অফিসের গুরুত্ব পূর্ণ ডকুমেন্ট হারিয়ে চাকরি হারাতে হয় ফজলু মিয়ার। এখন তার জীবিকার উপায় এক ফ্লাস্ক চা আর কয়েক প্যাকেট বিস্কুট। তাও আবার পথের অনাথ শিশুদের ফ্রি খাওয়াতে খাওয়াতে লসের খাতায় নাম লেখাতে হয় রোজ। আধ পেট, খেয়ে সময় কাটে, তার। বস্তির সস্তা গুমোট ঘরে কোনো মতে রাতটুকু পার হয়ে যায়। এখনো ঝাঁকিয়ে সংসার পাতা হয়নি তাই রক্ষে। একদিন রাতে কে যেনো তার বিস্কুট খুলে খাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিলো। প্রথমে চোর ভেবে তেমন পাত্তা দিলো না ফজলু। কি আর এমন আছে তার? চোর কি বা নিবে ঐ বিস্কুটগুলো বাদে? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এটা মানুষ নয় অন্য কিছু হবে। ভয়ে তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ফজলু কোন শব্দ না করে আস্তে করে চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু সাহসে কুলায় না। ফজলু ঘাপটি মেরে থাকে। কিছুক্ষণ পর তার মনে হয় কেউ তার পা ধরে টানছে। ফজলু লাফিয়ে উঠে বসে। রাস্তার আলো জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে তাই স্পষ্ট দেখা যায় বিশাল আকারের এক দৈত্য। ফজলু ভয় পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে তুমি কি চাও ভাই? ভয় পেয়ো না আমায়, দৈত্যটি বলে, আমায় কিছু খেতে দেবে? ফজলু বিপদে পড়ে যায়। ভাই আমার কাছে তো কিছু নেই ঐ বিস্কুটগুলো ছাড়া। দৈত্য বলে ওগুলো শেষ। তাতে আমার পেট ভরে না। ফজলু বলে তাহলে এবার ঘুমিয়ে পড়। আমিও রোজ ক্ষুধা পেটে ঘুমাতে যাই। ফজলু ভয়ে জোর করে চোখ বন্ধ রাখে। ক্লান্ত শরীর একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। দৈত্যটিও কিছুই না বলে চুপ হয়ে যায়। ফজলু সকালে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে দৈত্যটি তার মুখের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। কেমন হকচকিয়ে ওঠে ফজলু। রাতে ঘুমের ঘোরে কি দেখেছে তেমন পাত্তা দেয়নি কিন্তু দিনের আলোতে এটা কী দেখছে সে। খুব মিনতি করে বলে তুমি কী চাও ভাই? আমাকে ছেড়ে দাও।
দৈত্য : কিছু না রে ভাই। আমি আলাদিনের দৈত্য। সেই কবে আমার প্রদীপ খানা কেউ গলিয়ে ফেলেছে। এখন আমি গৃহ ছাড়া। আমার আর কোনো ক্ষমতাও নেই। তাই মানুষের খাবার খাই।
ফজলু : তুমি বড়লোকের বাড়ি যাও না কেনো? দৈত্য : আমি সবার খাবার খেতে পারি না। খাঁটি লোকের খাবার খেতে পারি। কিন্তু খাঁটি মানুষতো খুঁজে পাওয়া যায় না।
ফজলু : তা আমিতো তেমন কেউ নই।
দৈত্য : তুমি খাঁটি লোক তাই।
ফজলু মনে মনে খুশি হয়ে যায়, যাক এ জনমে কেউতো তার প্রশংসা করলো।
ফজলু : আচ্ছা তুমি তোমার দেশে ফিরে যাওনা কেনো?
দৈত্য : প্রদীপ ছাড়া আমার দেশে প্রবেশ করার অনুমতি নেই।
ফজলু : এখন তুমি প্রদীপ কোথায় পাবে?
দৈত্য : সে জন্যই তোমার কাছে আসা।
ফজলু : আমি কী করবো?
দৈত্য : এই দুনিয়ায় খাঁটি মানুষের বড় অভাব। তুমি একজন খাঁটি মানুষ। তুমিই আমাকে সাহায্য করতে পারবে।
এমন প্রশংসা শুনে ফজলুর মন গলে গেলো।
ফজলু : তুমি সত্যি বলছো? কই কেউ তো কখনো বলেনি?
দৈত্য : মানুষ নিজেরা অসৎ। তাই অন্যের সততা চোখে পড়ে না।
ফজলু : আচ্ছা বেশ! বলো আমি কিভাবে তোমাকে সাহায্য করবো?
