১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতির ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দিন। আমার জীবনেও এটি স্মৃতিময় এক শ্রেষ্ঠ দিন।
পুরো ৭১ সালটা চরম আতঙ্ক আর বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা দিন কাটিয়েছি। আমি তখন ৭ম শ্রেণির ছাত্র। বাড়ির সামনে স্কুল। সারাবছর লেখা-পড়া হয়নি বললেই চলে। শিক্ষকগণও ঠিক মতো স্কুলে হাজির হতেন না। বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রী ছিল অনুপস্থিত। এর মাঝেই ঘনিয়ে আসে বার্ষিক পরীক্ষা।
এক কুলাঙ্গার, হানাদার বাহিনীর দোসর, পবিত্র শবে বরাতের রাতে আমাদের গ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে নিয়ে এসে হানা দেয়। তারা গ্রামের অনেক ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। কারিগর বাড়ির এক চাচাকে জ¦লন্ত অগ্নির সামনে গুলি করে হত্যা করে। জালু চৌধুরী বাড়ির টগবগে যুবক মুক্তিযোদ্ধা গফুর ভাইকে তুলে নিয়ে যায়। পুরো গ্রামে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। চারদিকে ক্রন্দন রোল। ভোর রাতে সাহারীর সময় দূর দূর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। সকাল হতে না হতেই আমরা পশ্চিম পাড়ায় ছুটে গেলাম শত্রু বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ দেখার জন্য। ইতোমধ্যে খবর পাওয়া গেল গফুর ভাইকে পাক হানাদাররা গুলি করে মেরে ফেলে গেছে। গ্রামবাসী তার লাশ বসুরহাট-দাগনভূঞা রোডের পাশের খালে ভাসমান অবস্থায় পেয়েছে।
অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের ১ম সপ্তাহ ভোর রাত থেকে সকাল ৭টা-৮টা পর্যন্ত লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতাম। ভয়ে জান বেরিয়ে যাবার উপক্রম। এই বুঝি গোলা এসে আমাদের ঘরের ওপর পড়ছে। ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্তে পাক হানাদার বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সাথে প্রতিদিন যুদ্ধ চলতো। ধুম……. ধুম ধুম ধুম, ঠা… ঠা… ঠা… ঠা ঠা ঠা, কামান-মেশিনগানের গোলাগুলির ভয়ঙ্কর শব্দ। এরূপ গগনবিধারী বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যেত। লেখা-পড়ায় কোনরূপ মন বসতো না। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়। ইচ্ছার বাইরে অভিভাবকের চাপে প্রতিদিন স্কুল যাচ্ছি আসছি। উত্তর পত্রে কি লিখছি তার কোন খেয়াল নেই।
৫ ডিসেম্বর মধ্য রাত থেকে মারাত্মক এক যুদ্ধ লেগে যায় ফেনী বিলোনিয়া সীমান্তে। মুক্তি বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সাব-সেক্টর কমান্ডার কর্নেল জাফর ইমাম বীর বিক্রম। সাথে এক দল জানবাজ লড়াকু মুক্তিসেনা। পেছনে ভারতীয় মিত্র বাহিনী। চারদিক থেকে পাক হানাদার বাহিনীকে ঘিরে ফেলে মুক্তিসেনারা। সম্মুখ যুদ্ধে বহু ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখিন হয় আগ্রাসনকারী পাকিস্তানী সৈন্যরা। হানাদার বহুসৈন্য আত্মসমর্পণ করে, অনেকে মারা পড়ে, আর বাকিরা নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের দিকে অস্ত্র-সস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। অতি অনায়াসেই মুক্তি বাহিনী ৬ ডিসেম্বর সূর্য উঠার সাথে সাথে ফেনীকে শত্রু মুক্ত করে রক্তস্নাত স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে।
তখন হেমন্তকাল। অগ্রহায়ণ মাসের শেষ সপ্তাহ। মাঠে মাঠে আমন ধান কাটার মৌসুম। আমরা প্রায় দিন বিকেলে বাবা-চাচা ও দিনমজুরদের কাটা ধান মাঠ থেকে বোঝা বেঁধে মাথায় করে বাড়িতে নিয়ে আসতাম। ৬ তারিখ সন্ধ্যায় খবর এলো পাক হানাদার বাহিনী ফেনী ছেড়ে পালিয়ে গেছে। মিত্রবাহিনী ফেনী মুক্ত করে দাগনভূঞা এসেছে। এখন নোয়াখালী মুক্ত করার জন্য পশ্চিম দিকে এগোচ্ছে। ধান কাটা ফেলে আমরা চাচাতো-জেঠাতো ভাইয়েরা দৌড়াতে দৌড়াতে দল বেঁধে দানগভূঞা চলে এলাম। মিত্র বাহিনীর সাঁজোয়া যান দাগনভূঞা থামলো। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ তাদের স্বাগত জানালো। আমার শুকনো লিকলিকে হাতটি এক গুর্খা সৈন্যের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। তিনি আমার সাথে উষ্ণ করমর্দন করলেন। আমি বিজয়ের এক অতিন্দ্রীয় পুলক অনুভব করলাম।
