: অ্যাকশন বিগ.. রেডি সুন..
: ওকে বস।
: লোকেশন.. টাইম প্লিজ।
: ফলো জিপিআরএস..
: ওভার..
স্মার্টফোনের টেলিগ্রাম অ্যাপে রাকিব আর গ্যাং লিডার আনিসের কনভারসেশন শেষ হলো।
ওদের গ্যাং এর নাম চিপা মাইর। গ্যাং লিডার আনিস। কিন্তু… না। গ্যাং এ আনিস নামের কেউ নেই। নেই রাকিব নামেরও কেউ। মা-বাবার দেয়া সুন্দর নামগুলো সব বদলে কিশোর গ্যাং এ নতুন নতুন নামে তৎপর ওরা। গ্যাং লিডার আইজ্যাক বস্। সবাই বস্ বলেই ডাকে আনিসকে। রাকিবদের গ্যাং নেম রবিন হুড। আরো আছে তারিক মানে টারজন, প্রতুল চন্দের নাম প্রতাভ সিংহ নামে সিংহ। ছাত্র হিসেবে কেউ খারাপ নয়। তবে বইয়ের পড়ার চেয়ে বেশি মনোযোগ চ্যাটিং আর ফাইটিংয়ে। বসের ওপরেও আছেন বড় ভাই সবচেয়ে বড় বস্। তিনি এলাকার বড় নেতা। নাম বলা নিষেধ। তার সাথে শুধু গ্যাং লিডার আইজ্যাক বস্ই যোগাযোগ করতে পারে। গ্যাং চালাতে যা লাগে সব ঐ বড় ভাই সাপ্লাই দেন। মানি, পানি মোটরসাইকেল, কার, দেশি নাট-বল্টু, বিদেশি মাল যা চাই।
: বস লোকেশন আন সিন।
: ওকে, জিপিআরএস অপ.. সো স্পট ওয়ান কাম সুন।

১৫ মিনিটের মধ্যে রবিন হুড স্পট ওয়ানে হাজির হয়। টারজন আর সিংহ এখনো আসেনি। সুদীপ মানে সুপারম্যানেরও দেখা নেই। বস রবিন হুডের দিকে সিগারেট এগিয়ে দেয়।
: না, আমার মাথা ঘোরে।
: নামেই রবিন হুড তুই, আসলে একটা গারল বুড্ডু। অপারেশনের আগে প্রতি টানে সাহস বাড়ে..
: বস, আমার সাহস এমনি অনেক।
: মুখে মুখে কথা, বিদেশি মালটা কিন্তু সাথেই আছে, এক্কেবারে ফুটা কইরা দিবো।
: ঠিক আছে।
রবিন হুড আর কথা বাড়ায় না। বসের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে, হালকা করে কয়েক বার টান দিয়ে ফেলে দেয়।
: আরে বড় ভাইয়ের কাছে গেলে তো…
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই সিংহ ও সুপারম্যানের আগমন ঘটে। অতএব আর দেরি নয়। শুরু হয় অপারেশনের প্ল্যান।
: বস, বলেন জরুরি তলবের কারণ কী?
: সবাই মন দিয়ে শোন, একটা পোলা বাড় বাড়ছে, ছাঁইট্টা দিতে হবো।
: চিপা মাইর না ফাইনাল? সিংহ জানতে চায়।
রবিন হুডের প্রশ্ন: কোন পোলাটা?
গম্ভীর গলায় আদেশ দেয় বস্: অন টেলিগ্রাম, ছবি সবাইকে পাঠানো হয়েছে।
ছবি দেখে টারজনের কপালে ভাঁজ পড়ে। সে মনে মনে স্বগতভাবে বলে: ‘এই পোলা, নামাজি, ভালো ছেলে।’ কিন্তু উচ্চারণের সাহস পায় না।
মুখ খোলে রবিন হুড: তা পোলাটা কি করছে, বস্?
: আমার গ্যাং-এ ওরে চাই। কিন্তু পাত্তা দেয় না…
বসের কথা শেষ হতেই টারজন বলে: ও তো মেসে থাকে গাঁইয়া পোলা, নামাজি। ওরে দিয়ে কী হবে? ওর নাম শাহীন।
: ‘বড় ভাই চায়। মেসের পোলাপান গ্যাং এ থাকা ভালো। পিছুটান নেই। বেশি কাজে লাগানো যায়। কিন্তু ব্যাটা আমারে পাত্তা দেয় না।’ রাগের সাথে বলে বস্।
রবিন বলে : কী কয়?
: পড়ালেখা ছাড়া অন্য কিছু করার তার নাকি সময় নাই।
: ‘তা এখন আমাদের কাজটা কী?’ টারজেন প্রশ্ন করে।
: চিপা মাইর দিয়ে রাজি করাতে হবে।
: ‘আস্তে আস্তে। আগে রেকি করতে হবে। কোন সময় ওরে ধোলাই দিলে কাক পক্ষী টের পাবে না।’ ধীরে ধীরে কথাগুলো বলে বস্।
: ‘তা রেকি করার কাজটা করবে কে?’ জানতে চায় টারজেন
: ‘তুই করবি।’ দাঁতে মুখ চেপে উত্তর দেয় বস্। তারপর মিটিং শেষে যে যার পথে চলে যায়।

