রাফিদের বাড়িটা একটা বাগান বাড়ি। রাফির বাবা একজন গাছপ্রেমিক মানুষ। আমগাছ-জামগাছ-তেঁতুলগাছ না, তিনি সবসময় পড়ে থাকেন ফুলগাছ নিয়ে। বাগানে কতো রকমের ফুলগাছ আছে তিনি নিজেও জানেন না। সময় পেলেই তিনি নার্সারিতে ঢুঁ দেন। নতুন কিছু পেলে আহ্লাদে মেতে ওঠেন। তাকে কখনো নার্সারির মালিকের সাথে গাছের দরদাম করতে হয় না। নতুন কিছু এলে নার্সারির মালিকেরা ফোন দেন। ফোন পেলে এক মিনিটও দেরি করেন না রাফির বাবা। গাড়ি হাঁকিয়ে সোজা চলে যান নার্সারিতে।
এই বিরাট বাগানে শুধু গোলাপ প্রজাতির সংখ্যাই এক ডজনের মতোন। একই সারিতে গোলাপ গাছগুলো বাহারি রঙ নিয়ে ঘাড় নাড়াতে থাকে। বসন্তের নতুন বাতাস পেলে তো কথাই নেই। সব পাপড়ি খুলে দিয়ে ঝলমলে চেহারায় কথা জুড়ে দেয়। বাতাসের সাথে ফুলেরা এতো কী কথা যে বলে ওরা ছাড়া কেউ জানে না। সপ্তাহখানেক আগে পল্লবী নার্সারি থেকে একজোড়া ফুলের গাছ এনেছিল বাবা। চিরল চিরল পাতাভরা গাছ দুটো। একই গাছে দুই রকমের ফুল। লাল আর হলুদে রং। ফুলগুলোও দেখতে অদ্ভুত সুন্দর। নার্সারির মালিক বলেছিল ওগাছগুলো নরওয়ে দেশের। দামও ধরেছিল ক’গুণ বেশি। দাম বেশি হলে কী হবে। বাবার আনন্দ যেন ঘুর্ণিঝড়ের খড়কুটোর মতোন উড়তে থাকে।

ইশকুল থেকে ফেরার পর রাফির কোনো কাজ থাকে না। স্যার পড়াতে আসেন সাতটার দিকে। মাঝখানে তার অখ- সময়। বাবা কখনো কখনো রাফির জন্য গাদা গাদা বই নিয়ে আসেন। নীতিকথার বই, ঈশপের গল্প, নাসিরুদ্দিন হোজ্জা, সায়েন্স ফিকশন, আরও কতো রকমের গল্প বই!
রাফিদির বাগানের একপাশে একটি লোহার দোলনা আছে। দোলনাটা অসম্ভব মজবুত এবং তার শিকলগুলোও বেশ লম্বা। পায়ে জোর এনে কেউ উড়তে চাইলে অনেক উপরে উঠতে পারে। কিন্তু ওড়ার মতোন রাফির পায়ে অত জোর নেই। ও ওখানে বসে বসে বেশিরভাগ সময় বই পড়ে সময় কাটায়।
একটি বাহারি রঙের প্রজাপতি দেখে রাফি হঠাৎ চমকে ওঠে। একটি গোলাপের ওপর ডানা মেলে ও চুপচাপ বসে আছে। রাফি ধীরপায়ে প্রজাপতির দিকে পা বাড়ায়। প্রজাপতির ডানায় যেমনি হাত বাড়াতে যাবে আচমকাই কে যেন কথা বলে ওঠে, ‘হাত দিয়ো না।’
রাফি পেছনে ফিরে তাকায়। ডানে ফিরে তাকায়। বামেও ফিরে তাকায়। কোথাও কেউ নেই। কিন্তু শব্দগুলো এতো কাছে থেকে এসেছিল যে, পাঁচিলের বাইরে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করল না রাফি।
আবারও প্রজাপতির দিকে হাত বাড়াল রাফি। ছুঁয়ে দেবে এমন সময় আবারও একই রকমের শব্দ তার দু’কানে দ্রুত ঢুকে গেল।

প্রজাপতি বলল, আমার গায়ে হাত দিয়ো না। আমি তোমাদের আসল প্রজাপতি না।
প্রজাপতি কথা বলছে। দুনিয়ার সব আশ্চর্যের চেয়ে এরচে’ বড় আশ্চর্য আর কিছুই হতে পারে না। ও চোখের তাবৎ দৃষ্টি ফেলে রাফি প্রজাপতির দিকে অদ্ভুত কায়দায় দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রজাপতিটা মুহূর্তে ও-ডাল থেকে অন্য ডালে গিয়ে রাফির দিকে তাকিয়ে থাকল।
কারুর কাজে এভাবে গোলমাল বাঁধানো কারুর উচিত নয়। তুমি বড় ভুল কাজটিই করেছ। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পেরেছ?
হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু প্রজাপতিরা তো কথা বলতে পারে না। তুমি কীভাবে কথা বলছো?
আমি আগেও বলেছি আমি আসল প্রজাপতি না।
তাহলে তুমি ভিনদেশি কোনো জাদুকর?
না, আমি জাদুকরও নই। জাদুকরেরা কখনো রূপ বদলাতে পারে না। ওরা কৌশলের মারপ্যাঁচে তোমাদেরকে শুধু বোকা বানাতে পারে।
তাহলে তুমি কে?
আমি রি।
রি? রি কি কারুর নাম হতে পারে?
আমরা যেখানে থাকি ওখানে পারে।
তুমি কোথায় থাকো?
রি গ্রহে।
রি গ্রহে? ওটা আবার কোথায়?
ওটা অনেক দূরে। তোমাদের অংকের হিসাবে একের সাথে তেত্রিশটি শূন্যের আলোকবর্ষের পরে।
আরও পরে?
হ্যাঁ, আরও পরে।
এতো দূর থেকে তুমি কীভাবে এসেছো?
আমরা পারি। আমরা সেকেন্ডেই কোটি কোটি নক্ষত্র অতিক্রম করতে পারি।
অবিশ্বাস্য। এসব আমাদের কল্পনারও বাইরে।
আমাদের কাছে যা সত্য ওটা তোমাদের কল্পনা। তোমরা কল্পনাপ্রবণ জাতি।
তুমি এখানে কী জন্যে এলে?
মধু নিতে।
মধু! মধু এমন কি বস্তু যে এতো দূর থেকে এসে মধু নিতে হবে?
আমাদের গ্রহে ফুল জাতীয় কোনো গাছগাছালি নেই। আম জাম লিচু এসবও নেই। ভালো ভালো জিনিসগুলো আমরা ওখানে আবাদ করতে চাই। আমাদের কাছে খবর আছে মধু বহু প্রয়োজনীয় একটি বস্তু। এই মধু ফুলের ভেতর ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে। কোন ফুলের মধুতে গ্লুকোজ-ফ্রুটকোজ-সুকোজ-মন্টোজের পরিমাণ নির্ণয় করে এবং তা রি’দের শরীরে কোনো কাজে আাসবে কিনা তারও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। তাই সব ফুলের মধু নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমার কাজ শেষ হয়ে আসছে। পৃথিবীর সব ফুলের মধু নেওয়াও শেষ করেছি। তুমি কোন ক্লাশে পড়ো?
ফাইভে। দুদিন পর ষান্মাসিক পরীক্ষা শুরু হবে।
পরীক্ষাগুলোতে তুমি কী পাও?
নিরানব্বই করে পাই। ছয় বিষয়ে ছয় নম্বর কম দেন স্যারেরা।
কম দেন মানে? একশতে একশ পেলে কম দেবেন কেন?
