রাসূল সা. এর একজন সাহাবীর নাম মিকদাদ বিন আসওয়াদ রা.। গল্পটি তার সাথেই জড়ানো। তিনি বলেন, আমি ও আমার দু’জন সঙ্গী মদিনায় এলাম। কিন্তু আমাদের থাকার নির্দিষ্ট কোনো স্থান ছিলো না। ফলে আমরা বিভিন্ন জনের বাসায় গেলাম। কিন্তু কেউ আমাদের মেহমান হিসেবে রাখতে রাজি হলো না। শেষে আমরা মহানবী সা. এর দরবারে হাজির হলাম। তিনি আমাদেরকে তাঁর নিজের ঘরে মেহমান হিসেবে বরণ করে নিলেন। রাসূল সা. এর কাছে চারটি বকরি অর্থাৎ ছাগল ছিলো। চারটি ছাগলই দুধ দিতো। রাসূল সা. আমাকে বললেন, মিকদাদ এগুলো দোহন করবে তুমি। তারপর দুধটুকু ভাগ করে চারজনকে যার যার অংশ দিয়ে দেবে।
মিকদাদ বলেন রাসূলের নির্দেশ মতো আমি তাই করলাম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বকরিগুলো দোহন করতাম। আমি ও আমার দু’জন সঙ্গী আমাদের অংশ পান করতাম। রাসূল সা. এর অংশ রেখে দিতাম। রাসূল সা. থাকলে তিনি তাঁর অংশ পান করতেন। তিনি উপস্থিত না থাকলে তাঁর অংশ রেখে দিতাম। যখন তিনি আসতেন তখন পান করতেন।
এক রাতের ঘটনা। সন্ধ্যায় যথারীতি দুধ দোহন করলাম। আমার অংশ পান করলাম। আমার সঙ্গী দু’জনও পান করলো। রাসূল সা. উপস্থিত ছিলেন না। তাঁর অংশ রেখে দেয়া হলো। তিনি এসে পান করবেন। অনেকক্ষণ হয়ে গেলো তিনি ফিরছেন না। বেশ রাত হয়ে গেলো তবুও ফিরলেন না। আমি শুয়ে আছি। শুয়ে শুয়ে ভাবছি, হয়তো রাসূল সা. আজ কোনো আনসারি সাহাবির বাড়ি গেছেন। নিশ্চয় তিনি সেখানে আহার করে ফেলেছেন। তাই রাসূলের অংশটুকু আমি পান করে ফেলতে পারি।
এই ভেবে আমি দুধটুকু পান করে নিলাম। কিন্তু দুধটুকু পেটে স্থির হতে না হতেই আমি বুঝতে পারলাম কি ভুলটি আমি করলাম। যদি রাসূল সা. এখন এসে যান এবং তিনি যদি কিছু না খেয়ে থাকেন তবে! মনে মনে আমি খুব লজ্জিত হলাম। মনে হচ্ছিল এখনই রাসূল সা. ফিরবেন। ক্ষুধার্ত এবং পিপাসিত অবস্থায়। এসে দেখবেন পেয়ালা খালি। এরপর হয়তো তিনি বদদোয়া করবেন। রাসূলের বদদোয়া! ইশ, আমি আর ভাবতে পারি না। এমনই দুশ্চিন্তায় আমি মুখ ঢেকে ফেললাম। সময় বয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে রাত যখন আরও গভীর হলো রাসূল সা. ফিরে এলেন। এসে খুব ছোট আওয়াজে সালাম দিলেন। সালামের আওয়াজ এমনই ছিলো যেনো জাগ্রত ব্যক্তি শুনতে পায়। যেনো ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম না ভাঙে। আমি ঘুমের ভান করে চেয়ে আছি রাসূলের দিকে। দেখছি রাসূল কী করেন। রাসূল সা. দুধের পাত্রের কাছে এলেন। ঢাকনা সরালেন। দেখলেন পাত্রটি খালি। কিছুই নেই পাত্রের ভেতর। রাসূল সা. এবার তাকালেন আকাশের দিকে। এ অবস্থা দেখে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম এই বুঝি বদদোয়া করবেন রাসূল সা.। কান খাড়া করলাম আমি। শুনতে চেষ্টা করছি কী বলেন রাসূল সা.।
