ছেলেটির নামই জিনিয়াস। ওর চিন্তা ও কাজগুলো একটু আলাদা। যেমন: গত পরশু প্রিয় আমগাছের তলায় বসে জিনিয়াস চিন্তা করল, পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে মানা যায়, কিন্তু সোহেল মামার দোকানের সিঙ্গারার সাইজ ছোট হয়ে আসছে মানা যায় না! পরদিন বন্ধুদের নিয়ে সোহেল মামাকে তাদের কষ্টের কথা জানাল। সুন্দর হাতের লেখায় একটি প্ল্যাকার্ড তৈরি করল। তাতে লেখা, ‘এত সুন্দর সিঙ্গারা, আর ছোট চাই না, আর ছোট চাই না।’
ছোটদের আবদার মামা রাখলেন। আজ তিনি বড় বড় সিঙ্গারা বানিয়েছেন। এতে মামার লোকসান হবে কিন্তু ছোটদের মুখের হাসির জন্য তিনি সব করতে রাজি। মামা সিঙ্গারা বানিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলেন। কিন্তু মামা জানেন না, আজকে জিনিয়াস আসবে না। কারণ, আজ তার মন ভীষণ খারাপ। তাদের বাসার আমগাছটি কেটে ফেলা হবে। গ্রামের সবাই এই কাঁচামিঠা আমগাছ সম্পর্কে জানে। কাঁচা অবস্থাতেই আমগুলো মিষ্টি; আর পাকলে মধুর মতো! এত স্বাদ বলেই যত সমস্যা। আম চুরি করতে আশপাশ থেকে অনেক লোক রাতের আঁধারে জিনিয়াসদের বাড়ির উঠানে চলে আসে। অনেক সময় তাদের মধ্যে খারাপ মানুষ অর্থাৎ চোরের দলও থাকে। একবার চুরি করতে গিয়ে ধরাও পড়েছিল দুই চোর। এছাড়াও আম পাকলে অনেক দূর পর্যন্ত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পাকা আমের তীব্র সুমধুর গন্ধে অসংখ্য বাদুড় এসে হাজির হয়! খারাপ মানুষ আর বাদুড়ের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে জিনিয়াসের বাবা আমগাছটি কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জিনিয়াস ক্লাসে হাজির হলো ঠিকই কিন্তু পড়ায় তার মন বসল না। শিল্পী ম্যাডামের ক্লাস চলতে থাকল আর জিনিয়াস মনে মনে আমগাছ নিয়ে নানা ঘটনা কল্পনা করতে থাকল। প্রতি গ্রীষ্মকালেই ঝড় হয়। ঝড় থামলে জিনিয়াস সোজা চলে যায় আমগাছ তলায়। ঝড়ের পর জমে থাকা পানিতে ভেসে থাকে গাছ থেকে পড়া অসংখ্য আম। মধুর মতো স্বাদের ডাঁসা ডাঁসা আম কুড়াতে তার ভীষণ ভালো লাগে। যখন ঝড় থাকে না, তখন মাঝেমাঝে বড় বোনের সঙ্গে কোটা নিয়ে হাজির হয় আম পাড়তে। কোটার সাহায্যে আম, কুল, আমড়া ইত্যাদি ফল গাছ থেকে সহজে পাড়া যায়।
জিনিয়াসের ছোট্ট একটি খাতা আছে। সেই খাতায় নিজের মনের কথাগুলো লিখে রাখে। আমগাছের ছায়ায় বসেই এতদিন সেগুলো লিখেছে। গাছটির ছায়ায় না বসলে তার লেখার ভাব আসে না। মাঝেমাঝে গাছের ডালে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবে। যেমন: মামার দোকানের সিঙ্গারার সাইজ ছোট হয়ে আসার ভাবনাটিও ভেবেছিল আমগাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা অবস্থায়। আমগাছটি না থাকলে ওর অনেক কষ্ট হবে।