টারজেন যতই ওর কাছাকাছি হচ্ছে। ততই বদলে যাচ্ছে। তার মন কিছুতেই মানতে চাচ্ছে না- শাহীনের মতো একটা ছেলেকে চিপা মাইর দিতে। সারা দিনের কাজকর্ম আর লেখাপড়া দেখে ওর মনটা শাহীনের জন্য নরম হয়। সে একদিন শাহীনের মেসে যায়।
: ‘আসসালামু আলাইকুম।’ বলে শাহীন টারজনকে বসতে হবে। তারপর জানতে চায়-
: কী ব্যাপার হঠাৎ?
টারজন বলে: তেমন কিছু না, এমনি দেখতে এলাম।
: ভালো। বসো মায়ের পাঠানো মুড়ির মোয়া আর নারকেলের পিঠা খাও। খুব মজা।
: না না। ওসব আমি খাই না।
: ‘আরে খাও। তোমাদের পিৎজা, বার্গারের চেয়ে খারাপ লাগে না।’ বাটিতে কয়েকটি পিঠা ও মোয়া ওর দিকে বাড়িয়ে দেয়। ইচ্ছা না থাকলেও টারজেন মুখে দিয়ে বলে, বা খুব মজা তো? তুমি পড়ালেখার পর কী কর?
: দুইজন ছাত্র পড়াই।
: কত টাকা পাও?
: এই আট হাজার?
: বাড়ি থেকে টাকা দেয় না?
: সব সময় পারে না। আমার বাবা কৃষক। ফসল ভালো হলে, বিক্রি করে টাকা দেয়। বন্যা-খরা হলে পারে না। ফসলের দাম কম হলেও কষ্ট হয়। তাই…
: নিজের খরচ নিজেই চালাও। ভালো। আজ আসি আবার আসবো।

