হাত থেকে হঠাৎ টেস্টটিউবটা পড়ে গেল পাকা মেঝেতে। পড়ে গেল ডেটল ভরা ড্রপারটা। শব্দ শুনে মা ছুটে এলেন পাশের ঘর থেকে। দেখলেন কেউ কোথাও নেই। শুধু টেবিলের নিচে টিমটিম করে জ্বলছে-স্পিরিট-ল্যাম্পটা। মা বুঝলেন এ কাজ কার! কিন্তু কর্তা উধাও!
: বাবলা-গলা বাড়িয়ে মা ডাকলেন বার কয়েক কিন্তু কোথায় বাবলা-হঠাৎ দোতালার সিঁড়ি দিয়ে ছুটতে ছুটতে নেমে এলো পুষি বেড়ালটা। গোঁফ নেই-।
একটু আগেও ছিল…। ওপর তলার ঘরে বাবলা ততক্ষণে পুষির গোঁফছাঁটা কাঁচিটা লুকোতে ব্যস্ত। বলাতো যায় না-কখন স্ক্রু-খোলা কাঁচিটা বড়দের চোখে পড়ে যায়?
: না-নিশ্চিন্তে কোন কাজ করার উপায় নেই। হাঁফিয়ে উঠে বাবলা।
সবাই যেন কি-
ভারী ইয়ে…
বিশেষ করে কাকুটা…
: বাবলা-
এই সেরেছে!
এবার উপায়…! দম বন্ধ করে আলমারির পাশে দাঁড়িয়ে থাকে বাবলা।
কইরে বাবলা-এলিনে।
নড়ে ওঠে বাবলা। কাকুর ডাককে অমান্য করবার দুঃসাহস নেই ওর অতটুকুন কচি বুকে-গুটি গুটি পায়ে নেমে এলো বাবলা উপর থেকে। জড়সড় হয়ে দাঁড়ালো কাকুর সামনে।
: এ্যাই যে-শ্রীমান তা আমার কম্পাসটা কোথায়-?
: কম্পাস ঢোক গেলে বাবলা।
: বুঝতে পারছিস না…? ধমকে ওঠেন কাকু।

