শীতের রাত বেশ বড়। বড় মানে বড়ই। ৫টা বাজলেই নেমে আসে সন্ধ্যা। চারিদিকে কুয়াশার ছায়া। মনে হয় বাঁশবন বেতবন আর ফসলের মাঠ থেকে সন্ধ্যা নামে। দূরের বাড়ির চিত্র একদম ধোঁয়ার মতো। বৃক্ষগুলোও তেমনই। আকাশও ধোঁয়ার মতো জমাট। আসলে ধোঁয়া নয়। কুয়াশার ছবি। কুয়াশার এরূপ গ্রামে খুব অন্যরকম। চতুর্দিকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী যেনো চুপচাপ জড়িয়ে থাকে।
এসব চিত্র বেশ লাগে আননের। উঠোনে দাঁড়িয়ে এসব দৃশ্য সে। দেখে কিভাবে বিকেল হলেই রোদের রঙ কমলা হয়ে যায়। কিভাবে তাড়াতাড়ি নিভে যায় রোদের চোখ।
পশ্চিম দিকে সূর্যের চিক থাকে। সে চিক নরম রোদের। গাছের পাতায় পাতায় কোমল রোদের ঝিলিক! আহা কি সুন্দর! কি মায়াবী! একঝাঁক সাদা বক উড়ে যাচ্ছে। হয়তো বকগুলো ফিরছে বাসায়। আকাশের নানা জায়গায় একা একা উড়ে বেড়াচ্ছে চিল। ওড়ে আপন মনে।
আনন ভাবে- এসব পাখি কী করে ভেসে থাকে আকাশে। ভেসে বেড়ায় নিজের মতো। কখনো কখনো হঠাৎ বিমানের মতো শাঁ করে কোনো ঈগল নেমে আসে নিচে। আসে কোনো শিকার ধরার জন্য। বিস্ময়কর ভাবে শিকার ধরে পায়ের তীক্ষè নখ দিয়ে। ধরেই উড়াল তোলে। কোনো উঁচু গাছের ডালে বসে বেশ মজা করে খায় শিকারটি। তারপর আবার উড়তে থাকে ইচ্ছে মতো।
এমন কত দৃশ্য চোখে ভাসে আননের। ঈগলের শিকার ধরার কৌশল খুব অদ্ভুত। এবং এতো দ্রুত গতি তাদের ভাবা যায় না।
এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে কোন ফাঁকে সূর্য প্রায় ডুবুডুবু।
পাশের বাঁশ বাগানে ঢুকে পড়ছে বকের সারি। গরু ছাগল ভেড়া সব ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ থাকার ঘরে। উড়ে যাচ্ছে কত রকম পাখি। আকাশ পাখিদের ডানামেলা সুন্দরে অন্যরকম হয়ে উঠলো। এমন চিত্র কি যে ভালো লাগছে আননের। এক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে ও। ভাবছে- আহা মহান স্রষ্টার সৃষ্টি কি অপরূপ! কি আনন্দের! কি বিস্ময়ের!
হঠাৎ পায়ের পাশে মিঁয়াও স্বরে ডেকে উঠলো একটি বিড়াল। আকাশ থেকে দ্রুত আননের চোখ সরে এলো বিড়ালের দিকে। দেখলো বিড়ালটি বেশ কালো। সড়সড়। কালো তো একদম কালো। যাকে বলে মেষমেষে। কিন্তু চোখ দুটো বেজায় উজ্জ্বল! একদম জ্বলজ্বলে। চেয়ে আছে আননের দিকে। চোখে চোখ পড়তেই বেশ ভয় পেয়ে গেলো আনন! সূর্য ডুবে গেছে তখন। চারিদিকে গাছগাছালি আর কুয়াশার আয়োজনে একটু অন্যরকম পরিবেশ! গা ছমছম! তার ওপর এ অদ্ভুত কালো বিড়াল। এ অবস্থায় বিড়ালের জ্বলজ্বলে চোখ দেখে ভয়টি বুকের ভেতর ঢুসঢুস বাড়ি দিচ্ছে যেনো। সাধারণত বিড়ালের কান থাকে খাড়া। কিন্তু এ বিড়ালটির কান খানিকটা ভাঁজ করা।
বিড়ালটি তখনো চেয়ে আছে ওর দিকে। ওর চোখও বিড়ালের দিকে। কিন্তু ভয়ের হিম ওর সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে! কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বিড়ালটিকে ধমক দেয়ার চিন্তা করলো। কিন্তু সাহস হচ্ছে না। ভাবে ধমক দিতে গেলে যদি আক্রমণ করে। যদি লাফিয়ে পড়ে ওর গায়ের ওপর। যদি ওকে চিরে দেয়। এমন নানান ভাবনা জেগে ওঠে ওর মনে।
কোথায় যেনো ও পড়েছিলো- এ ধরনের পরিস্থিতিতে চোখে চোখ রাখতে হয়! কোনো হিংস্র প্রাণীর চোখে চোখ রাখলে যতক্ষণ রাখবে ততক্ষণ আক্রমণ করবে না। সুতরাং আনন ভয় উপেক্ষা করে বিড়ালটির চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইলো!