এটাই নাকি নিয়ম।
এই নিয়ম ভাঙা যায় না?
যায় না, স্যারেরা নিরস্ত্র হতে চান না।
ঠিক আছ, তোমার পরীক্ষার দিন দেখা হবে। আমি আসব।
তুমি আসবে মানে? তুমি কেন আসবে?
আসলেই জানতে পারবে। তুমি কি একটু চোখ বন্ধ করবে?
চোখ বন্ধ করবো? চোখ বন্ধ করবো কেন?
আমার জেটপ্যাক এসে গেছে।
জেটপ্যাক কোথায়?
ওটা অদৃশ্য বস্তু। তোমার চোখে ধরা পড়বে না।
রাফি রি’র কথামতো চোখ বন্ধ করল। কিসের অদ্ভুত মৃদু-মিহি এক ধরনের শব্দ এল কানে। এ রকম মৃদু-মিহি শব্দের সাথে রাফি দ্বিতীয়বারের মতো পরিচিত হলো।
ঢং করে পরীক্ষার ঘণ্টা শুরু হয়ে গেল। গোটা রুমজুড়ে কচকচ শব্দ শুরু হয়ে গেছে। বাংলা স্যার এক মিনিটের মধ্যে সবগুলো কাগজ বিলি করে ফেললেন। যাদের রোল নম্বর বিশের পরে তাদের চেহারায় মেঘের আকাশ নেমে এল। গাধা ছাত্ররা যেসব বিষয়ে গাধা থাকে এদের চেহারা দেখলেই তা সহজে বোঝা যায়।
বাংলা স্যার চেয়ারে বসে আছেন। তার টেবিলে একটি দৈনিক পত্রিকা। তিনি মনোযোগ ঢেলে পত্রিকার প্রধান প্রধান খবরে চোখ বুলাচ্ছেন। আর কিছুক্ষণ পর তিনি ক্লাশে চক্কর দেওয়া শুরু করবেন। আজকের পত্রিকায় বোধহয় ভয়াবহ কোনো খবর-টবর আছে। স্যার এক পলকের জন্যেও কারুর দিকে তাকাচ্ছেন না। রাফি কাগজ হাতে দু’তিন মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। স্যার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা থেকে দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় চোখ বুলাতে গিয়ে রাফির দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটা দেখে হকচকিয়ে গেলেন।
কিছুু বলবে রাফি?
লেখা শেষ স্যার।
লেখা শেষ মানে? কী বলতে চাও তুমি?
আরও তিন মিনিট আগে লেখা শেষ হয়ে গিয়েছিল স্যার। আপনি পেপার পড়ছিলেন তাই বেয়াদবি হবে মনে করে আপনাকে বলতে সাহস পাইনি।
বাংলা স্যার পত্রিকাটা অযতেœ ঠেলে দিয়ে রাফির কাছাকাছি চলে গেলেন। রাফির কাগজগুলো উলটে পালটে তিনি চোখ দুটো আকাশে তুললেন।
তুমি কি এসব বাড়ি থেকে লিখে এনেছ?
বাড়ি থেকে? বাড়ি থেকে লিখে আনবো কেন স্যার?
এই পাঁচ-সাত মিনিটে এতগুলো লেখা কীভাবে লিখে ফেললে?