হঠাৎ দরজার ওপাশে একটা পরিচিত ছায়া দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো বাবলা-মা!
: ওকিরে…! আমার কাছে এলে কি হবে-? তোর কাকুর কম্পাসটা দিয়ে দে-
: জানিনে। মার বুকে মুখ গুঁজে উত্তর দেয় বাবলা।
: ফের জানিনে। রেগে গেলেন কাকু।
এবার আরো আকুল হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল বাবলা।
এবার আর সন্দেহ রইলো না মার। বললেন- কম্পাসটা দিয়ে দে বাবা, তোর কাকুর কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে যে।
: আগে আমায় কাকুর মত একটা সাইকেল দেবে বল! মার গলা জড়িয়ে ধরলো বাবলা।
: ও এজন্যে এত লুকোচুরি…? বেশতো, আসছে মাসে বাবলুর জন্য একটা…বুঝলে তো, ভাই! হেসে ফেলেন মা। কিন্তু কলেজের দেরি হয়ে যাওয়ায় রেগে যান কাকু। বলেন- আচ্ছা বাবা আচ্ছা সাইকেল কেন? একেবারে স্পুটনিক কিনে এনে দেব একটা। এখন দেতো কম্পাসটা।
কাকুর মুখের পানে চেয়ে ভারী হাসি পেল বাবলার। বাহ্ কেমন জব্দ! কিন্তু স্পুটনিক হলেতো চলবে না? চাই সাইকেল। টেবিলের তলা থেকে কম্পাসটা বের করে দিল বাবলা। বলল- স্পুটনিক চাইনে, সাইকেল।
বাবলার দৌরাত্ম্যের শেষ নেই। বাড়ির ঝি-চাকররাও রীতিমত অস্থির ওর জ্বালায়। সইতে হয় তবুও হাজার হোক সে যে বাবলা। সম্প্রতি একটু মুশকিলে পড়েছে বাবলা। রাঙানানু এসেছেন বেড়াতে। দেখলেই শুধু বকেন বাবলাকে-
“দস্যি ছেলে…গেছো বাঁদর…শয়তানের রাজা”…আরো কত কি-সবগুলো মনে আসে না বাবলার। তা হোক! তাতে কিছু মনে করে না সে। কারণ আছে। আর কেউ না জানুক-বাবলা জানে কেন সে রাঙানানুর চক্ষুশূল।
রাঙানানুর ডালের বড়ির সদ্ব্যবহার করে বাবলা রোজ বিকেলে। ছাদে উঠে গুলতি দিয়ে আমের বোল ঝরায় সে। তা না হলে রাঙানানুর শত্রু হতে যাবে কেন বাবলা শুধু…শুধু…!
দাঁত নেই রাঙানানুর। বকুনির বেলায় ভারী কষ্ট হয় তাঁর।
তবু…ও-
রাঙানানুকে-থোড়াই কেয়ার করে বাবলা।
ফঁন্দি আঁটে মনে মনে। জব্দ করা যায়না রাঙানানুকে?
রোজ দেখে বাবলা-সন্ধ্যেবেলা রোয়াকে ইজিচেয়ার পেতে হাওয়া খেতে বসেন রাঙানানু।
ব্যাস্!
দুষ্টুমির হাসি খেলে যায় বাবলার চোখে-মুখে।
সন্ধ্যের সেই মুহূর্তে রোয়াকে পাতা ইজি চেয়ারের পেছনের লাঠিটা খুব সাবধানে খুলে রাখলো বাবলা। তারপর সরে গেল চুপ করে।
একটু পরেই রাঙানানু এলেন তাঁর বিরাট শরীর নিয়ে। রোজকার মত বসতে গেলেন আরাম করে। ব্যাস্! অমনি ধপাস করে পড়েই একেবারে হাত-পা ছেড়ে চিৎপটাং। বাড়ির সবাই ছুটে এলো ব্যস্ত হয়ে। কিছুক্ষণ দাপাদাপি করার পর মা আর রাঁধুনি অনেক কষ্টে টেনে তুললেন রাঙানানুকে। রাগে দুঃখে কেঁদে ফেললেন তিনি পোড়া কপাল-এক বাড়ি লোকের সামনে…।

এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য বারবার ক্ষমা চাইলেন…বাবা-মা…আর কাকু। কিন্তু কেউ জানতোনা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসছে বাবলা।
মাসের শেষ।
আর যেন সয়না।
আসছে মাসে বাবলার সাইকেল কেনার কথা।
ক্যালেন্ডারের সামনে এসে দাঁড়ায় বাবলা। শেষ হয় না কেন এই মাসটা?
আচ্ছা সব মাসগুলোই কি এত বড় হয়…? নাকি শুধু এইটে?
দুটো দিনকে একটা দিন করা যায় না? কিছুতেই না…?
উঃ! আর ভাবতে ইচ্ছা করে না বাবলার। হঠাৎ কাকুর ডাক শুনতে পেয়ে চমকে উঠে সে।
: শোন্, বাবলা, কাছে আয়।
কাছে যাবে বাবলা-
কিন্তু কেন?
আজ কোন অন্যায় তো সে করেনি?
তবে?
কেন কাকু ওকে ডাকছেন…?
বাবলা!
ছোট ছোট পা ফেলে বাবলা কাকুর সামনে এসে দাঁড়ালো।
: কাছে আয়।
আরো কাছে আয়…?
বুক কেঁপে ওঠে বাবলার…।
ঢোক গিলে বার কয়েক বাবলা। তারপর…
তারপর একেবারে কাকুর নাগালের মধ্যে এসে দাঁড়ায় সে। থর থর করে কেঁপে ওঠে বাবলার কচি ঠোঁট দু’টো।
: কেন ডেকেছি বলতো? বাবলার দু’কাধ ধরে মৃদু ঝাঁকুনি দিলেন কাকু।
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো বাবলা। কি ক’রে জানবে সে… কেন কাকু ডেকেছেন…?
: আজ তোর সাইকেল আনবো…।
: সাই…কে…ল…
আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল বাবলা। তা কি করে সম্ভব! নতুন মাসতো এখনো আসেনি! তবে?
: স্কলারশিপ বুঝিস?
: না-অবাক হয়ে মাথা নাড়ে বাবলা।
: বড় হলে বুঝবি…হাসেন কাকু।
বাবলাকে কোলের কাছে টেনে বলেন-
: আজ স্কলারশিপের টাকা পেয়েছি, অনেক টাকা। কাজেই তোর জন্য একটা…কেমন…?

