শকুনের মতো রোজ বিমান উড়ছে আকাশে। বিমানের বোমাতে গাঁও শিবপুরের একজন মেয়ে এবং একটি ঘোড়া মরে গেছে। কলেজ মাঠেও ওরা বোমা ফেলেছে। তবে তখন মাঠে কেউ ছিল না। বিমানের শব্দ পেলেই- সবাই এখন চৌকির নিচে লুকায়। আয়েন উদ্দিনের হোন্ডার শব্দও এখন মানুষের কাছে আতঙ্ক। শুধু কোনো ভয়ভীতি নেই যেন মহম্মদের। সারাক্ষণ সে একটি বাঁশের লাঠি হাতে ঘুরে। গেলো বছর তার দাদা মারা যাওয়ার পর- এই লাঠিটি সে হাত করেছে। ওরা লাঠিয়াল বংশের লোক। লঙ্করপুর পরগনার লাঠিয়াল ছিল ওর দাদা। মানুষ তাকে এটা ওটা বলে- নিষেধ করে। কারো কথাই সে কানে তোলে না।
ক্লাস থ্রিতে উঠেছিল মহম্মদ। তারপর সে আর স্কুলে যায়নি। এরই মধ্যে ক্লাস ফাইভে উঠে গেছে গণি। গণি ক্লাস ফাইভে পড়লেও মহম্মদকে সে ভয় করে। জ্ঞান-বুদ্ধি বা বল-শক্তি কোনোটাই তার মহম্মদের চাইতে বেশি নয়। সারা দুনিয়ার খবর জানে মহম্মদ। গণির বয়স বারো-তেরো বছর। আর মহম্মদের আরো এক-দুই বছর বেশি হতে পারে। তবে তাদের দু’জনের গলায় গলায় পিরিত। তারা একসাথে স্কুলে যেত। মহম্মদ এখন আর স্কুলে যায় না। বাবার সাথে মাঠে কাজ করে। মহম্মদের সাথে বেড়ানোর কারণে গণিকে বাড়িতে বকাঝকাও খেয়েছে। তার বাবা বলেন
– এমনিতে ঐ ছেলেটার বুদ্ধিসুদ্ধি ভালো না। খামখেয়ালি বুদ্ধি। কখন কী করে আর কখন কোথায় যায়- তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই! দেশের অবস্থা ভালো না। চারিদিকে বোমা পড়ছে। আবারও আর্মিরা নাকি যমুনাও পার হয়ে আসিছে। তাহলে এইখানে আসতে আর কয়দিন। ওরা তো ইজুজ-মাজুজ। আসমান-জমিন সব ওদের দখলে। আর ঐ ছেলে বাঁশের লাঠি হাতে ঘোরে। বাপ-দাদার বাঁশের লাঠি। ওদের মাথাতে কিছু নাই। ঐ ছেলের সাথে কোথাও যেও না। কখন কী হয়!
বাবা যাই বলুক- স্কুল বন্ধ- বন্ধ মানে, স্যারেরা স্কুল বন্ধ করে দেয়নি- কলেজের মাঠে বিমানের বোমা পড়ার পর থেকে আর স্কুলে যায় না। তাহলে গণি সারাদিন বাড়িতে কী করবে? তাদের বাড়ির গরু-বকরিগুলো বেচে দেয়া হয়েছে। ঘাস কাটার বালাইও নেই। গণি ছাগলের কালো রঙের বাচ্চাটা রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। বাড়ির পেছনে কবরের মতোন একটি গর্ত করা হয়েছে। বিমান থেকে বোমা পড়লে বা আর্মিরা আসলে বাড়ির সবাই যেন ঐখানে লুকানো যায়। চৈত্র মাসের দিন- ডালপালাতে ঢাকা ঐ গর্তের মধ্যে থাকা ভীষণ কঠিন। কবরের সাথে- এই গর্তের একটাই তফাত কবরে যাওয়া-আসার মুখ থাকে না। আর এই গর্তের একটা মুখ আছে। বড় নিমগাছটার গোড়ায়। মহম্মদের বাড়িতে এরকম কোনো গর্ত কাটেনি। ওরা পানাপুকুরের মধ্যে লুকাবে। গণি পাড়ার সবার গর্তগুলো দেখেছে। একটা বিষয় সে বুঝতে পারছে না। বিমানের বোমাতে যদি কলেজের দালান ভাঙতে পারে- তাহলে ঐ বোমা- এই গর্তের মধ্যে ঢুকতে পারবে না? আমের ডাল- নিমের ডাল- বাঁশ… এগুলো কি পোড়া ইটের চাইতেও শক্ত। নাকি নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ে খুঁড়ে রাখছে সবাই। কে জানে?