কীভাবে লিখে ফেলেছি জানি না স্যার।
বাংলা স্যার আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যেকটি পৃষ্ঠা দেখতে থাকলেন। কোথাও দাঁড়ি-কমার ত্রুটির চিহ্ন নেই। লেখাগুলোও ঝকঝকে পরিষ্কার। দেশের বড় বড় চিত্রশিল্পীর হাতের লেখার মতোন। বাংলা স্যার পরীক্ষার খাতাটা নিয়ে হেডস্যারের রুমে চলে গেলেন।
হেডস্যার বাংলা স্যারের চেয়েও বড় রকমের অবাক হলেন। রাফির মেধার ব্যাপারে হেডস্যারের কোনো প্রশ্ন নেই। গোটা ইশকুলে রাফির মতোন আরেকটি মেধাবী ছেলেও নেই। কিন্তু পাঁচ-ছয় মিনিটে এতগুলো লেখা লিখে শেষ করে ফেলা এটা বাদশাহ সোলাইমানের জ্বিনের পক্ষেও সম্ভব নয়।
হেডস্যার রাফিকে ডাকলেন। রাফি মাথা নিচু করে সটান দাঁড়িয়ে আছে। রাফির চেহারাটা সাংঘাতিক মলিন হয়ে আছে। রাফি কোনোদিন এরকম গোলমেলে অবস্থায় পড়েনি।
হেডস্যার রাফির দিকে মুখ করে বললেন, আমরা কি স্বপ্নের জগতে আছি রাফি?
না স্যার। স্বপ্ন কখনো এরকম বাস্তব হয় না।
তুমি এ ক’মিনিটে এতগুলো লেখা কীভাবে লিখলে?
আমি একেলা লিখিনি স্যার। আমার সাথে আরেকজন আছে।
আরেকজন! সে আবার কে?
ওর নাম রি।
রি! কোথায় তোমার রি?
আমার মস্তিষ্কে এখন রিও বাস করছে। আমরা দু’জন মিলে এসব লিখেছি।
হেডস্যার বললেন, রি বিষয়ক বিস্তারিত আরও কিছু বলবে কি?
রি আমার বন্ধু। সে রি গ্রহে থাকে। দু’দিন আগে তার সাথে আমার পরিচয় হয়। আমার পরীক্ষার রেজাল্টের কথা জিগ্যেস করলে আমি তাকে সবকিছু খুলে বলি। পরীক্ষায় সব বিষয়ে নিরানব্বই নম্বর পাওয়ার কথা বলি। সে খানিক আফসোস করে আমার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপাচার করে দুই লক্ষ বিলিয়ন বুদ্ধিমান নিউরন বসিয়ে দেয়। পরের দিন থেকে আমার মস্তিষ্কটা এক বিরাট মহাজগত হয়ে যায়। আমি এক মিনিটেই হাজার হাজার শব্দ লিখে ফেলতে পারি।
হেডস্যার বিজ্ঞানশাস্ত্রে এমএসসি করেছেন। তিনি বাংলা স্যারকে ইশারা করে বসতে বললেন। এবং রাফিকে সোজা বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য মৃদু নির্দেশ দিলেন।
খুব অল্প সময়ে পরীক্ষা দিতে পেরে রাফি মনের আনন্দে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল।
দ্বিতীয় দিন অংক পরীক্ষা। অংক স্যার পরীক্ষার খাতা ও প্রশ্ন নিয়ে বসে আছেন। দশটা বাজতে আরও তিন মিনিট বাকি। একটু পরেই বাংলা এবং হেডস্যার ঢুকলেন। সব স্যারের চোখই রাফির দিকে নিবদ্ধ হয়ে আছে। বাংলা স্যার আউরে ঠাউরে রাফিকে দেখে চলেছেন। রাফির আশপাশে কিছু আছে কিনা তাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। সব ছাত্রের সামনে জ্যামিতি বাক্স থাকলেও রাফির সামনে কিছুই নেই। বিষয়টা বাংলা স্যারের মাথাকে গুলিয়ে দিতে থাকল।
প্রশ্ন এবং খাতা বিলির শব্দ হচ্ছে। বাংলা স্যার একেবারে কাছাকাছি চলে গেল রাফির। রাফি উভয় পৃষ্ঠা প্রশ্ন পড়ে নিল একবার। প্রশ্নটা এত দ্রুত পড়ে নিল যে তার দেড় সেকেন্ডও এতে সময় লাগল না।
বাংলা স্যার দুই হাত দূর থেকে দেখে চললেন রাফিকে। তিন মিনিটেই রাফির সারা খাতা কালো হয়ে গেছে। স্কেল চাঁদা ছাড়াই ও জ্যামিতিগুলোও করে ফেলল চোখের পলকে। হেডস্যার দূর থেকে একবার বাংলা স্যারের দিকে তাকান তো আবার রাফির দিকে। অংক স্যার ক্লাশের এদিক-ওদিক হাঁটছেন। স্যার রাফির কাছাকাছি আসতেই রাফি উঠে দাঁড়াল।
অংক স্যার গম্ভীর মুখে বললেন, কোনো সমস্যা রাফি?
