ঢাকা রসুল পুরে চৈতির মামা বাড়ি। বাবার চাকরির সুবাদে চৈতিরা শহরে থাকে। মা বাবা চৈতি ও তার ছোট ভাইকে নিয়ে ওদের ছোট্ট সংসার। প্রতি বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে তারা গ্রামে মামা বাড়ি বেড়াতে যায়। নানা-নানু, মামা-খালার সাথে দেখা হলে চৈতির আনন্দের আর সীমা থাকে না। তারা সবাই চৈতি ও তার ভাই রাতুলকে অনেক আদর করেন। বিশেষ করে কিশোর বয়সী ছোট মামা আর ছোট খালা সব সময় ওদের সাথে সাথেই থাকেন। চৈতিরা মামা বাড়ি গেলে ওদের অন্য খালারা ও বেড়াতে আসে। মা-খালারা মিলে গল্পের আসর বসায়। আর মামাতো খালাতো ভাই-বোনদের সাথে হৈ হুল্লোয় মেতে থাকে চৈতি ও রাতুল। এক সাথে গোসল করে খায় ঘুমায়। কি যে আনন্দ! বলে বোঝানো যাবে না। গ্রামের ছোট বড় সবাই সাঁতার জানে। কিন্তু চৈতির একটাই সমস্যা –
সে সাঁতার জানে না। তাই সে অন্যদের সঙ্গে পুকুরে নামার অনুমতি পায় না। হয় ছোটখালা না হয় ছোট মামার হাত ধরে শান বাঁধানো ঘাটের পাশে হাত পা ছোড়াছুড়ি করে সাঁতার কাটার সাধ মিটায়। জ্যৈষ্ঠ মাসে গরমের প্রখরতা বেশি থাকে বলে গ্রামের ছেলেমেয়েরা পুকুরে নেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে দাপাদাপি করে এবং গোসল করে। তাদের মা বাবা কিছু বলে না। এমনি করে আনন্দে সময় কাটে তাদের।
একদিন চৈতির নানা গাছের সব আম পেড়ে নিয়ে আসলেন। গরমে তাড়াতাড়ি পাকবে বলে টিনের চালার খাবার ঘরের পাটাতনের ওপর আম রাখা হলো। দু’ দিন বাদে আম পাকা শুরু হলো। এ খবরটি কেউ না জানলেও একমাত্র ছোট মামা টের পেয়েছে। মামা চুপিচুপি চৈতিকে বললো-
উপরে চল। পাকা আম খাওয়াবো। মইয়ের মতো খুব চিকন উপরে ওঠার সিঁড়িটি। ঐ সিঁড়ি বেয়ে চৈতি কিছুতেই উপরে উঠতে পারলো না। তাই খেলতে চলে গেলো।
চৈতির ভাই তিন বছরের ছেলে রাতুল। সে তেমন কিছু বোঝে না। ছোটমামা কখন যেন তাকে দলে টেনে নিলো আর বললো-
রাতুল পাকা আম খাবি? চল তোকে পাটাতনের উপর নিয়ে যাই। রাতুল এতোটাই ছোট যে এর উত্তর কি তা সে জানে না। তবে ছোটমামার ভালোবাসার ওপর তার ভরসা আছে। তাই মামার নির্দেশ মতো তার পিঠে চড়ে বসলো।
শক্ত করে ধরিস নইলে কিন্তু পড়ে যাবি। ছোটমামা বললো।
যেমন বলা তেমন কাজ। মামার পিঠে চড়ে রাতুল তার ছোট্ট হাত দু’খানা দিয়ে প্রাণপণে মামার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এবং তারা দু’জন উপরে পৌঁছে যতে সক্ষম হলো। ছোট মামা তার অতি প্রিয় ছোট ছুরিটা পকেট থেকে বের করলেন। এবং টিপেটিপে পাকা আম বেছে কাটতে শুরু করলেন। টিনের চালার গরমটা তখনো রাতুলের ততটা অনুভব হচ্ছিলো না। কারণ ছোটমামার হাতের ছোট ছুরিটার দিকে তার নজর ছিলো। মামার এই ছুরিটা তার খুব পছন্দ। সে তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো।
আর একটু বড় হলেই আমি এমন একটা ছুরি কিনবো। এবং সব সময় মামার মতো পকেটে রাখবো।
এমন সময় এক ফালি আম ছোটমামা তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন-
নেও বাবু খাও।
পাকা আম যে খেতে কত মজা তা রাতুল আজ বুঝতে পারলো। লুকিয়ে ছোটমামার সাথে আম খাওয়া। তার প্রিয় ছুরিতে কাটা আম। সর্বোপরি ছোটমামার ভালোবাসা আজ আমের স্বাদ বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। দু’জনের পেট যতটুকু ভরে উঠছিলো, গরমের মাত্রাটা ততই বাড়ছিলো। এক সময় আম খাওয়া শেষ হলো এবং দু’জনেই ঘামে ভিজে গেলো। এবার ছোট মামা বললো-
অনেক গরম লাগছে চল নেমে পড়ি। আমার পিঠে ওঠ।
কিন্তু নিচের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ রাতুলের পিলে চমকে গেলো। সে ভয়ে আর মামার পিঠে চড়তে রাজি হলো না। মামা অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে রাতুলকে উপরে রেখে নিজে নিচে নেমে ভয়ে পালিয়ে গেলো। বেচারা রাতুল তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সাহায্যের আশায় ফ্যালফ্যাল করে উপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো অথচ সে মুখে একটি শব্দও করলো না। ততক্ষণে গরমে রাতুলের সমস্ত শরীর সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। চোখ দুটো লাল হয়ে ক্রমে বড় হয়ে উঠলো। এই ঘরে কেউ ছিলো না বলে তাকে কেউ দেখতে পায়নি।
এক সময় রাতুলকে খুঁজে পাওয়া গেল খাবার ঘরের স্বল্প উচ্চ টিনের চালার পাটাতনে। অবশেষে একশত চার ডিগ্রি জ্বরের জন্য তেতো ওষুধ গিলতে হলো তাকে। আর ছোটমামাকে খুঁজতে চারিদিকে লোক লাগানো হলো।

Share.

মন্তব্য করুন