গণির বাড়িতে ভাত না থাকলেও পাকা কলা থাকে সব সময়। লম্বা লম্বা আনাজি কলা। অসময়ে কারো ক্ষুধা লাগলে- সে কলা খায়। দুপুর হয়নি এখনো। তবে রোদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে- পূর্ণ দুপুর। মহম্মদের হাবভাবের মতো আজকের রোদের মধ্যে একটা পাকামো ভাব আছে। মহম্মদ এখন গণেশ বাবুর আমবাগানে থাকার কথা- ওখানে হাঁটুহাঁটু খেলা হয়। মহম্মদও হাঁটুহাঁটু খেলে। গণি ঐ আমবাগানের দিকে রওনা দিল। তার গামছাতে বাঁধা তিনটা আনাজি কলা- দু’জন একসাথে খাবে সে এমন নিয়ত করেছে। গণি একবারে একটার বেশি আনাজি কলা খেতে পারে না। তবে মহম্মদ দুই-তিনটাও খেতে পারে। তাই ওর জন্য দুইটা নিয়েছে। গণেশ বাবুরা কেউ ভারতে যায়নি। ওদের অনেক জমিজমা। আমবাগান। বাজারে বড় মুদিদোকান। তবে পালেরা কেউ পাড়াতে নেই। নামাজ গ্রামের পালপাড়া একেবারে খালি। ঐ পাড়াতে এখন শুধু মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কলস- কোর… এগুলো পড়ে আছে। পোড়ানো কলস, রুটির খোলা, অপোড়ানো পুতুল, হাতি-ঘোড়া, ভাতের হাঁড়ি, মাটির ব্যাংক… আরো কত কী সব!
তাদের পাড়ারও কারো মুখে হাসি নেই! কতদিন সে মনে মনে ভেবেছে- ইস! এক টানা অনেকদিন স্কুল বন্ধ থাকলে কত- ভালো হতো! এখন স্কুল বন্ধ কিন্তু তার ভালো লাগছে না। শুধু ভয় লাগছে। গণেশ বাবুর আমবাগানে মহম্মদ নেই। তাই গণি বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল। এমন সময় গণেশ বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো মহম্মদ। গণেশ বাবুর বাড়িতে মুচি, কামার-কুমার, উপেন মিস্ত্রি, মুসলমান সবাই ঢুকতে পারে। তারা কাউকে কিচ্ছু বলে না। খেতেও দেয়। একসাথে বসে খায়ও। কিন্তু স্বপন সাহার বাড়িতে কেউ ঢুকতে পারে না। ঐ বাড়ির মহিলারা বেশি খারাপ। মহম্মদ তাই মাঝে মাঝেই- স্বপন সাহার টিনের চালে ঢিল মারে। ওদের গাছের ডাব নামিয়ে খায়। গণিও একদিন রাতে ওদের ডাব খেয়েছে।
মহম্মদের হাতে ঐ লাঠি। গণিকে দেখে সে বলল,
– এই পটলা শোন। কাকী মাকে বলে আসলাম- কারো কোন সমস্যা নাই। আমরা আছি। সমস্যা হলো… খানের বাচ্চারা বিমানে আসছে। যদি সামনাসামনি আসত! দেখতুম- খানের বাচ্চারা কত বড় মরদ।
গণি তার কথাগুলোর কোন উত্তর দিল না। সে গামছা থেকে কলাগুলো বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলো। একটি হাতে ধরে মহম্মদ বলল,
– কেবলই কলা আর সন্দেশ খায়ে আসছি। দে খাই… এহুন যুদ্ধের সময়। একটা খান মারতে হবে- গোপালপুর সুগার মিলের নর্দা ফার্মে দুইজন খানকে মানুষ পিটিয়ে মারিছে। গোচরের রেললাইনেও একজনকে মানুষ মারিছে- কিন্তু ঐ খানের গুলিতেও একজন লোক মরিছে। আমার এদিক আসলে হয় খালি- আমরাও…! একটা খান মারা কম কথা না! আরেকটা ঘটনা! চল যাই- বেলপুকুর রেলগেটে ইপিআরেরা বিমান মারা মেশিন আনিছে। চল যাই- দেখি আসি।
বিমান মারা মেশিনের কথা শুনে- গণির মনেও শিহরণ জেগে উঠলো। কলা খেতে খেতে সে মহম্মদের পেছনে হাঁটতে লাগল। বেলপুকুর নাটোর রোড ঘেঁষা। এইখান থেকে অনেক দূর। যেতে যেতে মহম্মদ বলল
– শিবনাথও ঐ মেশিন দেখতে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু কাকীমা ওকে বের হতে দিল না। শোন ওকে- ভারতে পাঠিয়ে দিবে। ওরা চায়- ওদের বংশের অন্তত একজন যেন বেঁচে থাকে…!
