অর্ক ভালো ছেলে। ভালো ছেলেদের বড় গুণ তারা কখনো দুষ্টুমি করে না। নিজ স্বার্থে অন্যের অনিষ্ট করে না। অর্কের আরেকটি বৈশিষ্ট্য, সে কারো শত্রু নয়। তাই সচরাচর কেউ তার শত্রু হতে যায় না। তবে আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। সেই সন্ধ্যেবেলা থেকে একটা নীল মাছি তার পিছু নিয়েছে। শুধু পিছু নিয়েছে বললে ভুল হবে, রীতিমতো জ্বালিয়ে মারছে। একবার অবশ্য জ্বালাতন থেকে নিভৃতির একটা ব্যবস্থা হয়েছিল। মাছিটা আটকা পড়েছিল মরণ ফাঁদে। অর্কের সহায়তায় তার মুক্তি। শত্রুর প্রতি হৃদয়বান হওয়া বুঝি খাল কেটে কুমির আনার সমতুল্য। মাছিটা মরণ ফাঁদ থেকে মুক্তি পেয়েই আবার শুরু করলো সেই উৎপীড়ন।
মঞ্জু মামা এক প্যাকেট রসমালাই এনে রেখেছিলেন ফ্রিজের ভেতর। ফ্রিজ খুলে অর্ক কয়েক চামচ রসমালাই সবেমাত্র কাচের বাটিটায় রাখল। গিটারের তারে আলতো ভাবে আঙুল চালানোর মতো একটা বাতাস কাঁপানো মৃদু শব্দ শোনা গেল। ভন-ভন-ভন। আকারে জিনিসটা মিতু আপার কপালের টিপটার মতো। চোখের পলকে এদিক ওদিক সুনসান চক্কর মারলো জিনিসটা। বাতাসে দু’পাক ঘুরে মুহূর্তে বসে গেল কাচের বাটিটাতে। যেন একটা জঙ্গি বিমান সাঁই করে নেমে পড়েছে বিমানবন্দরে।
ই-বাবা! ওয়াক থু, এ যে গু-মাছি! গুয়ে গুয়ে ঘুরে বেড়ায়। অর্ক হাত নাড়িয়ে মাছিটাকে তাড়িয়ে না দিয়ে পারলো না। হাতের ইশারায় মাছি কি আর খাবারের লোভ ত্যাগ করতে পারে! বাতাসে একটু চরাট শেষে আবার বসলো। তবে এবার কাচের বাটিটাতে নয়, সোজা রসমালাই এর ঝুলের উপর।
মাছিরা ময়লা আবর্জনায় ঘুরেফিরে, তাই তাদের শরীরে নাকি জীবাণু লেগে থাকে সারাক্ষণ। মা বলেছেন, মানুষের রোগ বিসুখের প্রায় নব্বই ভাগই হয় মশা মাছির কারণে। মাছি থেকে সাবধান। মাছিটাকে তাড়িয়ে দিতে অর্ক এবার রসমালাই এর বাটিটা তার হাতে তুলে নিলো। মাছিটা অর্কের হাতের নাড়াচাড়া দেখে উড়ে গিয়ে টেবিল ল্যাম্পের উপর বসলো। জ্বালাতনের শুরু তখন থেকেই। পনেরো সেকেন্ড জিরিয়ে নিয়ে আবার উড়ে এলো অর্কের দিকে। অর্কের কানের পাশে ভনভন করে কয়েকটা চক্কর মেরে যেন জানিয়ে দিলো, এত সহজে ছাড়ছি না তোমাকে।
কাটা চামচের অগ্রভাগ দিয়ে খচ করে খোঁচা মেরে একটা রসমালাই মুখের ভেতর ভরেছে অর্ক। মাছিটা অর্কের মুখে, ঠোঁটের পাশে বিমান নামিয়েছে এবার। ছি ছি ছি ছি, কী নোংরা গো, যেন মাছিটার পায়ের পাতায় গু লেগে আছে। কেমন একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। মুখ নাড়া দিতেই মাছিটা উড়ল এবং মাত্র তিন সেকেন্ড পর আবার বসলো। তবে এবার অর্কের নাকের ডগায়।