মনে চরম ভয়ও কাজ করছিল। সড়কের উত্তর পাশে কামাল আতাতুর্ক হাই স্কুলে ছিল পাকবাহিনীর ক্যাম্প। এই বুঝি তারা আমাদের ওপর গুলি ছুঁড়বে। না; আমার এক বড় ভাই জানালেন, ভোর রাতেই পাততাড়ি গুটিয়ে তারা পালিয়ে গিয়েছে দাগনভূঞা থেকে।
মানুষের মুখে মুখে বিজয়ের গান। জয় বাংলা স্লোগান। সে কি আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল মানচিত্র আঁকা বাংলাদেশের একটি পতাকা হাতে নিয়ে আনন্দ মিছিল করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, চারিদিকে শুধু স্লোগান শুনছি, একটি পতাকাও চোখে পড়েনি। সে সময় বাংলাদেশের পতাকা পাওয়া ছিল অত্যন্ত দুর্লভ। কি বিভীষিকাময় সময় বয়ে গেছে গোটা দেশের ওপর। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের ভয়ে মুক্তিযুদ্ধের কোন চিহ্ন কারো কাছে পেলে নির্ঘাত মৃত্যু। রেডিওতে বিবিসি বাংলা সংবাদ শোনা ছিল হারাম। তবুও আমরা লুকিয়ে প্রতিদিন বিবিসির বাংলা ও আকাশবাণীর বাংলা সংবাদে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতাম। বিবিসির মার্কটালি ও আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ পাঠক দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায়ের কণ্ঠ এখনো আমার কানে বাজে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলো ছিল খুবই উদ্দীপনাময়। দেশের গান শুনে মন ভরে যেত। অভিনেতা রাজু আহমদের ‘জল্লাদের দরবার’ আর এম আর আখতার মুকুলের ‘চরম পত্র’ ছিল আমার প্রিয় অনুষ্ঠান।
দেশ তখনও সম্পূর্ণ শত্রু মুক্ত হয়নি। যদিও সীমান্তবর্তী প্রায় জেলা স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। আমাদের ফেনী ৬ ডিসেম্বর ও নোয়াখালী ৭ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে। পরীক্ষা তখনও চলছিল। সম্ভবত ১২ তারিখে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়। এখনকার মতো তখনও বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নানার বাড়ি, খালার বাড়ি ও ফুফুর বাড়ি বেড়ানোর চল ছিল। আমিও আমার ছোটবোন রায়হানা নানার বাড়ি বেড়াতে চলে এলাম।
আমার মামা চৌধুরী মোমিন উল্লাহ্ ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মাইজদি শহরে গিয়ে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশও করেছিলেন। কিন্তু তার সমবয়সী অধিকাংশ ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে পাকিস্তান আমলের শেষে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার মেট্রিক পরীক্ষা বাতিল করে দেয়। অবশ্য ১৯৭২ সালে পুনরায় সে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
মামা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী। ইনফরমার। গোপনে তিনি তার সাথীদের কাছে শত্রুসেনাদের গতিবিধি জানিয়ে দিতেন। এই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আমার মতিন মামা, সুফিয়ান মামা ও রুহুল আমিন মামা এবং নূরনবী দুলাল ভাইয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাকিদের কথা আমি যুদ্ধ শেষে জেনেছি।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকালে মামা আমাকে ডেকে বললেন, জাফর! আনন্দ সংবাদ আছে। আজ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আমরা পিকনিক করবো। আমি তো আনন্দে আত্মহারা। সত্যি এক সাথে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতে পাবো। যারা আমার স্বপ্নের নায়ক, বীর পুরুষ। যারা আমাদের মহান স্বাধীনতা সূর্যের উদয়ন ঘটিয়ে নতুন ভোর এনেছিল।