এ কথা শুনে- গণিরও তার বাড়ির কথা মনে পড়লো। বাড়ি থেকে বলেছে, দূরে কোথাও যাওয়া যাবে না। আর খানিকক্ষণ পর পর বাড়িতে এসে হাজিরা দিয়ে যেতে হবে। আরেকটা ভাবনা তার ভেতরটাকে ওলটপালট করে দিলো। তার মানে কী- এই দেশে যারা থাকবে- তারা সবাই মারা যাবে। কিন্তু সে এতো তাড়াতাড়ি মরতে চায় না। সে বিয়ে-শাদি করতে চায়। আরো পড়তে চায়। আর ফরিদের বাবার মতোন সুগার মিলে একটা চাকরিও করতে চায়। অথচ তার বাবা তো কোনো মতেই ভারতে যেতে চায় না। ভারতের নাম তার বাবা শুনতে চায় না। তিনি বলেন,
– এই তো কয়েক বছর হলো, আমরা এপারে এলাম। বাড়িঘর কোনো কিছুই সারা হয় নি এখনো। কামার তকতক বাড়িঘর দিয়ে- আমাদেরকে নিতে হয়েছে- এই ঝোপঝাড়-জঙ্গল- ডোবা… এইসব। সাধে তো নিজের নাড়িপোঁতা ভিটা, বাপ-দাদার কবরস্থান ত্যাগ করিনি। ওরা মানুষ? হিন্দুস্থানে … মুসলমানের কোন জায়গা নাই। আবার ওদের কাছে- যাবো?
গণিরও জন্ম হয়েছে কালিভিটায়। কিন্তু সে ওখানকার কোন কিছুই দেখে নি। ওখানকার ভালো-মন্দ কোন কিছুই সে মনে করতে পারে না। তবে সে তার বাবা-মায়ের কাছে প্রতিনিয়ত ওখানকার গল্প শোনে। ওখানকার কাকে কাকে যেন তার বাবা গালিগালাজ করে। তাদেরকে অভিশাপ দেয়। যাইহোক, এখানেই এখন আর ভালো কী হচ্ছে? স্বপ্নে ও জাগরণে সব সময়ে মৃত্যু ভয়। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। এখনো ভারতে তার এক চাচা এবং দুই মামা আছেন। তাই মহম্মদ যদি ভারতে চলে যায়। তাহলে সেও তার সাথে চলে যাবে। কালিভিটা নাকি বর্ডারের কাছের গ্রাম। দূরে না। মহম্মদকে সে জিজ্ঞেস করলো,
– আচ্ছা, তুই ভারত যাবি?
