আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। ইরাকের বাবেল শহরে জন্মেছিলেন হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম। তার পিতার নাম ছিল আযর। সে ছিল একজন মূর্তিপূজারি। পেশায় আযর ছিল একজন মূর্তি ব্যবসায়ী। আযর নিজ হাতে মূর্তি তৈরি করে বাজারে নিয়ে বিক্রি করতো। মূর্তিপূজার এই অবস্থা দেখে ইব্রাহিম (আ.) বিচলিত হয়ে উঠলেন। তিনি তাঁর বাবাকে বোঝানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। বললেন এক আল্লাহর কথা। আল্লাহর ইবাদাতের কথা। কিন্তু বাবা তার আহ্বান গ্রহণ করলেন না। তাকে হত্যার ঘোষণা দিলো। অতঃপর ইব্রাহিম আ. পিতাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি নিজ বাসা থেকে বেরিয়ে এলেন। বেরিয়ে তিনি গোটা বাবেলবাসীকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাতে লাগলেন। তাদেরকেও তিনি মূর্তিপূজা ও নক্ষত্র পূজার অসারতা ব্যাখ্যা করলেন। কিন্তু কেউই তার দাওয়াতে সাড়া দিলো না। তখন গোটা ইরাকের বাদশা ছিল নমরুদ। নমরুদ ছিল একজন অত্যাচারী বাদশাহ। সে নিজেকে খোদা দাবি করেছিলেন। আবার মূর্তি পূজাও করতো। ইব্রাহিম আ. এর এক আল্লাহর দিকে আহ্বান করার খবর বাদশা নমরুদের রাজ দরবারে পৌঁছে গেলো। বাদশাহ ইব্রাহিমকে ডাকলো। তার সব কথা শুনলো। রাজপ্রাসাদে রাজকর্মচারীদের সামনে ইব্রাহিমের যুক্তিতর্কের কাছে নমরুদ হেরে গেলো। সে অপমানে ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলো। সে ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহের অভিযোগ উত্থাপন করলো। অতঃপর তাঁকে শাস্তির মুখোমুখি করলো। ইব্রাহিম (আ:) কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হলেন।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইব্রাহিম আ. ২০০ বছর জীবিত ছিলেন। আর তাঁর জীবন মানেই পরীক্ষার জীবন। নবী হবার পর থেকে আমৃত্যু তিনি পরীক্ষা দিয়েই জীবন অতিবাহিত করেছেন। পরীক্ষার পর পরীক্ষা দিয়ে পূর্ণত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তিনি উন্নীত হয়েছেন। পরীক্ষায় উন্নীত হবার পরই মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ‘বিশ্বনেতা’ ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘যখন ইব্রাহিমকে তার পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তাতে উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা বানাবো। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকেও। তিনি বললেন, আমার অঙ্গীকার জালেমদের পর্যন্ত পৌঁছবে না।’ (সূরা বাকারা : ১২৪)। প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ ইব্রাহিম ও তাঁর বংশধরগণের মধ্যেই বিশ্ব নেতৃত্ব সীমিত রেখেছেন। ইব্রাহিম (আ.)-এর পরবর্তী সকল নবী তাঁরই বংশধর ছিলেন। আলে ইমরান বলতে ইমরান-পুত্র মূসা ও হারূন এবং তাঁদের বংশধর দাউদ, সুলায়মান, ঈসা প্রমুখ নবীগণকে বুঝানো হয়েছে। যাঁরা সবাই ছিলেন ইব্রাহিমের পুত্র ইসহাকের বংশধর। অপরপক্ষে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (সা:) ছিলেন ইব্রাহিমের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈলের বংশধর। সে হিসেবে আল্লাহ ঘোষিত ইব্রাহিমের বিশ্বনেতৃত্ব আজ অবধি বহাল রয়েছে।

ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের বয়স যখন ৮৬ বছর তখনও কোনো সন্তান হয়নি। এটাও ইব্রাহিমের জন্য ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বড়ো পরীক্ষা। তিনি আল্লাহর কাছে সন্তানের পিতা হতে দোয়া করলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর দোয়া কবুল করলেন। ইব্রাহিমের ছিল দুই স্ত্রী- হাজেরা এবং সারা। বিবি হাজেরার গর্ভে ইসমাইলের জন্ম হলো। ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম খুব খুশি হলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই স্ত্রী হাজেরা ও সন্তান ইসমাঈলকে নির্বাসনে পাঠাতে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ পেলেন। তিনি আল্লাহর নির্দেশ পালন করলেন দৃঢ়তার সাথে। কিছু খেজুর ও এক মশক পানিসহ স্ত্রী ও শিশুকে মক্কার এক নির্জন মরুভূমিতে রেখে যান। তাদেরকে রেখে যখন ইব্রাহিম একাকী ফিরছিলেন স্ত্রী হাজেরা বিস্মিত হয়ে স্বামীর পিছু পিছু আসলেন। বললেন, এভাবে আমাদের কার কাছে এবং কেন রেখে যাওয়া হচ্ছে? কিন্তু বুকে বেদনার স্রােত বাঁধা ইব্রাহিমের মুখ যেন তালাবদ্ধ ছিল। তাঁর মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। স্ত্রী নিজেই জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি আল্লাহর হুকুম? ইব্রাহিম মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক ইঙ্গিত দিলেন। সাথে সাথে হাজেরা মনোবল ফিরে পেলেন। বললেন, ‘তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না।’

অতঃপর তিনি শিশু বাচ্চার কাছে ফিরে এলেন। অল্প খাবার ও পানি শেষ হয়ে গেল। তিনি খাদ্য ও পানীয়ের সন্ধানে দৌড়াতে থাকেন। তিনি সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত ছুটলেন। এভাবে দুটো পাহাড়ে তিনি সাতবার দৌড়ান। সপ্তমবারে তিনি পাহাড় থেকে দেখেন, শিশু ইসমাঈলের পায়ের কাছে মরুভূমির বুকচিরে ঝরনা ধারা বেরিয়ে এলো। জিব্রাইলের পা অথবা পাখার আঘাতে এ ঝরনা সৃষ্টি হয়ছিল। তিনি পাহাড় থেকে ছুটে এলেন। বাচ্চাকে কোলে নিলেন। পানি পান করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। এরপর থেকে শুরু হলো ইসমাঈল (আ:) এর অধ্যায়। পানি হলো সকল জীবের বেঁচে থাকার সেরা উপাদান। মরুভূমিতে পানি দেখে সেখানে পাখির আনাগোনা বেড়ে গেলো। পাখির ওড়াউড়ি দেখে সেখানে ব্যবসায়ী কাফেলার আগমন ঘটলো। তারা হাজেরার কাছে পানি ব্যবহারের অনুমতি চাইলো। হাজেরা তাদেরকে বসতি স্থাপনের শর্তে পানি ব্যবহারের অনুমতি দিলেন। কোনো বিনিময় ছাড়া বসবাসের শর্ত তাদের কাছে বিস্ময়কর মনে হলো। তারা এ শর্ত সাগ্রহে কবুল করলো। এ কাফেলা হলো ইয়ামন থেকে আগত বনু জুরহুম গোত্র। এ গোত্রই পরবর্তীতে বায়তুল্লাহর খাদেম নিযুক্ত হয়েছিলো। ইসমাঈল (আ:) বড়ো হয়ে এ গোত্রে বিয়ে করেন। এ বংশেরই এক শাখা গোত্র হলো কুরাইশ বংশ। শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা:) এ বংশেই জন্মগ্রহণ করেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে এই পানির ধারাই জমজম কূপ নামে পরিচিত। যার শুরু আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে। এর স্বাদ, গন্ধ, রূপ, রস-কোনোটিতেই কোনো ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়নি! ইব্রাহিম আ: দোয়া করেছিলেন: ‘হে আমাদের রব! আমি আমার পরিবারের কয়েকজনকে তোমার পবিত্র ঘরের নিকট মরুভূমিতে বসবাসের জন্য রেখে যাচ্ছি। হে প্রভু! যাতে তারা সালাত কায়েম করে। তুমি কিছু মানুষের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও! আর তাদেরকে ফল-ফলাদি দ্বারা খাদ্যের ব্যবস্থা করো। তারা সম্ভবত কৃতজ্ঞ হবে।’ (সূরা ইব্রাহিম-৩৭)।
আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় বান্দার এ দোয়া এমনভাবে কবুল করেছেন যে, আধুনিক বিশ্বের যেকোনো শহরের চেয়ে পবিত্র মক্কায় সবসময় ফল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য ব্যাপক হারে মজুদ থাকে। আর তার দোয়ায় এখানে সালাত ও বিভিন্ন ইবাদত বছরের বারো মাস ধরেই চালু থাকে। তারই দোয়ার অংশ হিসেবে বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে সে শহরের দিকে আকৃষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আর সে অংশটি হলো মুসলিম বিশ্ব। ইব্রাহিমের জন্য সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিল একমাত্র শিশুপুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি করার নির্দেশ। শিশুপুত্র ইসমাঈলকে মক্কার উপত্যকায় রেখে এলেও ইব্রাহিম (আ.) তাদেরকে দেখাশুনা করতেন। মাঝে মধ্যে তিনি তাদেরকে দেখতে আসতেন।

