবর্তে ইসলামি ভাবধারার রাজনীতি চালু করা। এজন্য তাকে অনেক প্রতিকূলতা পার পার হতে হয়েছে। তার নিরলস চেষ্টায় তুরস্কে আজ ইসলামি রাজনীতির পুনর্জাগরণ ঘটেছে।

এরদোগান যে একজন ক্যারিসমেটিক বা সম্মোহনী শক্তি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ ও নেতা তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তার প্রতি মানুষের নি:স্বার্থ সমর্থন ও ভালোবাসার কারনেই ২০১৬ সালে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করলে তার আহবানে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। তারা খালি হাতে ট্যাঙ্কের সামনে দাড়িয়ে নিজেদের বুক পেতে দিয়েছিল। এরদোগানের সমর্থকদের এই সাহসিকতার জন্যই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল।

এরদোগান ১৯৫৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের বিখ্যাত নগরী ইস্তাম্বুলের কাছিমপাশা শহরতলীতে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা আহমদ এরদোগান পেশায় ছিলেন দেশটির কোষ্ট গার্ডের জাহাজের ক্যাপ্টেন। এরদোয়ানের মায়ের নাম তানজিলে হানিম। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে এরদোগান ছিলেন তৃতীয়।
ইস্তাম্বুলের পিয়ালেপাশা শহরতলীর এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এরদোগানের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ১৯৬৫ সালে এই বিদ্যালয়ের লেখাপড়া সমাপ্ত করে তিনি ইমাম হাতিব স্কুলে ভর্তি হন। এখান থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করে এরদোয়ান আয়্যুব কলেজে ভর্তি হন। এরপর ১৯৭৩ সালে তিনি ব্যবসায় শিক্ষা ও অর্থনীতি ইন্সটিটিউটে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে এই ইন্সটিটিউটে লেখাপড়া শেষ করে মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৮১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

হাইস্কুলে পড়ার সময় এরদোগান পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে রাস্তায় রুটি ও শরবত বিক্রি করতেন। এখান থেকে লাভ যে হতো তার একাংশ দিয়ে তিনি স্কুলের বেতন পরিশোধ করতেন। এভাবেই তিনি নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেই চালাতেন। এছাড়াও এরদোয়ান একজন ভালো ফুটবলারও ছিলেন। ১৪ বছর বয়সে তিনি কাছিমপাশা জামিয়ালতি ক্রীড়া ক্লাবে যোগ দেন। এই ক্লাবে ৭ বছর খেলার পর তিনি ইস্তাম্বুলের আইইটিটি ফুটবল ক্লাবে একজন পেশাদার ফুটবলার হিসেবে যোগ দেন। এক সময় তিনি এই ক্লাবের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

পরবর্তীতে তিনি জাতীয় যুব ফুটবল টিমেও সুযোগ পান। কিন্তু পারিবারিক বিরোধিতার কারণে তিনি ফুটবল খেলা ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯৭৮ সালে এরদোয়ান বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর নাম এমিনি এরদোয়ান। তাদের চার সন্তানের নাম আহমেত বুরাক, নেকমেতিন বিলাল, এসারেফ ও সামিয়ে।
এরদোগান ২০১৪ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ২০০৩ সাল থেকে তিনি টানা ১১ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন প্রেসিডেন্ট পদটি ছিল আনুষ্ঠানিক। প্রেসিডেন্টের হাতে কোন ক্ষমতা ছিলনা। কিন্তু ২০১৪ সালে জনগণের সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বা প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর এই নির্বাচনে বিজয়ী হন এরদোগান। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করেন তিনি। ২০২৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এরদোগান। ধারণা করা হচ্ছে যে, তিনি আবারও বিজয়ী হবেন।

আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল পাশার পর এরদোগানই হচ্ছেন দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান নেতা যিনি দীর্ঘদিন ধরে তুরস্ক শাসন করছেন। কামাল পাশার পর তিনিই তুরস্কে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষ করে তুরস্কের সেনাবাহিনী ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারি ছিল। তারা ১৯৬০ এর দশক থেকে চারবার ক্ষমতা দখল করেছে। কিন্তু এরদোগান সেনাবাহিনীকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু তা সত্বেও ২০১৬ সালে বিদেশি সহযোগিতায় সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করলে এরদোগান জনগণের সমর্থনে তা নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হন। এতে তার ক্ষমতার ভিত্তি আরো সংহত হয়েছে।
একেপি গঠন করার আগে এরদোগান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। এসব দলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টি। ছাত্রাবস্থায় তিনি এই দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। এরপর তিনি দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দিন আরবাকানের নেতৃত্বাধীন ওয়েলফেয়ার পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এরদোগান এই দলের সাথে জড়িত ছিলেন। এই দলে থাকার সময়েই তিনি তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর ১৯৯৮ সালেই তিনি ভার্চু পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে ভার্চু পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এরদোগান ১৯৯৯ সালে সামরিক আইন অমান্য করে জনসম্মুখে একটি কবিতা পাঠ করেন। কবিতাটি ছিল এরকম- ‘মসজিদ হচ্ছে আমাদের ব্যারাক, গম্বুজ হচ্ছে আমাদের হেলমেট এবং মিনার হচ্ছে আমাদের বেয়নেট।’

