বাহাদুরাবাদ ঘাটের পাশেই, আকাশদের আলিশান বাড়ি। গ্রামের লোকজন ওদের খুব সম্মান আর সমীহ করে। বাবা-মা’র আদরে বেড়ে ওঠা একমাত্র ছেলে আকাশ। এই পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত কখনও সামান্যতম কষ্টের মুখ দেখেনি। মা মাঝে মাঝে মজা করে জিজ্ঞেস করেন, আমি আর তোর আব্বু হঠাৎ মরে গেলে তুই কি করবি?
চোখের পানি ফেলে আকাশ বলে, মানুষের বাসায় কাজ করবো।
আম্মু ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন, না বাবা। আল্লাহ যেন এমন নসিব তোর না করেন।
কিন্তু হঠাৎ করেই কী যেন কি হয়ে যায়। আকাশ ওর দাদীর সাথে একদিন, ফুপুবাড়ি ময়মনসিংহে বেড়াতে যায়। এক দিনের জন্য। পরদিন বাড়ি ফিরে দেখে, কোথায় বাড়িঘর কোথায় কী? যমুনা নদীর পানি সেখানে থৈ থৈ করছে। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে। বাড়িতে যারা রাতে ঘুমিয়ে ছিল, কেউই আর বেঁচে নেই। আকাশের মা-বাবা দু’জনের লাশ অনেক দূরে ভেসে উঠেছিল। নিয়ে এসে মাটির বুকে দাফন করা হলো। দাদীর হাত ধরে আকাশ চলে এলো সেই ফুপুর বাড়িতেই। প্রথমদিকে ক’দিন আদর-যত্ন করলেও, আস্তে আস্তে ফুপুর ছেলে-মেয়ে, ফুপা, এদের ব্যবহারে আকাশ আর তার দাদীর খুব কষ্ট হতে থাকল। দাদী সাইদননেছা একদিন তাই আকাশের হাত ধরে চলে এলেন সেই বাড়ি ছেড়ে। স্বামী বেঁচে নেই। দু’ছেলে-মেয়ের মধ্যে ছেলেটাতো বৌসহ নদীভাঙনেই মারা গেল। নিজের বাপ-দাদার ভিটেবাড়িও ভাইদের ছেলে-পুলেরা চষে খাচ্ছে। তাই, আকাশের হাত ধরে, সাইদননেছা খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালেন। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ধরনা দিতে লাগলেন, কাজের জন্য। এক সময় কাজ জুটে গেল। কিন্তু, বাচ্চাসহ কেউ রাখতে চায় না। বললেন,
: ছোটখাটো ফরমায়েশও করতে পারবে। আমার নাতিটারে শুধু একটু খাইতে আর ঘুমাইতে দিয়েন।
আকাশ আর ওর দাদীকে অবশেষে একজন গৃহিণী রাখতে রাজি হয়। আকাশ সারাদিন বাসায় থাকে না। দাদী শিখিয়ে দিয়েছে, টোকানো কাগজ বিক্রি করে কিছু আয় করতে। তাই, ফুটপাথ, ডাস্টবিনের আশপাশে ঘুরে কাগজ টোকায়। ঘুরতে ঘুরতেই বস্তির এক মহিলার সাথে দাদীর পরিচয় হয়েছিল। সেই মহিলা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল কাগজ টুকানোর। ছোট্ট আকাশের পা চলতে চায় না। কখনোতো সে এত পরিশ্রম করেনি। মাঝে-মধ্যে বুক ভাসিয়ে কাঁদে। ‘আম্মু-আব্বু, তোমরা কেন আমাকে এভাবে ফেলে চলে গেলে? নদী কেন এমন করে সবকিছু ভেঙে দিয়ে যায়? নদীর কোনো মায়া-দয়া নেই?’ রাতে দাদী ওকে বুকে জড়িয়ে ঘুমায়। ঘুমানোর আগে, দাদী তাকে অনেক কথা বলে। কাঁদে আবার আকাশকে সান্ত¡নাও দেয়।
: দাদু, তোকে আমি পড়াশোনা করাবো দেখিস। তোর ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দেব না। আমিই কি জানতাম, বুড়ো বয়সে আমাকে এভাবে অন্যের বাসায় খেটে খেতে হবে? তোর নানা-নানী বেঁচে থাকলে, হয়তো তোর জন্য আমাকে এভাবে ভাবতে হতো না। ধৈর্য ধর ভাইয়া, সোনা আমার।
: জানো দাদী, সারাদিন হাঁটতে আমার খুব কষ্ট হয়।
ওর কথায়, সাইদননেছা কেঁদে ফেলেন।
: কষ্ট তো হবেইরে দাদু। তুই যে আমাদের সবার আদরের ছিলি। কষ্ট করতে করতে দেখবি, একদিন সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে।
: কিভাবে দাদী?