আজ বাবলার সাইকেল আনার দিন। কাকু গেছেন সাইকেল আনতে। কেমন হবে দেখতে? কে জানে? বেল থাকবে নিশ্চয়…। বাজবে তো খুব জোরে? ক্রিং ক্রিং করে…?
সবাই হাঁ করে চেয়ে থাকবে।
ভারী মজা হবে তখন।
একটা অব্যক্ত আনন্দে ভরে ওঠে বাবলার কচি বুকটা।
বাড়ির বাইরে ফুটপাথের ওপর এসে দাঁড়ালো বাবলা।
আচ্ছা রাঙানানু যদি চড়তে চান? দেবে চড়তে?
ভেঙে যাবে না…? যা মোটা….বাপস….!
রাঙানানুর বিরাট শরীরটার কথা মনে পড়তেই ভারি হাসি পেল বাবলার। আর বেশি দেরি নেই। একটু পরেই হয়তো কাকু এসে পড়বেন সাইকেল নিয়ে…।
হয়তো এখনই দুধ খাওয়ার জন্য ডাক পড়বে…বাড়ির ভেতর থেকে। তা হোক! আজ না হয় একটু দেরিতেই দুধ খাবে সে…!
রোজ তো আর…
হঠাৎ বাবলা দেখতে পেল কাকু আসছেন রিকশায় চড়ে। আর সামনে ওটা কি…লাল রঙের সাইকেল…?
উঃ! কি মজা…
: কাকু…
আনন্দের আতিশয্যে ছুটে গেল বাবলা রাস্তার ওপর। তারপর, তারপর এঁকেবেঁকে দৌড়াতে আরম্ভ করলো মাঝ রাস্তা দিয়ে…।
: আমার সাইকেল…আমার সাইকেল…
: বাবলা সরে যা…
রিকশার ওপর থেকে চিৎকার করে উঠলেন কাকু। কিন্তু সে ডাক বাবলার কানে পৌঁছালো না। তার আগেই একটা চলন্ত ট্যাক্সি ঝাঁপিয়ে পড়লো বাবলার ছোট্ট দেহের উপর। চলন্ত রিকশার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়লেন কাকু।
: বাবলা…
: সাই..কে…ল…ভয়াবহ মৃত্যু যন্ত্রণার মধ্যেও কঁকিয়ে উঠলো বাবলা।
: তোর সাইকেল এনেছি…বাবলা…তোর সাইকেল!…বাবলার রক্তাক্ত দেহটা বুকের কাছে তুলে যেন অমৃতবাণী শোনাতে চাইলেন কাকু…।

বিবর্ণ-ক্লান্ত দুই চোখ তুলে কাকুর মুখের দিকে তাকালো বাবলা। থর থর করে কেঁপে উঠলো ওর পান্ডুর ঠোঁট…যেন বলতে চাইলো-
: সাই..কে….ল…. যেন বলতে চাইলো
: শোনাও আর একবার সেই অমৃতবাণী
বাবলার চিরকেলে চঞ্চল চোখ দুটো শান্ত হয়ে বুজে এলো।
সূর্য তখন হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। তারই শেষ আলো এসে পড়েছে বাবলার রক্তাক্ত দেহের ওপর আর পাশে পড়ে থাকা নতুন ছোট্ট সাইকেলটার ওপর।

Share.

মন্তব্য করুন