বিজ্ঞান চিন্তার এক একটি আবিষ্কার যেমন পৃথিবীতে নতুন দিগন্ত খুলেছে, তেমনি সেই নতুন অস্তিত্বহীন বস্তু জীবনকে করেছে সহজ ও গতিময়। এমনই এক আবিষ্কারের নাম টেলিভিশন। আমার কাছে তো মনে হয় এটি মহাশ্চর্যের এক বাক্স। রিমোট চাপলেই খুলে যায় পৃথিবী। বিস্ময় তো বটেই। এই টেলিভিশন শব্দটি কিন্তু একক শব্দ নয়। এটি একটি যৌগিক শব্দ। গ্রিক শব্দ ‘ঞবষব’ অর্থ দূরত্ব, আর ল্যাটিন শব্দ ‘ঠরংরড়হ’ অর্থ দর্শন বা দেখা, এই দুই ভাষার দুটি শব্দ মিলে হয়েছে ‘ঞবষবারংরড়হ’ বা দূরদর্শন শব্দটি। বিশ্বে তথ্য-প্রযুক্তির প্রকাশ ও বড় ধরনের প্রচার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত এই টেলিভিশন। অন্যান্য প্রযুক্তির মতো টেলিভিশন আবিষ্কারেরও রয়েছে এক ইতিহাস। টেলিভিশন আবিষ্কারের জনক বলা হয় ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন লোগি বেয়ার্ডকে। তিনি ১৮৮৮ সালে জন্মেছিলেন স্কটল্যান্ডে। যদিও বেয়ার্ডের আগে টেলিভিশন আবিষ্কারের সূত্রপাত হয়। সে বিজ্ঞানীদের মধ্যে পল নিপকো অন্যতম। ১৮৮৪ সালে পল স্ক্যানিং ডিস্ক আবিষ্কার করেন। আর এই স্ক্যানিং ডিস্কের ওপর ভিত্তি করে তিনি টিভি বানানোর চিন্তা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর নকশা অনুযায়ী যন্ত্রটার বাস্তব রূপ দিতে সক্ষম হননি।

এরপর ১৯১০ সালে টেলিভিশনের নতুন নকশা তৈরিতে এগিয়ে আসেন লি লিফরেস্ট ও আর্থার কর্ন। দুই বিজ্ঞানী নতুন নকশা অনুযায়ী একটি যন্ত্র বানান। সেই যন্ত্রের মাধ্যমে পাঠানো ছবি রিসিভ করার পর অ্যামপ্লিফায়ার দিয়ে জুম করে দেখানোর ব্যবস্থা রাখা হয়। তবু তাদের যন্ত্রে চলমান ছবি দেখাতে পারেনি। এই একই সমস্যায় পড়েন বিজ্ঞানী ভল্যাদিমির জোয়ার্কিন ও তার শিক্ষক বোরিস রোজিং। যদিও তারা আগের চেয়ে উন্নত স্ক্যানার ও ব্রাউন টিউব আবিষ্কার করেন। তবুও তাদের আবিষ্কার চলমান ছবি দেখাতে ব্যর্থ হয়।
এতসব বিজ্ঞানীর ব্যর্থতার পরই উদয় হন জন লোগি বেয়ার্ড। ১৯২৫ সালে ২৫ মার্চ বেয়ার্ড টেলিভিশনের বাস্তব রূপরেখা তৈরি করতে সক্ষম হন। বেয়ার্ড ছিল গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র কিন্তু পুষ্টিহীন ও দুর্বল একজন মানুষ। তবে তার মাঝে ছিল প্রচণ্ড উৎসাহ। বেতারে ছবি ধরার কাজটা নিয়ে তিনি উঠে পড়ে লাগলেন। এমন সময় তার গবেষণার যন্ত্রপাতি এবং পাশের ঘরে একটা পর্দা টাঙানো ছিল। একদিন তিনি দেখলেন যে সেই পর্দায় একটা যন্ত্রের ছবি উঠেছে। এতে তিনি চমকে উঠলেন। ছবিটি যে পাশের ঘরে রাখা যন্ত্রের, সে বিষয়ে তাঁর কোনো সন্দেহ নেই। এতে বেয়ার্ড আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে আর একটু চেষ্টা করলেই সফলতা তাঁর হাতের মুঠোয় ধরা দেবে। এরপর তিনি এই গবেষণার জন্য লন্ডনে এসে অনেক লোকের কাছে অর্থ সাহায্য চাইলেন। কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য না করে বরং পাগল বলে আখ্যায়িত করলো। কিন্তু বেয়ার্ড তাতে দমে যাননি। তাঁর একক প্রচেষ্টায় একটা গোলাকার স্ক্যানিং ডিস্ক, নিয়নবাতি আর একটা ফটো ইলেকট্রিক সেল- এ নিয়েই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগলেন। ঘূর্ণায়মান স্ক্যানিং ডিস্কের অসংখ্য ছিদ্রপথে এসে যে আলোকরশ্মি কোনো বস্তুর ওপর পড়ছে, তাকে ফটো ইলেকট্রিক সেলের মাধ্যমে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তর করেন। এবং সেই তড়িৎ শক্তিকে পুনরায় আলোক ফলিত করে তোলা সম্ভব হয়। এর মাধ্যমে সফল হলো বেতারে ছবি পাঠানোর কৌশল। বেয়ার্ডের স্ক্যানার প্রতি সেকেন্ডে পাঁচটা করে ছবি দেখাতে সক্ষম হয়। কিন্তু সত্যি বলতে কী বেয়ার্ডের স্ক্যানারও চলমান ছবি দেখাতে পারেনি। কেননা চলমান ছবি দেখাতে হলে প্রতি সেকেন্ডে অন্তত ১২টি ছবি পরিবর্তিত হতে হয়। আসলে ভিডিও হলো অনেকগুলো স্থির ছবির সমষ্টি। যখন আমরা অনেকগুলো স্থির ছবি একসঙ্গে খুব দ্রুত দেখি, তখন আমাদের চোখ আর আলাদা করে স্থির ছবিগুলোকে দেখতে পারে না। একসাথে চলমান ছবিগুলোকেই ভিডিও বলা হয়। কিন্তু এরপরই বেয়ার্ড ২ অক্টোবর বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে টেলিভিশন নিয়ে সবার সামনে হাজির হন। এতে প্রতি সেকেন্ডে ১২.৫টি করে ছবি দেখানো সম্ভব হয়। এবং এটির মাধ্যমে প্রথম বারের মতো টিভির মাধ্যমে চলমান প্রোগ্রাম দেখানো সম্ভব হলো। আর এরই সাথে শুরু হলো টেলিভিশন জগতের নতুন অধ্যায়। পরবর্তীতে জন লোগি বেয়ার্ডের হাত ধরেই সাদা-কালো টেলিভিশনের বদলে রঙিন টিভির শুভ সূচনা হয়।

Share.

মন্তব্য করুন