: তোকে আমি স্কুলে ভর্তি করে দেব। এই বাসার মালিকের স্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। তাকে আমাদের অবস্থার কথা খুলে বলেছি। উনি সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন। সরকারি প্রাথমিক স্কুলে তোকে ভর্তি করে দেব। ভালো করে পড়াশুনা করবি। আমার বেতনের টাকা জমিয়ে তোকে জামা কিনে দেব। দেখবি, একদিন আবার আমাদের সব হবে ইনশাআল্লাহ।
: সত্যি দাদী? দেখো আমি খুব ভালো করে পড়াশুনা করবো। তোমার সব কথা শুনবো।
: তুইতো আমার লক্ষ্মী দাদু।
আকাশের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে, চোখ মুছে দাদী ঘুমাতে চেষ্টা করেন। বুড়ো শরীর। তাতে আবার সারাদিনের পরিশ্রম। তাই ঘুম আসতে তার দেরি হয় না। আকাশও এক সময় দাদীর বুকে মুখ রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। ফ্লোরে, শুধু ছেঁড়া কাঁথা দিয়ে পাতা, শক্ত বিছানায় ঘুমাতে ওদের এখন আর তেমন কষ্ট হয় না। অভ্যাস হয়ে গেছে। ক’দিন পর, সত্যিই আকাশ বই নিয়ে, নতুন জামা পরে স্কুলে যায়। এই ক’দিন রাতে ঘুমানোর আগে, দাদীর কাছে বাংলা, ইংরেজি, অংকের অক্ষরগুলো সব চিনে নিয়েছে। কিছু তো আম্মু-আব্বুর কাছেই শিখেছিল। তাই খুব একটা সমস্যা হয়নি। আকাশের চোখে এখন নতুন দিনের স্বপ্ন। একদিন সে পড়াশুনা করে মস্তবড় মানুষ হবে। গরিব হলে কেমন কষ্ট, তা সে প্রতিটা মুহূর্তে নতুন করে বুঝতে শিখছে। তাই, আকাশ ভাবে, বড় হয়ে সে এমন কিছু করবে, যাতে এদেশের গরিব মানুষদের কিছুটা হলেও উপকার হয়। পড়াশুনায় অনেক মনোযোগী হয় সে। শিক্ষকরাও তাই, সবাই এখন ওকে আদর করে। একদিন সে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠে। বৃত্তি পরীক্ষার আগে হেডস্যার ওকে ডেকে বললেন, তুমি যদি বৃত্তি পাও, তোমার লেখাপড়ার সমস্ত দায় দায়িত্ব আমিই নেব।
শুনে আকাশের ভীষণ ভালো লাগলো। আকাশ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে করে বৃত্তি পরীক্ষা দিল। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেল। রেজাল্টের দিন স্যার ওকে আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি তার কথা রেখেছেন। আকাশের পড়াশুনার সমস্ত খরচ তিনিই দেন। আকাশ এখন ঢাকার আইডিয়াল স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। আকাশকে ঘিরে, দাদী সাইদননেছার বুকে অনেক আশা। একদিন আকাশ তার মুখ উজ্জ্বল করবে। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে নাতিকে বুকে জড়িয়ে স্বপ্ন দেখেন আকাশের দাদী। আর আকাশ স্বপ্ন দেখে, একদিন সে মস্তবড় মানুষ হবে। মানুষের মত মানুষ।

Share.

মন্তব্য করুন