জি-না স্যার, লেখা শেষ।
লেখা শেষ মানে?
অংক জ্যামিতি সব শেষ স্যার।
অংক স্যার চোখ গোল গোল করে পরীক্ষার খাতার দিকে তাকালেন। হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখলেন। কী আজিব! এটা কেমন করে সম্ভব? স্বপ্ন ছাড়া এরকম কোনো বিষয় প্রত্যক্ষ করা একেবারেই অস্বাভাবিক।
অংক স্যার গভীর কণ্ঠে বললেন, তুমি কি রাফি?
জি-স্যার, আমি রাফি।
তুমি কি ক্লাশের ফার্স্টবয় রাফি?
জি-স্যার, আমিই রাফি।
আমি কি তোমাকে একটুখানি চিমটি কেটে দেখতে পারি?
জোরে কাটবেন নাতো স্যার?
না না, জোরে কাটব না।
অংক স্যার রাফির কানে দু’আঙুল চেপে চিমটি কাটল। রাফি শব্দ করে উঃ… করে উঠল।
অংক স্যার একপা পিছে এসে বলল, ব্যথা পেয়েছ?
জি-স্যার, খুব ব্যথা পেয়েছি।
তাহলে তো আমি বাস্তবেই দাঁড়িয়ে আছি।
হ্যাঁ-স্যার, আমরা বাস্তবেই আছি। এখানে কোনো স্বপ্ন-টপ্ন নেই স্যার।
হেডস্যার দ্রুত রুমে ঢুকে পড়ে অংক স্যারের হাত ধরলেন। টানতে টানতে বাইরে একপাশে নিয়ে গেলেন। অংক স্যার হেডস্যারের অমন আচরণের ফলাফল কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি তার ফিসফিসানি কথাগুলো কানপেতে শুনেই যেতে থাকলেন।
বিকেল বেলা হেডস্যারে রুমে সব শিক্ষকদের একসাথে হতে দেখা গেল। হেডস্যার সব শিক্ষকদের উদ্দেশ্য করে ব্রিফিং দিলেন। ব্রিফিংয়ের মর্ম হলো এই, রাফির অস্বাভাবিক বিষয়টা কাউকে বলা যাবে না। এমনকি নিজ পরিবারের কাছেও না। সামনের পিইসি পরীক্ষায় রাফি এরকম রেজাল্ট করলে খবরটা গোটা রাষ্ট্র হয়ে যাবে। তাদের ইশকুলের সুনাম ছড়িয়ে যাবে চারপাশে। পত্রপত্রিকায় ধুমসে লেখালেখি হবে। ছয়শ নম্বরের পরীক্ষায় ছয়শ নম্বরই পাবে রাফি। আধা নম্বর কাটারও কারুর সাহস থাকবে না। হেডস্যারের ব্রিফিংটা সবাই কান পেতে শুনলেন। বিষয়টা তারা যুক্তিযুক্ত মনে করলেন। সব শিক্ষকেরা খোশমেজাজে বের হয়ে গেলেন।
রাফির পরীক্ষা যেদিন শেষ হয়ে যায় সেদিনের রাতটা ছিল জোছনামাখা রাত। রাফি জানালার পর্দা সরিয়ে মিষ্টি জোছনা দেখছিল। হঠাৎ একটি ছোট্ট টকটকে লাল প্রজাপতি ঢুকে পশ্চিম পাশের দেয়ালকে খামচে ধরল।
রাফি বলল, তুমি নিশ্চয় রি।
হ্যাঁ রাফি, আমি রি।
আমি জানতাম তুমি আসবে। তাই জানালা খুলে বসে আছি।
আমিও ছটফট করছিলাম কখন আজকের দিনটি আসে। তাই আজ লাল পোশাকে এসেছি। লাল পোশাকটা আমরা এক বিশেষ দিনে পড়ি। এই পোশাকেই তোমাকে আজ একটা সোনার প্রস্তাব দেবো।
সোনার প্রস্তাব? ওটা আবার কী জিনিশ?