– না। আমি ভারতে যাবো ক্যা? আমি রিফিউজি- না, হিন্দু? না, আমি কাউকে ভয় করি। আসুক- খানের বাচ্চারা। দেখছি। আমি নেঘু লাঠিয়ালের নাতি। মাথা ফাটাইয়ে দিব একেবারে। ভাঙি ফাটা।
গণি আর কিছুই বলতে পারল না। তবে ‘রিফিউজি’ বলাতে গণি মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেল। এখানকার ছেলেরা- তাদেরকে ‘রিফিউজি’ বলে গালি দেয়। বেলপুকুর হাফিজ মৌলভীর আমবাগানে অনেক মানুষের ভিড়। পঁচিশ-ত্রিশ জন ইপিআর আর আনসার সদস্য সেখানে আছে। বাকিরা সবাই আশপাশের গ্রামের মানুষ। লুঙ্গিপরা মানুষ। ঐ পঁচিশ-ত্রিশ জন শুধু পোশাকপরা। অনেকে বোধ হয় তাদেরকে এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্রগুলো দেখতে এসেছে। আবার অনেকে এসেছে- তাদের জন্য খাবার নিয়ে। রুটি-তরকারি, ছাতু… এইসব। গণি ভাবল- বাড়ি কাছে হলে- সেও দৌড় দিয়ে তাদের জন্য এক ছড়া কলা নিয়ে আসত। ওরা মানুষজন সবাইকে দূরে চলে যাওয়ার জন্য বলছে। গণিকেও একজন বলল
– এই বাবারা- তোমরাও যাও। তোমরা এখানে কেন এসেছো। ভাগ যাও ইহাছে। ভাগ যাও… ভাগ যাও।
একজন ইপিআর সেনা গায়ে হাত বুলিয়ে কথা বলাতে গণির ভীষণ গর্ব হলো। কিন্তু মহম্মদ ঐ সেনাকে জিজ্ঞেস করল,
– স্যার, বিমান মারা মেশিন কোনটা স্যার। স্যার, একবার বলেন না। আমরা দেখে- এক্ষুণি চলি যাবো।
সৈনিকটি ঢেঁকির মুষলের মতোন একটা জিনিস দেখিয়ে বলল,
– এইটা।
মহম্মদ দৌড়ে গিয়ে ঐ অস্ত্রটিকে একবার ছুঁয়ে দেখল। তার কাণ্ড দেখে ঐ সৈনিকটি রেগে বলল,
– ভাগ যাও… ভাগ যাও। ইহাচে।
শাপলা বিলে এসে মহম্মদ তার মাথার পাগড়ি খুলে বলল,
– না রে… এই লাঠিতে বোধ হয় কাম হবে না! বুঝতে পারছি। ইপিআরের মতোন ঐ খানের বাচ্চারে কাছেও তো এইরকম মেশিন আছে। চল, বাড়িতে যাই আগে।
মহম্মদের কথা মুখে থাকতেই- নাটোর রোড থেকে গুলির শব্দ আসতে লাগল। চৈত্র মাসের শেষ বিলে কোন ফসল নেই। গম কাটা হয়ে গেছে। তারা লুকাবে কোথায়? বিল জুড়ে কয়েকটি বাবলা আর খয়েরগাছ। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল। গ্রামের সব মানুষ, নারী-পুরুষ সবাই বিলের দিকে দৌড়ে আসছে। যেন তাদের দুজনকে তাড়া করেছে সবাই। তারা আগে দৌড়াচ্ছে, আর গ্রামের মানুষ পেছনে।
শাপলা বিলের পশ্চিম সীমান্তে ঘোষপাড়ার মরাপুকুরে জড়ো হয়েছে অগণিত মানুষ। শুধু বর্ষায় এক-দেড় মাস পানি থাকে- এই পুকুরে। তাই এই পুকুরের নাম হয়েছে মরাপুকুর। গণি ও মহম্মদের পরিবারের লোকজনও এই পুকুরপাড়ে এসেছে। গণিকে তার বড় বোন- তাকে হুড় হুড় করে তার বাবার কাছে নিয়ে গেল। অন্তত এক থাপ্পড় খাওয়ার জন্য গণি মনে মনে প্রস্তুত। একাধিক থাপ্পড়ও হজম করতে হতে পারে। কিন্তু না, তার বাবা তাকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকল- মুখে কিছুই বলল না। পাশে