সৈয়দ আলী আহসানের নাম তো তোমরা নিশ্চয় শোনার কথা। হয়তো কেউ শুনে থাকবে। আবার কেউ কেউ শোনোনি! আর যদি না শোনো তাহলে এখন শোনো মন দিয়ে। তার কথা জানার দরকার আমাদের খুব। কারণ তাঁর মতো এত বড় মাপের জ্ঞানী আমাদের দেশে কমই আছে। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবেও তিনি অনেক অনেক বড়। কত কত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছিলেন তিনি। একটি একটি করে বলি তবে। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

একটি মজার বিষয় হলো, তিনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন বাংলা। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিও পড়াতেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিল্পকলা বিষয়ে পড়াতেন! বিষয়টি বিস্ময়ের নয় কি? তিনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন বলে ইংরেজি পড়ানোটা খুব স্বাভাবিক। আবার সাহিত্যের বা কবিতার মানুষ হিসেবে বাংলা পড়াতেন এটিও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু শিল্পকলা বিষয়ে পড়ানো খুব স্বাভাবিক নয়। বরং অবাক করার মতোই ঘটনা। এ অবাক করা ঘটনাটিই সৈয়দ আলী আহসানের জন্য ছিলো একদম স্বাভাবিক। তিনি খুব মজা করে পড়াতেন শিল্পকলা। এ বিষয়ে তাঁর একটি বইও আছে। বইটির নাম হলো- শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য।
তিনি আমাদের বাংলাদেশের একজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।

পৃথিবীর সব দেশেই কিছু মানুষ থাকেন যারা সে দেশের সবার মধ্যে গুণীজন। সবাই খুব শ্রদ্ধা করে তাঁদের। প্রয়োজনে তাদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ চান। তাঁদের জ্ঞানগর্ভ রচনা পাঠ করে নিজের জীবনের জন্য দিকনির্দেশনা নেন। সে রচনায় তারা পেয়ে যান জীবনের জন্য সাফল্যের আনন্দ! পেয়ে যান নানারকম কাজ ও পরিকল্পনার সৌন্দর্য! পান পথ চলার অভিজ্ঞতা।

সৈয়দ আলী আহসান একজন বড় পণ্ডিত। একজন বড় কবি ছিলেন। একজন বড় শিক্ষাবিদ। একজন বড় সাহিত্য সমালোচক ছিলেন। সাহিত্যের মান বিচার করতে খুব পারদর্শী ছিলেন। তাঁকে বলা হয় মনীষী। সাহিত্যের সকল বিষয়ে জানাশোনা ছিলো তাঁর। তিনি জানতেন কবিদের কবিতার কথা। ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস সম্বন্ধে। গল্পকারদের গল্প নিয়ে। নাট্যকারদের নাটক সংক্রান্ত এবং প্রবন্ধকারদের প্রবন্ধ বিষয়ে। শিল্পকলা বিষয়েও তিনি অসাধারণ ছিলেন।

আরেকটি বিশেষ বিষয় হলো তিনি আধ্যাত্মিক ছিলেন। সুন্দর করে কথা বলতেন। বেশ নিচু শব্দে কথা বলতেন। প্রয়োজনীয় কথার বাইরে কথা বলতেন না তেমন। তাঁর বক্তব্য ছিলো মন ভরানো আনন্দের! খুব সুন্দর বক্তব্য দিতেন তিনি। ছোট ছোট বাক্যে চমৎকার সব শব্দ প্রয়োগে বক্তব্য রাখতেন। তাঁর বক্তব্য শুনে সবাই অবাক হতেন। সবুজ চোখ তুলে চেয়ে থাকতেন তাঁর দিকে। কি যে আশ্চর্য ছিলো তাঁর কথা এবং কথার মাধুর্য।
সৈয়দ আলী আহসানের জন্ম মাগুরা জেলায়। গ্রামের নামটি বড়ই মজার। আলোকদিয়া। আলোকদিয়ার আলোর ছেলে সৈয়দ আলী আহসান। গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ তাঁকে খুব টানতো। প্রকৃতির নীরব পরিবেশে তিনি বসে থাকতেন চুপচাপ। পাখির গান শুনতেন। বাতাসে নড়ে ওঠা পাতার দোলা দোলা খেলার ছবি দেখতেন। সূর্য ওঠার সময় নতুন আলোর মজার চিকমিকি দেখতেন। আবার আলো ফুরিয়ে যাওয়া বিকেলের শেষ আলোর আভা ছড়িয়ে সূর্যের ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখতেন।