মামা আমাকে নিয়ে চললেন মুক্তিযোদ্ধা পিকনিকে। নানাদের বাড়ি থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার দূরে বসুরহাটের আগে মহাজন দীঘির পশ্চিম পাশে আবদুল হক মুন্সির বাড়ি। আবদুল হক মুন্সি আমার মামার ফুফা। আমার নানা। আশ্চর্য! ভেতর রুমে গিয়ে এক সাথে দুই ভাইয়ের সাথে আমাকে পরিচয় করে দিয়ে বললেন, ইনি তোমার মুক্তিযোদ্ধা জামাল মামা আর উনি তার ছোট ভাই তোমার মুক্তিযোদ্ধা কামাল মামা। ৯ মাস যুদ্ধ করার কারণে তাদের চেহেরা-সুরত একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। চোখ দু’টোও কোটরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। কিন্তু তাদের ঠোঁটের কোণে লেগেছিল বিজয়ের পরম আনন্দ। আমাকে বুকে জড়িয়ে খুব আদর করলেন দুই মামা। হাত ধরে অনেক কথা বলতে বলতে নিয়ে এলেন দক্ষিণমুখি বাড়ির দরজায়। তাদের কাছে যুদ্ধ জয়ের কত প্রশ্ন করে ফেললাম ইতোমধ্যে। জবাবও দিলেন স্বতঃস্ফূর্ত ।
দেখতে না দেখতেই তাদের সমবয়সী অনেক মুক্তিযোদ্ধা এলেন। পুরো দহলিজ ভরে গেল মুক্তিযোদ্ধাগণের শুভাগমনের। মুন্সি নানা ঘর থেকে নিয়ে এলেন দু’টি ঝাঁকিজাল। দু’জন মুক্তিযোদ্ধার দিকে হাত বাড়িয়ে জাল দু’টি দিয়ে বললেন, এ পুকুরে তোমাদের জন্য আমি মাছ চাষ করেছি। অনেক বড় বড় রুই কাতলা মৃগেল মাছ আছে। সাথে আছে শৈল বোয়াল। তোমাদের যত ইচ্ছে মাছ ধরতে পারো। আমি যাচ্ছি, তোমাদের জন্য আমার পালন করা সবচেয়ে বড় ছাগলটা জবাই করে রান্নার ব্যবস্থা করি। ছাগলটি লুকিয়ে লুকিয়ে পালন করেছি। যাতে পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা তাদের ক্যাম্পে খাবার জন্যে নিয়ে যেতে না পারে।
দেখতে দেখতে অনেক মাছ ধরা হলো। ছাগল জবাই করে রান্না হলো। মুরগির রোস্ট হলো। ঘরের ড্রয়িং রুম থেকে খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল বের করে রুমটিকে বেশ বড় করা হলো। মুক্তিযোদ্ধা মেহমানরা সবাই একত্রিত হলেন খাবার বিছানায়। জিনিস-পত্র আনতে আনতেই জামাল ও কামাল মামা পরিচয় করে দিলেন একে একে সব মুক্তিযোদ্ধাকে। সবার নাম এখন আর আমার মনে নেই। কিন্তু দু’য়েকজনের নাম জীবনে কখনো ভুলবো না। দুই নূরনবী- একজন মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার আরেকজন সাধারণ সৈনিক। খিজির হায়াত মামা, মতিন মামা এবং আরো কয়েকজন।
তাদের এই মিলনমেলা যেন মুক্তিযুদ্ধের বীরগাথা বর্ণনার অনুষ্ঠান। একেক জন বিভিন্ন স্থানে শত্রু সেনাকে কুপোকাত করার মজার মজার চমকপ্রদ বিবরণ দিচ্ছেন। আবার কখনো সাথী ভাইকে হারানোর বেদনায় বিমর্ষ হয়ে পড়ছেন। আবার আলোচনা করছেন, ঢাকা তথা সমগ্র বাংলাদেশ কখন শত্রু মুক্ত হয়ে আমরা পূর্ণ বিজয় উদ্যাপন করবো। ফাঁকে এক মামা গেয়ে উঠলেন: মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি….. অন্যরা তার সাথে গলা মেলাল। নানা পদের খাবার আনা হলো। একে একে তা পরিবেশন করা হলো। খাবার শেষ করতে করতে প্রায় বিকেল চারটা বেজে গেল।
মামা আমার হাত ধরে বাড়ির দিকে রওয়ানা হতে চাইলেন। আমি বেঁকে বসলাম। মামাকে বললাম, এতদিন আমি দূর থেকে কত গোলাগুলি আর কামান দাগার শব্দ শুনেছি। কিন্তু সামনাসামনি কখনো তা দেখিনি। এতগুলো মুক্তিযোদ্ধা একত্র হয়েছেন, সবার হাতে রাইফেল, বন্দুক, স্টেনগান দেখছি। আমাকে রাইফেল ধরে দেখান। আমিও স্টেনগান কাঁধে নিয়ে দেখবো কেমন লাগে। মামা না না করছেন আর আমাকে টেনে নিয়ে ছুটছেন। এমন সময় এগিয়ে এলেন আমার সাহসী মুক্তিযোদ্ধা কামাল মামা। তিনি শুন্যাআকাশে থ্রি নট থ্রি চাইনিজ রাইফেলের একটি গুলি ছুঁড়ে আমাকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করলেন। আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা মামা তার স্টেনগানটি আমার কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন, জাফর, তুমি একটু হেঁটে দেখ কেমন লাগে। আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা একটি হ্যান্ডগ্রেনেড খুব জোরে দূরে খালি মাঠে ছুঁড়ে মারলেন। বিকট আওয়াজে তা বিস্ফোরিত হলো। ফলে অনেক গ্রামবাসী চারদিক থেকে ছুটে এসে নানাদের বাড়ির সামনে জড়ো হলো।