কিন্তু বিড়ালটিকে এতো ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে কেনো ওর! ওতো বিড়াল কুকুর এমনকি শেয়ালও ভয় পায় না। আজ কেনো এতো ভয় চেপে বসলো! সন্ধ্যা এবং কুয়াশা বলে! নাকি হঠাৎ চোখে পড়ার কারণে।
এখন কি হবে! কি করবে ও! কি করা উচিত! কিছু বুঝে আসছে না! অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছে। ভয়ও জোরদার হচ্ছে বেশ! মনে হচ্ছে চিৎকার বেরিয়ে আসবে! কিন্তু না কোনো শব্দ মুখ থেকে বের হচ্ছে না। ওকি চিৎকার দেয়ার চেষ্টা করবে! ডাকবে মাকে। অথবা বাবা বলে। কিংবা অন্য কাউকে! না কাউকে ডাকবে না! নিজেকে নিজেই সাহস জোগায়! বলে, এতো ভয়ের কি আছে! কেনো এতো ভয় পাও আনন! একটি বিড়ালই তো! হোক কালো ওকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যদি প্রাণীটি বুঝতে পারে ও ভয় পেয়েছে তবে আক্রমণও করতে পারে। সুতরাং ও কোনো ভয় পাচ্ছে না এমনই ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বিড়ালের চোখেই ধরে রেখেছে।
এর মধ্যে হঠাৎ একটি মিছিলের শব্দ শোনা গেলো। কান খাড়া করলো আনন। হ্যাঁ মিছিলই তো। ওইতো স্লোগান- নতুন বছর, নতুন বছর, স্বাগতম স্বাগতম! ঠিক মনে পড়লো আননের। আজ একত্রিশ ডিসেম্বর রাত। আগামীকাল ১ জানুয়ারি। নতুন বছর। নতুন বছরে কত আনন্দ জাগে। গান কবিতা আবৃত্তি এবং আরও নানা রকম প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকে এদিন।
প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর নতুন বছর সামনে রেখে তরুণেরা একটি মিছিল বের করে। এ মিছিলে আননও থাকে। কিন্তু এবার সে ভুলে গেলো কেনো! কেউ ওকে স্মরণও করায়নি। ব্যাপার কি! কি হলো গো। কেউ ওকে স্মরণ করলো না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন আনমনা হয়ে গেলো আনন। বিড়ালের চোখ থেকে চোখও সরে গেছে কখন। বিড়ালটি লেজ তুলে মোচ পাকায়! আর জ্বলজ্বলে চোখ খুলে ডাকে- মিঁয়াও। বিড়ালের ডাক শুনে অকস্মাৎ ভিরমি খেয়ে আবার তাকালো বিড়ালের দিকে। না বিড়ালটি আগের জায়গায়ই আছে। নড়েনি একটুও। কি চায় বিড়ালটি! কেনো আননের দিকে এমন করে চেয়ে আছে!