সৈয়দ আলী আহসানের একটি অন্যরকম ব্যাপার ছিলো, তিনি সাহিত্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বিশ্বসাহিত্যের অনেক বড় কবিদের সাথে ছিলো তাঁর বন্ধুত্ব। বিশ্বের বহু পণ্ডিতের সাথেও ছিলো তাঁর ঘনিষ্ঠতা। আবার বিশ্বসাহিত্যে ছিলো তাঁর বেশ দখল। তিনি জানতেন কোথায় কোন ভাষায় কেমন সাহিত্য হচ্ছে। কোন ভাষায় বড় কবি আছে। কোন ভাষায় রচিত হচ্ছে উন্নত সাহিত্য। তিনি নোবেল সাহিত্য কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন। আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখেছেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন পর্ব। মধ্যযুগ আর আধুনিক যুগের ইতিহাস লিখেছেন। তাঁর কবিতা সবার চেয়ে আলাদা। তাঁর গদ্যও অন্যরকম মজার। তিনি আধুনিক কবিতা বিষয়ে বই লিখেছেন। জীবন যাপন নিয়ে লিখেছেন। সংস্কৃতি নিয়ে লিখেছেন। আল্লাহ এবং আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে। এমন কি তিনি রান্না বিষয়েও লিখেছেন বই। নিজে রান্না করতেন সময় পেলে।

তাঁর কাছে যেতেন কবি সাহিত্যিকেরা। নানান বিষয়ে জিজ্ঞেস করে তাঁর থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জানতেন। তিনিও যা জানতেন তাই জানাতেন মন খুলে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- এমন কোনো প্রশ্ন ছিলো না, যার উত্তর তিনি দিতে পারেননি। অথবা বলতেন না যে এই প্রশ্নের জবাব আমি পরে দেবো। আবার সংশয়ও ছিলো না তাঁর জবাবের ভেতর। খোলাখুলি সুন্দর করে জবাব দিতেন। আমাদের দেশীয় সাহিত্য থেকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য পর্যন্ত সব বিষয় ছিলো তাঁর পড়ার আওতার মধ্যে। ধর্মীয় বিষয়েও ছিলো তাঁর যথার্থ জ্ঞান। তিনি জানতেন আবার মানতেনও খুব যত্ন করে।
আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দসৈনিক ছিলেন। নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতেন, উৎসাহ জোগাতেন।

তিনি একজন অতি বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। কথা এবং কাজে সত্য ধারণ করার আনন্দ ছিলো তাঁর নিত্যদিন। তিনি সম্মানকে খুব বড় করে দেখতেন। সম্মানকে তুলে ধরতেন সম্পদের ওপর। সে সম্পদ অনেক হলেও লোভ করতেন বলে দেখা যায়নি। নিজের খ্যাতির জন্য তেমন করে লালায়িত ছিলেন না তিনি। বরং নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাওয়া লিখে যাওয়া ছিলো তাঁর প্রধান প্রতিদিনের ঘটনা। হয় পড়তেন, না হয় লিখতেন। না হয় কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন।

অনেক সময় একা একা বসে থাকতেন জানালার পাশে। রাতের নির্জনে বসে অন্ধকার দেখতেন। কখনও দেখতেন চাঁদের আলো। হাসনাহেনা ফুলের মধুর সুবাস খুব প্রিয় ছিলো তাঁর। তিনি ফুলের সৌন্দর্যও অনুভব করতেন খুব মন দিয়ে। তাঁকে জানতে হবে আমাদের ভালো করে। কারণ বড়দের জানলে বড় হওয়ার স্বপ্ন বুকের ভেতর অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের দিন সৈয়দ আলী আহসানের জন্মদিন। ১৯২২ সালের ২৬ মার্চ একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন এই মনীষী। ২০০২ সালে ২২ জুলাই চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন এ পৃথিবী থেকে।

Share.

মন্তব্য করুন