আমি শুনলাম, রাসূল সা. দোয়া করছেন। বলছেন, হে আল্লাহ আমাকে যে পান করায় তুমি তাকে পান করাও। আমাকে যে আহার করায় তুমি তাকে আহার করাও। মিকদাদ বললেন, আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি রাসূলের এই দোয়া কাজে লাগাবো। আমি দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম। একটি ধারালো ছুরি নিলাম হাতে। এরপর বকরিগুলোর কাছে গেলাম। এগুলোর একটিকে জবাই করে রাসূলকে আহার করাবো। আমি পরখ করতে লাগলাম কোন বকরিটি সবচেয়ে হৃষ্টপুষ্ট। আমি যখন হাত বাড়ালাম ঠিক তখন একটি বকরির ওলানে হাত পড়লো আমার। আমি অনুভব করলাম বকরির ওলানটি দুধে পরিপূর্ণ। এরপর একটি একটি করে সব কয়টি বকরির ওলান দেখলাম, সবগুলো ওলানই দুধে পরিপূর্ণ। আমি তখন জবাইয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে দুধ দোহন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। যথারীতি দোহন করলাম দুধ। পাত্রটি পরিপূর্ণ হয়ে গেলো দুধে। প্রতিদিনের চেয়ে বেশি দুধ পেয়ে গেলাম। দুধের ফেনা উপচে পড়ছিলো। দুধের পাত্র নিয়ে আমি রাসূলের কাছে এলাম। বললাম, আল্লাহর রাসূল সা. পান করুন। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দুধ দেখে রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, মিকদাদ তোমরা কি আজ রাতে দুধ পান করোনি?
আমি বললাম, আল্লাহর রাসূল সা. আপনি দুধ পান করুন।
রাসূল সা. বললেন, মিকদাদ কী ব্যাপার বলো তো!
আমি আরজ করলাম, আল্লাহর রাসূল সা. আপনি আগে পান করুন, পরে বলছি। রাসূল সা. পান করলেন।
আমি বললাম, আল্লাহর রাসূল সা. আরও পান করুন।
রাসূল সা. আবার পান করলেন। তারপর আমার দিকে পাত্রটি বাড়িয়ে দিলেন। আমি আবারও বললাম, আল্লাহর রাসূল আরও পান করুন। তিনি পান করলেন।
আমি যখন বুঝতে পারলাম, রাসূল সা. পরিতৃপ্ত হয়েছেন। আর রাসূল সা. এর সেই দোয়া অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাকে যে পান করায়, তুমি তাকে পান করাও… লাভ করার সুযোগ আমি পেয়ে গেছি তখন আমি আনন্দে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়িয়ে পড়লাম।
আমার অবস্থা দেখে রাসূল সা. বললেন, মিকদাদ, এটি তুমি কি করছো!
তখন আমি ঘটনাটি বললাম। বললাম কিভাবে বকরিগুলো অল্প সময়ের ব্যবধানে অস্বাভাবিক ভাবে দু’বার দুধ দিলো!
রাসূল সা. আশ্চর্য হলেন! কিভাবে এতো দ্রুত বকরিগুলোর ওলান দুধে ভরে গেলো! একরাতে তো বকরি দু’বার দুধ দেয় না।
রাসূল সা. বললেন, এতো আল্লাহর বিশেষ রহমত। মিকদাদ, তুমি আমাকে আগে জানালে না কেনো? তোমার সঙ্গীদের জাগালে তারাও কিছু দুধ পান করতে পারতো।
আমি বললাম, সেই সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্য নবীরূপে পাঠিয়েছেন! আপনি আল্লাহর রহমতে সিক্ত হয়েছেন। আর আমিও তার কিছু অংশ লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের ছাড়া আর কেউ পারলো কি পারলো না, তা আমার মাথায় আসেনি। ঘটনাটি কি অদ্ভুত! রাসূল সা. ক্ষুধা পেটে, পিপাসার্ত হয়েও কাউকে দোষারোপ করলেন না। বদদোয়া তো করলেনই না বরং দোয়া করলেন। ফলে আল্লাহর রহমত নাজিল হলো বিস্ময়করভাবে!

Share.

মন্তব্য করুন