মিছিলটি মনে হচ্ছে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। আসুক। ভালোই হবে। মিছিল এলে বিড়ালটি আপনা থেকেই পালাবে। আর আনন অংশ নেবে মিছিলে।
কিন্তু না মিছিলটি ওর দিকে এলো না। ওইতো স্লোগান দূরে সরে যাচ্ছে। তার মানে মিছিল দূরে সরছে। বিড়ালটি যত যন্ত্রণার মূল! বিড়ালের মুখোমুখি না হলে মিছিলে যোগ দিতে পারতো ও।
এসব ভাবতে ভাবতে দেখলো হঠাৎ বিড়ালটি লাফিয়ে পালিয়ে গেলো। আনন ভাবে- কি হলো। কেনো পালিয়ে গেলো বিড়ালটি। ওর মনে এখন আর কোনো ভয় নেই। কোনো আশঙ্কাও নেই।
এদিক ওদিক দেখলো। না কোথায় যেনো পালিয়ে গেলো বিড়ালটি।
ধীর পায়ে হেঁটে ঘরে ঢুকে পড়লো আনন।
ডিসেম্বর শেষ। পড়ালেখা নেই। বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেছে আরও আগে। সুতরাং পড়ালেখার ঝামেলা নেই। আগামীকাল নতুন বছর এটিই এখন আননের মাথায়। খেয়ে দেয়ে রাত ১০টার আগে আগে শুয়ে পড়বে ও। শোয়ার আগে এশার নামাজটি আদায় করে নেবে।
যেই ভাবনা সেই কাজ। ৯টার মধ্যে আম্মুকে বললো- আমাকে খাবার দাও। খেয়ে নামাজ পড়ে শুয়ে যাবো। কাল তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। কারণ বিজয় দিবস কাল।
আননের আম্মু বললো- তুমি তো প্রতিদিনই আর্লি ওঠো। ভোরের কোমল বাতাস তোমাকে পায়!
আনন বললো- জি আম্মু এটি আমার ভালো লাগে খুব। ভোরবেলা ওঠার একটি অন্যরকম আনন্দ আছে। বাতাস কি যে ফ্রেশ। মন ভালো হয়ে যায়। ভাবনা জাগে নতুন নতুন। কাজে বরকত হয়। লেখাপড়া ভালো করা যায়। তাড়াতাড়ি নাস্তা খাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা সকালে উঠলে মন ভালো থাকে। সারাদিন ফ্রেশ থাকা যায়। সকালের কোমল আলো গায়ে লাগলে বেশ আরাম লাগে। ঝিরঝিরে বাতাসে গা জুড়িয়ে যায়।
১০টার আগেই শুয়ে পড়লো আনন। ঘুমিয়েও পড়লো। কিন্তু ঘুমের ভেতর সেই কালো বিড়াল দেখা দিলো। ভয়ঙ্কর সব স্বপ্ন দেখছে ও। দেখছে ওই কালো বিড়ালটি আক্রমণ করছে ওকে। চিরে দিচ্ছে ধারালো নখ দিয়ে। ও চিৎকার করছে। অথচ কেউ শুনতে পাচ্ছে না ওর চিৎকার! কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না। বিড়ালের সাথে লড়াই হচ্ছে ওর। কিন্তু পেরে উঠছে না ও। বিড়াল ওকে আক্রমণ করে ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে। আর ও শুধু চিৎকার দিচ্ছে। কিন্তু কেউ শুনছে না ওর চিৎকার! শরীরের পুরো শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। হঠাৎ ওর ঘুম ভেঙে গেলো। দেখে ঘামে সারা গা জবজবে। এতো শীতের মধ্যে ও ঘামিয়ে এক শেষ। বুক ধড়ফড় করছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। পানির পিপাসা পেয়েছে খুব। কিন্তু একা পানি ঢেলে খাওয়ার সাহস হচ্ছে না। ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে ডান হাত মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে আছে। এভাবেই কখন আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
ঘুম ভাঙলো মুয়াজ্জিনের আজান শুনে। ভোরের আজান এতো মধুর লাগে আননের। প্রতিদিন আজান কানে এলেই ঘুম ভাঙে ওর। উঠে চুপচাপ শোনে আজানের সুর। আজান শেষ হলেই ওয়াশরুমে ঢোকে ও। অজু করে বের হয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। ঠিক তখনই ঝিরঝিরে হাওয়া বুলিয়ে যায়। কি যে ভালো লাগে তখন।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুব আকাশের দিকে দেখলো ও। হ্যাঁ আজও সূর্য ওঠার মুহূর্তটি নতুন আয়োজনে নতুন রঙ ও নতুন সুন্দরে প্রকাশিত।
একটি নতুন সূর্য উঠবে প্রতিদিনের মতো। কিন্তু আজকের সূর্যটি নতুন বছরের নতুন দিনের সূর্য।
আজকের দিনটি নতুন সূর্যের দিন।

Share.

মন্তব্য করুন