দৈত্য : আমাকে একটা খাঁটি পিতলের প্রদীপ গড়ে দাও।
ফজলু চিন্তায় পড়ে। কত টাকা লাগবে কে জানে? তবুও কেনো যেনো ফজলু রাজি হয়ে যায়। পরের দিন থেকে দৈত্যও মানুষ বেশে ফজলুর সাথে চা বিক্রি করতে শুরু করে। বেশ কিছুদিন পর তারা কিছু টাকা জমাতে পারে। সেগুলো দিয়ে দোকানে একটা খাঁটি পিতলের প্রদীপ গড়তে দেয়। কিন্তু প্রদীপটি হাতে পেয়ে দৈত্য কছুতেই সে প্রদীপে ঢুকতে পারে না। কারণ প্রদীপের পিতল খাঁটি ছিলো না অধিকাংশই ভেজাল। দোকানি ঠকিয়েছে। এতো টাকা দিয়েও খাঁটি পিতল পাওয়া গেলো না। পিতলের প্রদীপের অনেক দাম। টাকার অভাবে তারা এবার একটা তামার প্রদীপ বানাতে দেয় কিন্তু সেখানেও ঠকে যায় তারা। একটু টাকা বাঁচাতে এবার একটা লোহার প্রদীপ বানানোর সিদ্ধান্ত নেয় দু’জনে। আবার তারা কাজে লেগে পড়ে। কিছুদিন পর লোহার প্রদীপ হাতে পেয়েও তার মধ্যে ঢুকতে পারলো না দৈত্য। খরচ সামলাতে না পেরে তারা একটা অ্যালুমিনিয়ামের প্রদীপ বানিয়ে আনে। কিন্তু সেটিও ভেজাল, তাই দৈত্য ঢুকতে পারে না। এবার দৈত্য বলে বন্ধু এ পৃথিবীর সবই ভেজাল? কিছুই কি খাঁটি নেই তা ছাড়া কত টাকাই তো খরচ করা হলো। এভাবে হবে না। তুমি আমাকে একটা খাঁটি মাটির প্রদীপ অন্তত বানিয়ে দাও। আমি একটু ঘুমাতে চাই। এবার তারা খাঁটি মাটি খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু আফসোস কোথাও খাঁটি মাটি পাওয়া যায় না। সব মাটিতে পলিথিন, প্লাস্টিক, ময়লা, রাসয়নিক সার মেশানো। কোথায় পাবে খাঁটি মাটি? এর পর ফজলুর মাথায় আসে সমুদ্রের তলদেশের মাটি খাঁটি হতে পারে। দৈত্যকে বলে তুমি সমুদ্রের নিচ থেকে মাটি সংগ্রহ করে আনতে পারবে?
দৈত্য : চেষ্টা করলে পারবো।
ফজলু : তাহলে চেষ্টা করো।
দৈত্য তাই করে। সমুদ্রের তলদেশ থেকে খাঁটি মাটি এনে রোদে শুকিয়ে মণ্ড করে ফজলু নিজ হাতে তৈরি করে মাটির প্রদীপ। কী আশ্চর্য! এবার দৈত্য ঠিক ঢুকে পড়লো মাটির প্রদীপে। আর কারো হুকুম ছাড়াই বেরিয়ে এলো একা। দৈত্য আবার তার বিশ্রামের ঘর খুঁজে পেলো। আর কারো গোলাম হতে হবে না তাকে। নিজের ইচ্ছায় ঢুকে যায়, নিজের ইচ্ছায় বেরিয়ে আসে। হোক মাটির ঘর, তবুও সে প্রদীপে দৈত্য খুঁজে পায় অনাবিল সুখ আর প্রশান্তি। যা পিতলের প্রদীপে ছিলো না। যেহেতু মাটির প্রদীপে বাস করে তাই দৈত্য তার কাউকে কোনো সম্পদ দান করার ক্ষমতা হারায়। সেও এখন ফজলুর মতো গরিব। কিন্তু সুখের অন্ত নেই তাদের। সে তার ক্ষুদ্র ক্ষমতা দিয়ে ফজলুকে তার অফিসের হারানো ডকুমেন্টটি পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে। সেটি অফিসের যে লোক সরিয়ে রেখেছিলো তার কেবিনেট থেকে খুঁজে পাওয়া যায় বলে ফজলু নির্দোষ প্রমাণিত হয়। আবার ডাক আসে তার। চাকরিতে যোগ দেয় ফজলু। আর দৈত্য ফিরে তার সুখের নিবাস ছোট্ট মাটির প্রদীপে। সে আর তার দেশে ফিরতে চায় না। সে মাটির প্রদীপে থেকে মানুষের সাথে মিশে তাদের নৈতিকতা সেখাতে চায়। সে ভেজাল মুক্ত এক পৃথিবী গড়তে চায়। তাই বর্তমানে আলাদিনের দৈত্যকে আর কেউ দেখতে পায় না। সে খাঁটি পৃথিবী গড়ার স্বপ্নে মানুষ রূপে মিশে আছে মানুষের মাঝে।

Share.

মন্তব্য করুন