দেখো, তোমাদের জীবনটা আমাদের কাছে সেকেন্ডের চেয়েও ছোট। তোমরা পৃথিবীতে আসো এবং চলে যাও। চড়–ই পাখির ফুড়–ৎ ফড়–তের মতোন। আসা আর যাওয়া। তাই বলছিলাম…।
তাই কী বলতে চাও খোলাসা করে বলো।
তুমি চাইলে আমাদের গ্রহে চলে যেতে পারো। আমাদের মতোন রি হয়ে যেতে পারো। তোমাকে রি বানানো আমাদের কোনো ব্যাপারই না।
তুমি নিশ্চয় জানো আমার মা-বাবা আছে। আমার ছয় মাসের একটা পিচ্চি বোন আছে। রোজ ওকে দশ-বিশটা চুমু না দিলে আমার ঘুমই আসে না। আমি ইশকুল থেকে ফিরে এলে ও আমার মুখে পিট পিট করে তাকায়। দু’হাত নাচিয়ে হেসে ওঠে। আমার কোলে ওঠার জন্য কী অদ্ভুত শব্দ করে। এ পৃথিবীতে আমাাদের জীবনটা খুব ছোট, আমি তাও জানি। তবে এটাও জানি যে আমার আশপাশের সবাইকে আমি কতোই না ভালোবাসি। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ছি। তুমি অস্ত্রোপাচারে নামতে পারো। তোমাদের নিউরনগুলো নিয়ে নাও। দেরি করো না বন্ধু। মা এসে পড়লে তোমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারবো না।
তোমার না জবাবটা গিলতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রাফি। তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে কিনা জানি না। না হওয়ার সম্ভাবনাই হয়তো বেশি। তোমাদের পৃথিবীর মতোন আরেকটি গ্রহের সন্ধান পেয়েছে আমাদের একাডেমি। তবে ওই গ্রহটি নাকি সবুজ না, হলুদে-লাল। আমি যখন ওখান থেকে ফিরবো তখন তোমাদের পৃথিবীর আরও এক হাজার বছর বেড়ে যাবে। হয়তো তোমাদের পৃথিবীর রং-ঢংও অনেক বদলে যাবে। তুমি চোখ বন্ধ করো, আমি কাজ শুরু করছি। একদম ভয় পাবে না। আরেকটি কথা, তোমার মস্তিষ্ক থেকে রি’র নিউরনগুলো আলাদা করার পরও তোমার মাথাটা অনেকদিন রি’র মতোনই কাজ করবে। তোমাদের নিউরনগুলো রি নিউরনের সাথে কাজ করাতে আগের’চে অনেক শক্তিশালী হয়ে গিয়েছে। তুমি যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিনই ওর কার্যকারিতা জিইয়ে থাকবে।
রাফি চোখ বন্ধ করল। মুহূর্তে রাফির মাথাটা আগের জায়গায় এসে গেল। রাফি চোখ মেলে তাকাল। টকটকে লাল প্রজাপতিটা এখন আর কোথাও নেই। রি’র জন্য রাফির বুকটা হঠাৎ কেমন করে উঠল।

Share.

মন্তব্য করুন