একজন দোয়া-দরুদ পড়ছে। আরেকজন সমানে গালিগালাজ করছে পাকিস্তানি বাহিনীকে। আবার অনেকে লোকাল এমপিএ, এমএনএ-দেরকেও গালিগালাজ করছে। এই গাছ কাটো… বাঁশ কাটো… আর্মির রাস্তা ব্লক দেও…এখন ওরা কোথায়? আগেই পদ্মা পার হয়ে সব দোস্তের বাড়িতে চলে গেছে। এখন বৌ-বাচ্চা নিয়ে আমরা মরি…! তারু শেখ, আশরাফ উদ্দিন প্রামাণিক, স্বপন সাহা… কোন পরিবারের কেউ বাড়িতে থাকতে পারেনি। ঝড়-বৃষ্টি, বান-প্লাবন… যাইহোক কখনো এইসব পরিবারের কেউ বাড়ির বাইরে আসে না। দুপুর গড়িয়ে গেল, তবু গোলা-বারুদের শব্দ শোনা যাচ্ছে। নানা ধরনের শব্দ। ইটের ভাটার মতো ধোঁয়া উড়ছে গ্রামের মধ্যে। গণি আন্দাজ করল, যেইখানে তারা বিমান মারা মেশিন দেখতে গিয়েছিল- সেখান থেকেই ধোঁয়া উড়ছে। এরই মধ্যে মহম্মদ কয়েকবার তাদের কাছে এসেছে। গণিকে পুকুরের অন্য পাড়ে যাওয়ার জন্যও ডেকেছে। তবে সে নিজে থেকেই যায়নি। তাকে প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে। তবে এখানকার কারো কাছেই খাবার নেই। মসজিদের ইঁদারা থেকে কয়েক কলসি পানি আনা হয়েছে। সবাই ঐ পানি-ই খাচ্ছে। কাঁচা পেঁপে- পেয়ারা খাচ্ছে দুই-একজন। আশপাশেই কোথাও পেয়েছে হয়তো। বাড়ির কলাগুলোর কথা মনে পড়লো গণির।
মাগরিবের আযানের পর শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়োবৃষ্টি। ঝড়োবৃষ্টির সময় কে কোনদিকে ছুটে যেতে লাগল তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। গণি, মহম্মদ এবং স্বপন সাহার পরিবার গিয়ে উঠলো আমগ্রামের জবা মুন্সির বাড়িতে। জবা মুন্সির বাড়ির লোকজন কোথাও পালায়নি। অবশ্য নাটোর রোড থেকে এ গ্রামটি এতো নিভৃতে যে, তাদের পালানোর দরকারও হয়নি। তবে এদের বাড়িতেও তীর-ধনুক আর ফালা আছে এবং সেগুলো বারান্দাতেই রাখা- হাতের নাগালে। ঐ বাড়ির লোকজন তাদেরকে যথাসম্ভব শুকনো কাপড়চোপড় দিল। খিচুড়ি রান্না হলো। সারাদিন পর একসাথে সেই খিচুড়ি খেলো সকলে। স্বপন সাহার মা-ও জবা মুন্সির বাড়ির খিচুড়ি খেলেন।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, পাকিস্তানি বাহিনী শহরে চলে গেছে। দুই দিন পরে তারা সবাই পায়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল। তখন তারা ওতোদূর গিয়েছিল। গণি বুঝতে পারেনি। এখন ফেরার পথে তাকে ক্লান্ত লাগছে। বেলপুকুর এসে তারা দেখল- অন্তত আটজন ইপিআরের লাশ নাটোর রোডের দক্ষিণে খড়ের জমিতে পড়ে আছে। লাশগুলো ফুলে মোটা মোটা হয়ে গেছে। গন্ধ ছড়াচ্ছে। তবু কেউ তাদের ধারে কাছে যেতে পারছে না। অনবরত মিলিটারি গাড়ি টহল দিচ্ছে। আর রাস্তার উত্তর পাশে পাকসেনাদের কবর। সব দেখেশুনে গণির বাবা সিদ্ধান্ত নিল, আজ রাতেই তারা ভারতে চলে যাবে। মহম্মদের বাবা এবং স্বপন সাহারাও যাবে…।

Share.

মন্তব্য করুন