আমাদের একটা বাইসাইকেল ছিল এখনও আছে। কিন্তু আমি তা চালাতে শিখিনি। পাড়ার সব ছেলেরাই সাইকেল চালাতে জানে। সমবয়সীদের মধ্যে আমিই সবচে পিছিয়ে। সবার ধারণা আমিও পারি, তাই আমাকে দিয়ে কোনো কাজ করাতে চাইলে বলা হয়, ‘যাও সাইকেলটা নিয়ে দ্রুত কাজটা সেরে এসো।’ আমিও নিজের দুর্বলতাটা লুকিয়ে রেখে তাদের সামনে সাইকেল নেয়ার ভান করি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলা যায়, কোনোমতে সাইকেল চালানো শিখে নিলে আর ঝামেলায় পড়তে হবে না। তাই ভাবছি এবার চূড়ান্ত চেষ্টা করব। বলছিলাম, রমজান মাসের কথা। তখন আমার হিফজ শেষ হয়েছে। পুরো মাস বাড়িতেই থাকা হবে। পাশের গ্রামের এক মসজিদে তারাবি ঠিক হলো। বড় ফুফুর বাড়ির মসজিদ হওয়া সত্ত্বেও তারাবির পর প্রতিদিন বাড়ি চলে আসি।
হঠাৎ একটা আইডিয়া মাথায় এলো। রমজানেই তো সুযোগ, কাজটা শিখে নেওয়া যায়। কোনোমতে শেখা হয়ে গেলেই আর কিছু না হোক অন্তত লজ্জাটা লুকানোর মতো ঠাঁই পাবো। আবার মাথায় এলো, উপস্থিত লজ্জাটার কী হবে? শিখতে গেল প্রথম প্রথম যখন বারবার হোঁচট খাবো তখন যে আমার সব কেরামতি জাহির হয়ে যাবে। আচ্ছা, যাকগে অসব ভেবে কাজ নাই। শিখতে পাড়লেই কেল্লাফতে। চাচাতো ভাইয়ের সাথে চুক্তি করলাম, সাহরি শেষে ভোর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন আমাদের মিশন শুরু করব৷ ও সায় দিলো, ঠিক আছে তাই হবে।
কাক ডাকা ভোরের আগেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছি। দিগন্ত চিরে সূর্যটা বেরিয়ে আসার আগে কারোর দেখা মেলেনি৷ এতক্ষণে মোটামুটি অনেকটা শেখা হয়েছে। ১৫, ২০ হাত যেতে পারি। এবার নিজের প্র্যাকটিসের পালা। আস্তে আস্তে ভয়টা কাটছে আবার দূরত্বটাও বাড়ছে। মাঠ ছেড়ে এবার রাস্তায় ওঠার ফিকির। ৮টার দিকে সাইকেল হাতে নিয়ে বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছি। মনে বেজায় আনন্দ। এখন আমি সাইকেল চালাতে শিখেছি। বিকেলে যে আর সময় দিতে পারব না। তেলাওয়াত করতে হবে, তারাবি পড়াতে হবে, আর একটু ঘুরে আসি। আম্মা বাধা দিলেন।
-না, আর যাসনে বাপ! ব্যথা পেয়ে আসবি।
-না, আম্মা ব্যথা পাবো না। একটু ঘুরেই ফিরে আসবো।
-দূরে কোথাও য্বে না কিন্তু।
আম্মার অনিচ্ছা সত্ত্বেও একমতন জোর করেই বেরিয়ে পড়লাম। আর বললাম, এক্ষুনি চলে আসবো আম্মা! বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠলাম। অদূরের পাকা সড়কটা পর্যন্ত যাবো আর ফিরে আসবো। ভালোয় ভালোয় ঠিকঠাক মতো পাকা সড়কে উঠলাম, কিন্তু ফেরার পথে হঠাৎ করে সামনের চাকাটা গর্তে পড়ে পা ফসকে প্যাডেলের লোহাটা পেন্ডলিতে ঢুকে পড়ে। হাঁটু এবং পেন্ডলির মাঝে দুই ইঞ্চির মতো লম্বা জখম হয়।
তখন মনে পড়ে যে, সবাই বলে, কেউ ব্যথা পায়নি আর সাইকেল চালানো শিখেছে এমন হয় না। কোমর থেকে গামছা খুলে পা বেঁধে নিলাম। আর মনে মনে বললাম ব্যথা যেহেতু পেয়েছি তাহলে আমারও সাইকেল চালানো শেখা হয়ে গেছে। যেই বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছি।
আম্মা বললেন, নিশ্চিত ব্যথা পেয়ে এসেছিস। গামছা খোলার পর আম্মা একপলক দেখেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এখন মনে পড়ে সেদিন আম্মার কথা উপেক্ষা না করলে হয়তো আমি এই বিপদে পড়তাম না।

Share.

মন্তব্য করুন