স্কুল থেকে বাসায় ফিরে জিনিয়াস দেখতে পেল, আমগাছ কাটা হয়ে গেছে! মধুর মতো স্বাদের আম আর কখনো পাওয়া যাবে না, গাছটির ছায়ায় বসে আর কখনো লেখা যাবে না, ডালে বসে আর কখনো ভাবা যাবে না- এসব ভাবতেই জিনিয়াসের চোখে পানি চলে এলো। কষ্ট পেয়ে সে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।
বাসার বাইরে জিনিয়াসের বন্ধুরা পাটকাঠি নিয়ে খেলছে। মজার খেলা! পাটকাঠির ভেতরটা কোল্ড ড্রিংক্স খাওয়ার জন্য আমরা যে স্ট্র ব্যবহার করি, সেই স্ট্র-এর মতো ফাঁপা। তাই ফাঁপা পাটকাঠির এক মাথায় টিকটিকির ছোট্ট ডিম রেখে অন্য মাথা থেকে ফুঁ দিলে ডিম ওপরে উঠে যায়; আবার নেমে কাঠির মাথায় বসে পড়ে! তবে ফুঁ দিতে হয় ঠিকঠাক। এই মজার খেলাটি জিনিয়াস ভালো পারলেও আজ সে খেলল না। একটি পাটকাঠি হাতে নিয়ে হেঁটে চলে যেতে থাকল। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাস?’ জিনিয়াস কোনো উত্তর দিল না। কারণ, কোথায় যাচ্ছে তার নিজেরই জানা নেই।
একা একা হাঁটতে হাঁটতে একসময় জিনিয়াস ভূত-জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। লোকে বলে এই জঙ্গলে ভূত-পেত্মীর আস্তানা আছে। তাই সবাই এটিকে ‘ভূত-জঙ্গল’ নামে চেনে। কেউ ভুলেও এদিকে আসে না। জিনিয়াসের মন ভালো নেই; তাই তার মধ্যে ভয়ভীতি কিছুই কাজ করছে না। জঙ্গলে কিছুক্ষণ হাঁটার পর তার চোখে পড়ল একটি খুদে জামগাছ। গাছটিতে থোকায় থোকায় ধরে আছে কালো, লাল ও সবুজ রঙের জাম। জিনিয়াস কিছু জাম পেড়ে খেল। হঠাৎ দেখল, পাশের একটি গাছে একদম মাটির কাছাকাছি ঝুলে আছে খুদে মৌমাছির মৌচাক। সবচেয়ে ছোট আকারের মৌমাছিকে খুদে মৌমাছি বলা হয়। খুদে মৌমাছির মৌচাকটি দেখে জিনিয়াসের মাথায় একটি আইডিয়া চলে এল!
মৌমাছিরা যাতে টের না পায়, সেজন্য জিনিয়াস আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে মৌচাকের নিচে চলে গেল। হাতের পাটকাঠির এক মাথা ধীরে ধীরে মৌচাকে ঢুকিয়ে দিল। স্ট্র-এর মতো পাটকাঠির অন্য মাথা দিয়ে বিন্দু বিন্দু মধু জিনিয়াসের মুখের মধ্যে আসতে থাকল। আহ, অবিকল সেই আমের মতো স্বাদ! জিনিয়াস চোখ বন্ধ করে সেই আমগাছের কথা কল্পনা করতে করতে আমের মতো স্বাদের মধু খেতে থাকল। বাড়িফেরার সময় জিনিয়াস ভাবল, মৌচাকের ঘটনাটি কাউকে জানাবে না। প্রতিদিন সে ভূত-জঙ্গলে যাবে এবং তার আবিষ্কৃত ফর্মুলায় (পাটকাঠি দিয়ে) চুপ করে খেয়ে আসবে প্রিয় আমগাছের পাকা আমের স্বাদের মধু! তোমরা কেউ যদি জিনিয়াসের ব্যক্তিগত মৌচাকটি দেখতে চাও, তাহলে ওকে আগে খুঁজে বের করে ওর সঙ্গে মধুর বন্ধুত্ব তৈরি করতে হবে।

Share.

মন্তব্য করুন