এই কবিতা পাঠ করার কারণে সামরিক সরকার তাকে চার মাসের কারাদন্ড প্রদান করে। কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর এরদোগান একটি রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা নেন। এরপর ২০০১ সালে তিনি আব্দুল্লাহ গুলকে সাথে নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) গঠন করেন। তিনি এই দলের প্রধান। দলটি রক্ষণশীল ইসলামি মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়ে আসছে।
প্রতিষ্ঠার অল্প দিনের মধ্যেই একেপি জনগণের বিপুল সমর্থনের মাধ্যমে এক নম্বর অবস্থানে চলে আসে। ২০০২ সালের নির্বাচনে একেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। তুরস্কের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন পর কোন রাজনৈতিক দল এককভাবে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। এরপর টানা তিনটি পার্লামেন্ট নির্বাচনে একেপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছে যা বর্তমান সময়ে তুরস্কে একটি রেকর্ড। এটা সম্ভব হয়েছে এরদোগানের বিপুল জনপ্রিয়তা ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের কারণে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্টের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করে রাজধানী আঙ্কারায় একটি প্রাসাদ নির্মান করেছেন এরদোয়ান। এক হাজার কক্ষ বিশিষ্ট এই প্রাসাদের নামকরণ করা হয়েছে হোয়াইট প্যালেস। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দফতর হোয়াইট হাউস কিংবা রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের দফতর ক্রেমলিনের চেয়ে এটি বড়। বিশাল এই প্রাসাদ নির্মান করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। বর্তমানে তুরস্ক আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেও এত বিপুল অর্থ ব্যয়ে এতো বড় প্রাসাদ নির্মান করায় বিরোধিরা এরদোগানের সমালোচনা করতে ছাড়ছেন না।
কিন্তু এরদোগান কেবল প্রাসাদই নির্মান করেননি। তিনি তুরস্কের প্রাচীন নগরী ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক আয়া সোফিয়া জাদুঘরকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরিত করেছেন। ২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট এরদোগান এটিকে মসজিদ বানানোর নির্বাহী আদেশে সই করেন। এরপর নতুনপ্রাণ পাওয়া মসজিদটিতে ৮৬ বছর পরে ফের আজান দেয়া হয়েছে। বিপুল সংখ্যক মুসল্লি এখন এই মসজিদে নামাজ আদায় করছেন।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আয়া সোফিয়ার ইতিহাস নানাভাবে আবর্তিত হয়েছে। ৩৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন রোমান সম্রাট কনস্টান্টিনোপল। ভবনটির বর্তমান কাঠামো তৈরি করেন সম্রাট জাস্টিনিয়ান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৪৫৩ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত খ্রিস্টানদের ধর্মীয় স্থাপনা হিসেবেই বহাল ছিল আয়া সোফিয়া।
১৪৫৩ সালের মে মাসে ঐতিহাসিক এক যুদ্ধে ইস্তাম্বুল জয় করেন উসমানিয়া খলিফা সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ। ঐতিহাসিক সূত্রের বরাতে আলজাজিরা জানায়, সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ ইস্তাম্বুল জয় করার পর যাজকদের কাছে আয়া সোফিয়া বিক্রি করার আবেদন জানান এবং যাজকরা রাজী হলে নিজের টাকায় গির্জাটি কিনে মসজিদের রুপান্তরিত করেন।

কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্কে উসমানীয় খেলাফতের অবসান হয়। নতুন রাষ্ট্র তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল পাশা তুরস্ককে আধুনিক বানানোর জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করেন। তার এই নীতির কোপ কেবল ইসলামি চিহ্নকে বিলুপ্ত করার মধ্যেই সচেষ্ট ছিল। প্রায় পাঁচশ বছর ধরে মসজিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত স্থাপনা আয়া সোফিয়াকে তিনি ১৯৩৫ সালে জাদুঘরে পরিণত করেন। তার শাসনামলে ও পরে তার অনুসারিদের সময়ে তুরস্কের অন্যান্য ইসলামি চিহ্নও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়।

কিন্তু কামাল পাশা পন্থীদের বহু বছরের চেষ্টার পরও তুরস্ক থেকে ইসলামি চিহ্ন মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। এক সময় তুরস্কে ক্ষমতায় আসেন ইসলামপন্থি নাজমুদ্দিন আরবাকান। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। তবে সেটি ছিল স্বল্প সময়ের জন্য। অচিরেই আরো ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন তারই অনুসারি এরদোগান। শেষ পর্যন্ত তার সময়েই আয়া সোফিয়া আবারও মসজিদে রুপান্তরিত হলো। এটি এরদোগনের বিরাট এক অবদান। তিনি তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ইসলামি ভাবধারার রাজনীতির ধারা চালু ও তা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এটিই হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় সাফল্য।

Share.

মন্তব্য করুন