পড়ার জন্য সবাই যখন চোখ রাঙিয়ে ডাণ্ডা হাতে তাড়া দেয়, যেন আমাদের বই আওড়ানোটাই একমাত্র কাজ। বিশ্ব অভিধানে ছোটদের জন্য খেলাধুলা নামক কোনো শব্দই নেই। তখনই শিশু-কিশোরদের হয়ে আল মাহমুদ বলে উঠেন,
আম্মা বলেন পড় রে সোনা
আব্বা বলেন মন দে,
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।

আমার কেবল ইচ্ছে করে
নদীর ধারে থাকতে
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মত ডাকতে।
এ-কথা তো আমাদেরি। পাঠে মন বসে না একদমি। কেবলি ইচ্ছে করে নদীর কাছে, বনের ধারে, গাছের ডগায় চড়তে।
আম্মু বলেন পড় রে সোনা
আব্বু বলেন মন দে

দূরছাই কেউ বুঝে না আমাদের, কেবলমাত্র পাখির কবি, ফুলের কবি আল মাহমুদ ছাড়া।
ঐ নীল আকাশের দিকে তাকালে মনে কত ভাবনারি না ভিড় জমে। সাদা মেঘ ঘিরে বাসা বাঁধে শত কল্পনা, ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় এতো মেঘ নয়, ঘোড়া ছুটিয়ে চলা কোন রাজকুমার, রাজকুমারীর প্রাণ রক্ষায় ছুটে চলছে দ্রুত। আবার ইচ্ছে হয়, ইশ! যদি ভেলায় চড়ে এই মেঘ সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতে পারতাম? কী মজাই না হতো! আকাশ নিয়ে আমাদের সেই সুপ্ত বাসনার কথাও বাদ পড়েনি কবির কলম হতে।
‘আকাশটাকে নিয়ে আমার মস্ত বড় খেলা, মেঘের কোলে ভাসাতে চাই চিলেকোঠার ভেলা। বাতাস যখন থমকে গিয়ে শান্ত হয়ে রয় মেঘের ঈগল ভেঙে কেবল ফুলের তোড়া হয়; জলকদরের খাল পেরিয়ে জলপায়রার ঝাঁক উড়তে থাকে লক্ষ্য রেখে শঙ্খনদীর বাঁক। মন হয়ে যায় পাখি তখন, মন হয়ে যায় মেঘ মন হয়ে যায় চিলের ডানা, মিষ্টি হাওয়ার বেগ আবার যখন সন্ধ্যা নামে ছড়িয়ে কালোর ছিট আকাশটাতে কে এঁকে দেয় নীল হরিণের পিঠ।’
কবির স্নেহ থেকে বাদ যায়নি পাহাড়ি বোন রাকমাও।
চাকমা মেয়ে রাকমা
ফুল গোঁজে না কেশে
কাপ্তাইয়ের ঝিলের জলে
জুম গিয়েছে ভেসে।

জুম গিয়েছে ঘুম গিয়েছে
ডুবল হাঁড়িকুড়ি,
পাহাড় ডোবে, পাথর ডোবে
ওঠে না ভুরভুরি।

কবি আমাদের শুধু আটকে রাখেননি পড়ালেখা, দুষ্টমি আর কল্পনাকাশে।
করে তুলেছেন ইতিহাসেরও অবিচ্ছেদ্য এক অংশ।
ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক !
ট্রাকের মুখে আগুন দিতে
মতিয়ুরকে ডাক।

কোথায় পাবো মতিয়ুরকে
ঘুমিয়ে আছে সে !
তোরাই তবে সোনামানিক
আগুন জ্বেলে দে।

কেউ এমন দুঃসাহসী কাজে ডেকেছে শিশু-কিশোরদের? সামান্য আতশবাজির শব্দ হতে না হতেই, আমাদের ভেতর ঘরে রেখে দুয়ারে খিল এঁটে দেয়। অথচ তিনি কত অবলীলায় ডাকলেন ’৬৯-এর সেই ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলনে, ইতিহাসের অংশ করে নিলেন আমাদেরও! আমরা শিশু-কিশোরাও যে কোন অংশে কম নই এটাই কবি প্রমাণ করে দিলেন-
কোথায় পাবো মতিয়ুরকে
ঘুমিয়ে আছে সে!
তোরাই তবে সোনামানিক
আগুন জ্বেলে দে।

’৫২-এর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কত কঠিন ভাবেই না বলা হয় আমাদের। কিন্তু কবি আল মাহমুদ বরাবরই ব্যতিক্রম। কত সহজ, সুন্দর করে বললেন তিনি,
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত।

কেবল বলেই ক্ষান্ত হননি, প্রশ্ন করে নিজেই আবার বুঝিয়ে দিলেন,
চিনতে না কি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
মুক্ত বাতাস কিনতে?