ইসমাঈলের বয়স ১৩-১৪ তখন বছর। বলা যায় যে, পিতা তখন বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়েছেন আর ছেলে তখন সহযোগী হয়ে পিতৃহৃদয়ে পুরোপুরি জুড়ে বসেছেন। এমন সময়ে আল্লাহ ইসমাঈলকে কোরবানির নির্দেশ করলেন। আগের সকল পরীক্ষার চেয়ে এ পরীক্ষাটি ছিল সবচেয়ে কঠিন। আল্লাহ বলেন: ‘যখন পুত্র পিতার সাথে চলাফেরা করার মতো বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহিম তাকে বললেন, হে আমার ছেলে! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন তোমার অভিমত কী? ইসমাঈল বললো, হে পিতা! আপনাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে, আপনি তা কার্যকর করুন! আল্লাহ যদি চান অবশ্যই আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের কাতারে দেখতে পাবেন।’ (সূরা সাফফাত-১০২)। ‘অতঃপর পিতা-পুত্র উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করলো এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শুয়ায়ে দিল। তখন আমরা তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইব্রাহিম তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছো। আমরা এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমরা তার পরিবর্তে একটি মহান জবেহ প্রদান করলাম এবং আমরা এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম। ইব্রাহিমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক (সূরা সাফফাত-১০৩-১০৯)। ইতিহাসের গতিধারায় আজও বিশ্বের লাখ লাখ হাজি এ মিনাতেই কোরবানি সম্পন্ন করে থাকেন।

এখানে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, ইব্রাহিমকে আল্লাহ স্বপ্নে আদেশ করেছিলেন, সরাসরি আদেশ করেননি। তিনি স্বপ্ন না দেখিয়ে সরাসরি তাকে নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। কারণ, নির্দেশ করলে নির্দেশটি সাথে সাথে পালন হয়ে যেতো। সেখানে পরীক্ষার কিছুই থাকতো না। আর পরীক্ষা দিতে গিয়ে ইব্রাহিম পরীক্ষার ময়দানে শয়তানের ফাঁদ দেখতে পেয়েছিলেন। স্বপ্নের কাল্পনিক ব্যাখ্যার ফাঁদে ফেলতে শয়তান মাঝপথে বন্ধু সেজে তাকে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সে তা পারেনি। এর দ্বারা আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর নির্দেশ পালনে অকারণ প্রশ্ন ও যুক্তিবাদের আশ্রয় নেওয়া যাবে না। বরং সবসময় তার প্রকাশ্য নির্দেশনার উপর সহজ-সরলভাবে আমল করে যেতে হবে।

কোরবানি প্রতিটি মুসলমানের জন্য একটি ত্যাগের বিষয়। এ কোরবানি শুধুমাত্র মহান আল্লাহর তায়ালার খুশির জন্য করতে হবে। এতে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। লোক দেখানো বিষয় নেই। কে কত বেশি টাকার কোরবানি দিচ্ছে তা প্রচারেরও দরকার নেই। লোক দেখানো কোনো ইবাদত মহান আল্লাহ গ্রহণ করেন না। করবেন না। শুদ্ধ নিয়তে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য দিতে হবে কোরবানি।

Share.

মন্তব্য করুন