কী আশ্চর্য! বসুরহাটের দিক থেকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে পিকনিক বাড়িতে ছুটে এলো। তাদের কাঁধেও রাইফেল। চোখে মুখে আশ্চর্য অনুভূতি, মুখে মুখে আনন্দ গান। তারা বাড়ির অদূর থেকে বলে উঠলো, আমরা আজ পূর্ণ স্বাধীন হয়েছি। আমরা বিজয় লাভ করেছি। ঢাকায় ৯৩ হাজার পাক হানাদার সৈন্য মিত্র বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করেছে।
এ কথা শোনার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধাগণ জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে আনন্দে ফেটে পড়লেন। সমস্বরে গগন বিদারী আওয়াজ স্লোগান চললো- “আমার দেশ তোমার দেশ- বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। আমার নেতা তোমার নেতা- শেখ মুজিব শেখ মুজিব। হৈ হৈ রই রই- পাক হানাদার গেল কৈ?” যার হাতে যে অস্ত্র আছে তা আকাশের দিকে লক্ষ করে একে একে গুলি ছুঁড়তে লাগলেন। আর বিজয়ী স্বাধীন দেশের মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে কোম্পানিগঞ্জ থানা সদর বসুরহাটের দিকে রওয়ানা হলো।

সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার।
মামা আমাকে নিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাড়ি ফিরলেন। চারদিকে আঁধার নেমে এসেছে। দূর দূর থেকে কুয়াশায় ঢাকা শীতের রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ভেসে আসছে ফাঁকা গুলির শব্দ। আমি শহীদ আলম মামার রেডিওর সামনে অনেকের সাথে দল বেঁধে বসে পড়লাম ঢাকার খবর জানতে।
আমার আলম মামা ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর নায়েক পদবিধারী একজন সৈনিক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁকে হানাদার বাহিনী হত্যা করে। এ খবর নিশ্চিত হতে আমাদের দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমরা সবাই ভেবেছিলাম তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। দেশ যেহেতু স্বাধীন হয়েছে, দায়িত্ব শেষ করে তিনি অবশ্যই একদিন বাড়ি ফিরবেন। সবাই একে একে দেশে ফিরছেন কিন্তু আলম মামা আর ফেরে না।
সেদিন সারারাত রেডিওতে দু’টি গান বারবার বেজেছিল:
১. কাজী নজরুল ইসলামের
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে
মোর টগবগিয়ে খুন হাসে।

২. গোবিন্দ হালদারের লেখা ও সমর দাসের সুরে-
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল।

ঘোষক বলছেন আপনারা ‘বাংলাদেশ বেতারের’ অনুষ্ঠান শুনছেন। অথচ আশ্চর্য, আজ সকাল ৭ টায় বাংলা ও উর্দূ সংবাদ শুনেছিলাম ‘রেডিও পাকিস্তান ঢাকা’ কেন্দ্র থেকে।
যুদ্ধকালীন ঐ ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়ে আমার কখনো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনাও বাদ পড়েনি। বাড়িতে থাকলে নিজেদের ঘরে, নানার বাড়ি গেলে আলম মামার ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে রেডিও শুনতান। বিজয় দিবসের রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ছিল অন্য দিনগুলো থেকে একেবারে আলাদা। সে কি আনন্দময় ঘোষণা, অভিমত ও উদ্দীপনামূলক বিজয়ের গান প্রচারিত হয়েছে বারবার।
এম আর আখতার মুকুলের কণ্ঠে ভেসে এসেছিল শেষ চরমপত্র।
কি পোলারে বাঘে খাইলো? শ্যাষ। আইজ থাইক্যা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যাষ। ঠাস্ কইরা একটা আওয়াজ হইলো। কি হইলো? কি হইলো? ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পিঁয়াজী সা’বে চেয়ার থনে চিত্তর হইয়া পইড়া গেছিলো। আট হাজার আষ্টশ’ চুরাশি দিন আগে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট তারিখে মুছলমান-মুছলমান ভাই-ভাই কইয়া, করাচী- লাহুর-পিন্ডির মছুয়া মহারাজরা বঙ্গাল মুলুকে যে রাজত্ব কায়েম করছিল, আইজ তার খতম্ তারাবী হইয়া গেল … …
১৭ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের সে বিজয়ের স্মৃতি আমাকে বারবার আন্দোলিত করে। কি সৌভাগ্য আমার, আমি বাংলাদেশের বিজয় দিবসের একজন ক্ষুদ্র সাক্ষী হয়ে আছি।

Share.

মন্তব্য করুন