আমাদের হয়ে কবি আকুতিও জানান,
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।

এতদিন কবি আমাদের আহবান করেছেন, অংশ বানিয়েছেন ’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলন ও ’৫২-এর ভাষা সংগ্রামের। এবার ছোটদের সাথে যুক্ত হলেন ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে।
সব খুশিরই গন্ধ আছে-ঈদের খুশিরও
ঈদের খুশির গন্ধটা ভাই ঘিয়ে ডোবানো
আদর সোহাগ সবকিছুতে রান্নাঘরের ঘ্রাণ
কোরমা পোলাও ছাড়া কি ভাই ভরবে কারো প্রাণ?

পরের লাইনগুলোতে ফুটে উঠে কবির শিশুসুলভ ভোজন আকাক্সক্ষা। শুধু আমাদের কাছেই খাবার মানে আনন্দ নয়, কেবলমাত্র শিশুরাই কব্জি ডুবিয়ে খায় না। তিনিও যে ভোজনপ্রিয় অকপটে স্বীকার করেন তাও।
খুশির মধ্যে খাওয়াই সেরা-খাওয়ার বাড়া নেই
ঈদের খাওয়া শুরু করো কব্জি ডুবিয়েই
ঈদের খাওয়া মায়ের হাসি ঝিলিক মারে মনে
কিছু তো তার হারিয়ে গেছে কিছু সংগোপনে।

সবকিছুতে স্বপ্ন আছে খাওয়ার স্বপ্ন সেরা
স্বপ্নে স্বপ্নে যাক মিলিয়ে ধনী-গরিবেরা।

শেষ দু’লাইনে কবি বাচ্চাসুলভ বলেই বসলেন, খাওয়ার স্বপ্ন সেরা স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নেই ধনী-গরিব হোক একাকার।
এখানেই শেষ নয় তিনি আমাদের জন্য লিখেছেন বিখ্যাত কিশোর উপন্যাস মরু মূষিকের উপত্যকা। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত রহস্যোপন্যাসটি। এই বইয়ের প্রতিটি লাইনে কবি আমাদের উত্তেজনায় ঊর্ধ্বমুখী করার সাথে সাথে গল্পচ্ছলে অনেক অজানা ইতিহাসও জানান। প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছড়ান মুগ্ধতা। গভীরে যত প্রবেশ করি চমৎকৃত হই ততই। আল মাহমুদ কখনো আমাদের নিয়ে যান প্রাচীন কোনো শহরে, কখনো বা নিয়ে যান প্রাণহীন কোন ধূসর মরুভূমির আদিগন্ত বালির সমুদ্রে। কখনো আবার নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন বন্দুকের নলের সামনে। আমরা বইয়ের চরিত্রগুলোর হাত ধরে ইতিহাসের অলিগলিতে হাঁটতে হাঁটতে চরম উত্তেজনা বোধ করি। কেবলই মনে হয় এরপর কি হবে? এরপর কি? আর ভ্রমণ শেষে আমাদের চেহারায় দোলা দেয় পরম তৃপ্তির রেখা।
তিনি কেবল শুধু সোনালি কাবিনের কবি নন, ফুল পাখিরও কবি, তিনি বাংলাভাষী সকল শিশু-কিশোরদের প্রিয় কবি আল মাহমুদ!
ছোটদের রূপকথার গল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে কবি বলেন, ‘রূপকথা মানে ছোট ছোট তরঙ্গময় সুন্দর কাহিনি কাব্যের মতো গদ্যের বই।’ রূপকথা লেখার প্রধান কারণ আনন্দ বিতরণ বলে জানান আল মাহমুদ। ছোটদের জন্য লিখতে ভালোবাসতেন খুব। তাই তো বড়দের পাশাপাশি ছোটদের কাছেও সমান জনপ্রিয় তিনি।
১১ জুলাই ১৯৩৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা সাহিত্যে পাঁচ যুগেরও বেশি সময় ধরে বিচরণ করা কবি আল মাহমুদ। গদ্য ও কবিতা মিলে তার রচনার পরিধি বিস্তৃত। ৮২ বছর বয়সে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তিনি।
কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধে মিলিয়ে তাঁর বইয়ের সংখ্যা একশর মতো। এর মধ্য শিশু-কিশোরদের জন্য প্রকাশিত বইগুলো হলো,
একটি পাখির লেজ ঝোলা (ছড়া গ্রন্থ)
পাখির কাছে ফুলের কাছে (কবিতা গ্রন্থ)
মোল্লাবাড়ির ছড়া (ছড়া গ্রন্থ)
ফড়িং ধরার গল্প (গল্পগ্রন্থ)
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স:) (জীবনী গ্রন্থ)
ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড় (রূপকথা)
ময়নামতির নেকলেস (উপন্যাস)
মরু মূষিকের উপত্যকা (উপন্যাস)

Share.

মন্তব্য করুন