অর্ক রীতিমতো রেগে গিয়ে চটাশ করা শব্দে চড় মেরে মাছিটাকে ঘায়েল করতে চাইল। মাছি কি আর এত বোকা! মহা কৌশলে ফসকে গেল সে। রেগে যাওয়ার খেসারত দিতে হলো অর্ককে। নাকে চোট লেগেছে তার। মাছিটা গিয়ে বসলো চেয়ারের হাতলে। সামনের সারির পা দুটা দিয়ে শুঁড় ঘষে যেন একটা শক্ত প্রস্তুতি নিয়ে নিচ্ছে।
অর্ক মাছিটার দিকে তাকিয়ে বলল- “ভালো হচ্ছে না কিন্তু।”
মাছিটার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই অর্কের নিষেধাজ্ঞার প্রতি। বেয়াদবির একটা সীমা থাকে, মাছিটার যেন সেই সীমানা ফলকটা নেই। অর্কের হাতের মাঝেই রসমালাইয়ের বাটিটা, অথচ মাছিটা যে সর্বপ্রকার ভয়ের মাথা খেয়ে চরম সাহসিকতায় বাটিটাতেই গিয়ে বসলো।
অর্ক এবার বলল- “মাছি, তুমি কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছ। এর ফল ভালো হবে না বলে দিলাম।”
মাছির যদি মানুষের মতো শব্দ করে হাসার ক্ষমতা থাকতো, তবে হয়তো এতক্ষণে অর্কের কানের পর্দা ফেটে যেত হাসির শব্দে। মাছিটা শব্দ করে আসেনি, তবে তিড়িংবিড়িং নাচার ছন্দে পাখা নাচিয়ে জানিয়ে দিয়েছে সে যে কত ফুর্তিতে আছে। মাছির এত বড় স্পর্ধা দেখে অর্কের গা জ্বলে গেল।
“তুমি কি আমার কথা শুনবে না! নাকি অন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে?” – অর্ক বলল।
মাছিটা জবাব দিল – “তুমি আবার অন্য ব্যবস্থা কী করবে! এইটুকু ছেলে, আমি তোমাকে ভয় পাই নাকি!”
মাছির তিরস্কার শুনে অর্কের ভেবাচেকা খাওয়া অবস্থা। সে জানে রেগে যাওয়া হেরে যাওয়ার লক্ষণ। তাই সে ঠিক করল মাছিটার উপর রাগ করবে না, মাথা খাটিয়ে কার্য হাসিল করবে। কৌশলে স্বার্থ উদ্ধারই বুদ্ধিমানের কাজ।
চামচের ডগায় লেগে থাকা রসমালাইয়ের একটা ফালি মুখে নিতে নিতে অর্ক বলল – “তোমার কি খুব খিদে পেয়েছে?”
মাছিটা জবাব দিল না, শুধু সামনের পা দুটি দিয়ে চোখের উপর আলতো ভাবে স্পর্শ করল।
বাটি থেকে দুই ফোঁটা রসমালাই টেবিল ক্লথের উপর ফেলে দিয়ে অর্ক বলল – “এই নাও। আরাম করে খাও। তবু আমাকে আর জ্বালিও না।”
মাছিটা টেবিলের উপর একপাশে নেমে এলো, তারপর ছুটে গেল ফোঁটা দুটার দিকে। কিন্তু শুঁড় দিয়ে একবার পরীক্ষা করেই আবার ফিরে এলো।
অর্ক বলল – “কি! খাবার পছন্দ হয়নি? আবার কী চাও?”