চিপা মাইর কিশোর গ্যাং-এ সদস্য আরো বেড়েছে। তাতে কি। শাহীনকে তারা পাচ্ছে না। পোলাটা কোনো কথাই শোনে না, টাকা দিতে চাইলে কয় মাস্তানি, চাঁদাবাজির টাকা হারাম। তাই আনিস, মানে বসের মাথা ঠিক নেই। বড় ভাইয়ের এক কথা ওর গ্যাং এ শাহীনকে নিতেই হবে। কিন্তু পোলাটার এক কথা লেখাপড়া করতে গ্রাম থেকে এসেছে। মাস্তানি করতে না। আনিস আবার সবাইকে ডাকে। টেলিগ্রামে মেসেজ পাওয়ার সাথে সাথে সবাই স্পট টু-তে হাজির। ওরা ঘন ঘন স্পট বদলায়। বড় ভাইয়ের নির্দেশ, এক স্পটে বেশি সময় থাকতে নেই। পুলিশ ঝামেলা করতে পারে।
আনিস বলে: শোন আজ ওরে ধরে স্পট ওয়ানে আটকিয়ে ধোলাই দিয়ে রাজি করাতে হবে।
: ‘ঠিক আছে, বস্।’ টারজন ছাড়া সবাই জোরেশোরে বলে। তারপর সবাই অপারেশনের জন্য তৈরি হয়। ওদের এই অপারেশনের নাম ‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই’। সংক্ষেপে ‘মাওনাই’।
টেলিগ্রামের মেসেজ অপশনে ঝড় শুরু হয়:
: ‘মাওনাই’, খিলক্ষেত..
: ওকে।
: টাইম ১৯:৪৫ মিনিট।
: ওকে।
: অনলি নাট বল্টু, নো মাল।
: ‘ওকে, মাওনাই গেঁয়ো, নো নিড মাল নাট-বল্টু এনাফ।’ যথাসময়ে দেশি হালকা অস্ত্র নিয়ে ওরা সবাই হাজির। কারণ ওরা জানে নাট-বল্টু মানে দেশি অস্ত্র। আর মাল হলো বন্দুক, পিস্তল।
সন্ধ্যা রাতের টিউশনি শেষে বের হওয়ার সাথে সাথে শাহীনের সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকে টারজন। তারপরও একটি নির্জন স্থানে এসে বাকিরা তর্ক জুড়ে দিয়ে মারতে শুরু করে। জায়গাটা নির্জন। তাই কেউ এগিয়ে আসে না। শাহীন জ্ঞান হারালে একটা রিকশা ডেকে ওকে তুলে স্পট ওয়ানে নিয়ে যায়। জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এমন সময় শাহীনের পকেটের মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। প্রথমে ফোনটা কেউ ধরতে চায় না। পরে ইচ্ছা না থাকলেও আনিস ফোনটা ধরে। অপর প্রান্ত থেকে একটি মেয়েলি কণ্ঠস্বর:
‘বাবা, শাহীন, শাহীন। আমি তোমার মা বলছি। কথা বল বাবা। রাগ করেছিস না। তোর বাবা টাকা পাঠাতে পারেনি বলে, রাগ করিস, না বাবা। ধান উঠলেই টাকা পাঠাবে। ভালো করে লেখাপড়া করবি। নামাজ-কালাম পড়বি। খারাপ ছেলেদের বন্ধু বানাবি না, বাবা। লেখাপড়া শিখে তোকে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে…।’ আনিস কি করবে বুঝতে পারছে না, শাহীনের মায়ের মায়াবী কণ্ঠ শোনে তার চোখে পানি আসে, বলে: ‘আমি ভালো আছি মা, পরে কথা বলবো।’ ফোনটা কেটে দেয়।
আনিসের মা ওদের ছেড়ে চলে গেছে, সেই শৈশবে। বাবা সারাদিন ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন। ওর মা ওর বাবাকে ছেড়ে বাবার বন্ধু সুজন সাহেবকে বিয়ে করে পাড়ি জমিয়েছেন আমেরিকা। ক্যাসিনো ক্লাব আর আড্ডা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, জন্মদিনে রুটিন উইশ ছাড়া ফোন করার সময় পান না। তাও মনে হয় সিগারেট নয় তো নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন। মায়েরা এমন মায়াবী ভাষায় কথা বলেন…! আনিস আর ভাবতে পারে না। শাহীনকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতেই হবে। সে তার গ্যাং বস্ পরিচয় ভুলে যায়। ফিরে আসে তার কৈশোরদীপ্ত নতুন জীবনে। বন্ধুদের ডেকে বলে, ‘তারেক, প্রতুল, রাকিব, সুদীপ্ত, হারিআপ! অ্যাম্বুলেন্স, অ্যাম্বুলেন্স…! শাহীনকে বাঁচাতে হবে ওর মা ডাকছে…।’

Share.

মন্তব্য করুন