জবাবে মাছিটা কথা বলল না। উল্টো উৎপাতের পরিমাণ দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়িয়ে দিল। এইবার যেন কানের ছিদ্র দিয়ে মস্তিষ্কে ঢুকবে, কিংবা নাকের ছিদ্র দিয়ে সোজা ফুসফুসের ভেতর।
“বিরক্ত করছ কেন? খাবার দিলাম, খেতে চাও না! আমাকে উত্ত্যক্ত করে কি তোমার খুব ভালো লাগছে?- অর্ক বিরক্তির স্বরে জানতে চাইল।
মাছিটা জবাব দিল না, তবে ভনভন করে উড়ে গিয়ে অর্কের কপালের ঠিক মাঝখানটায় বসলো। কপালের এক পাশ থেকে ওপাশে ছুটাছুটি করে যেন জানিয়ে দিতে চাইল- “তোমাকে অশ্বস্তি দিতেই তো আমার এখানে আসা।”
যারা কথা কম বলে, তারা ভালো মনের অধিকারী হয় না। কথায় আছে স্পষ্টভাষী শত্রু নির্বাক মিত্র অপেক্ষা ভালো। মাছিটা এবার অর্কের কপাল থেকে উড়ে এসে রসমালাইয়ের বাটিতে বসতে চেয়েছিল। কিন্তু বসতে গিয়ে ঘটলো বিপর্যয়। রসমালাইয়ের ঘন রসে মাছিটার পাখা দুটি এটে গেল। মাছিটা পড়ে গেল ভীষণ বিপদে।
অর্কের মুখে তৃপ্তির হাসি- “এবার কী করবে বেটা! এখন দেখবো কেমন করে বিরক্ত করো আমাকে।”
মাছিটা কাঁদোকাঁদো ভাবে বলল- “আমাকে মুক্ত করে দাও। আমি আর দুষ্টুমি করবো না। আমাকে মুক্ত করে দাও।”
শত্রুর প্রতি সহানুভূতি দেখানো মহত্ত্বের উদাহরণ। মাছির বিপদ দেখে অর্কের মনে মায়া জাগলো- “তোমাকে মুক্ত করে দিতে পারি, তবে শর্ত আছে একটা। আমাকে আর জ্বালাতন করতে পারবে না।”
মাছি তড়িঘড়ি করে বলতে লাগলো- “আমি আর তোমাকে জ্বালাতন করবো না। সত্যি সত্যি সত্যি, একেবারে তিন সত্যি। এই যে মাথা ছুঁয়ে বলছি, আমি আর তোমার সাথে দুষ্টুমি করবো না। আমাকে মুক্ত করে দাও।”
“মাথা ছুঁয়ে বলতে হবে না। প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে কিছু করতে নেই। কারণ সিদ্ধি সাধন শেষে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। এই যে আমি তোমাকে মুক্ত করে দিচ্ছি।”- বলতে বলতে অর্ক মাছিটাকে আলতো ভাবে মুক্ত করে দিল। মাছিটা মুক্ত হয়ে বিছানার চাদরের ওপর গিয়ে বসলো।
অর্ক জানত মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ। তাই সে মাছিটার কথাও বিশ্বাস করেছিল। মাছিটাকে মুক্ত করে দিয়েছিল। কিন্তু মাছিটা প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেল। সে আবার সেই দুষ্কৃতি শুরু করল। নাকে মুখে একটা-দুইটা ছুঁ মেরে যেন বোঝাতে চাইলো তার চেয়ে বড় বীর আর কেউ নেই।
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ফল হয় ভয়াবহ। মাছিটার যন্ত্রণায় অর্ক যখন অতিষ্ঠ, তখন মাছিটা গিয়ে জানালার গ্রিলে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই জানালার গ্রিলে ছিল একটা ক্ষুধার্ত টিকটিকি। টিকটিকি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী মাছিটাকে শিকারে পরিণত করে খেয়ে ফেলল। মাছিটা টিকটিকির শিকারবন্দী হয়ে অর্কের কাছে পরিত্রাণ চেয়েছিল। কিন্তু অর্ক তাকে সাহায্য করেনি। কারণ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী শত্রুর চেয়েও ঘৃণিত।

Share.

মন্তব্য করুন