আমার ছেলেটি প্রায়ই একটি বড় স্বপ্নের কথা বলে। কী সেই স্বপ্নটি? স্বপ্নটি হলো- সে বড় হয়ে অনেক অনেক টাকা রোজগার করবে। ওর ভাষায়- ইনকাম করবে। এজন্য যে ওর টাকার কোনো অভাব বা টানাটানি যেনো না হয়। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টাকা যেনো থাকে ওর কাছে।
আমি মজা করে প্রশ্ন করলাম- অনেক অনেক টাকা তোমার কেনো লাগবে বাবা? কি করবে এত টাকা দিয়ে!
খুব উৎসাহের সাথে সোজাসুজি বললো- আমার স্বপ্ন হলো, পৃথিবীর অনেক অনেক দেশ ঘুরতে হবে আমাকে। অনেক অনেক দেশ দেখতে যাবো আমি । এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ করবো। যেখানে এবং যে দেশে ঘোরার ইচ্ছে করবে সে দেশে ঘুরতে যাবো। এত দেশ ঘুরতে গেলে ভ্রমণ করতে গেলে এত এত টাকা তো লাগবেই। বিমানে করেই তো যেতে হবে বিভিন্ন দেশে। ফাইভ স্টার হোটেলে থাকতে হবে। মজার মজার পছন্দের খাবারগুলো খেতে হবে। আবার পছন্দের জিনিসগুলো কিনতে হবে। তোমার জন্য আম্মুর জন্য পছন্দের জিনিস কিনতে হবে। ল এতকিছু করার জন্য দেখার জন্য ঘোরার জন্য খাওয়ার জন্য এবং কেনার জন্য আমার অনেক অনেক টাকাই তো লাগবে। তাই আমাকে অনেক টাকা ইনকাম করতে হবে।
ও যখন কথাগুলো বলছিলো আমি তখন চেয়ে রইলাম ওর দিকে। না, কোনোরকম সন্দেহ দ্বিধা বা জড়তা একটুও নেই ওর চেহারায় কিংবা কথায়। সহজ সরল আর সুদৃঢ় কথায় ওর মনের ভেতরে লুকায়িত কথাগুলো ফড়ফড় করে বলে ফেললো। উচ্চারণ শুনে মনে হচ্ছিল ও প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাগুলো বলছিলো। তাই আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিলাম আমার ছেলেকে। ভাবছিলাম- কী আশ্চর্য ! কখন আমার ছেলেটি এতকিছু বুঝে ফেললো! কখন টাকা পয়সার কদর বুঝে সে বিষয়ে একটি স্বপ্ন দাড় করিয়ে রাখলো মনের ভেতর। আমি তো ছোটবেলা থেকেই ওকে ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিয়েছি। যেভাবেই হোক বড় মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেছি। এখনও তা-ই করেই যাচ্ছি। কিন্তু অনেক টাকা ইনকামের কথা তো কখনও বলিনি। তাহলে ও কোথা থেকে এমন বড়লোকী স্বপ্ন জায়গা করে নিলো ওর মনের ভেতর। কীভাবে জন্ম নিলো এমন স্বপ্ন!
আমি অবাক হচ্ছি আর ভাবছি। ভাবতে ভাবতেই জিজ্ঞেস করলাম- আচ্ছা বাবা বলোতো এমন স্বপ্ন কেমন করে জন্ম নিলো তোমার মনে।
দেরী না করেই চটজলদি উত্তর দিলো- ইউটিউবে ভ্রমণ দৃশ্যগুলো দেখি। কত জায়গায় ওরা চলে যাচ্ছে। কত দেশ ঘুরে বেড়ায়। যা মন চায় তা-ই খায়। আবার কোনো জিনিস পছন্দ হলেই কিনে নেয়। এসব দেখে দেখে আমার মনে হলো- আমিও তো যেতে পারি। যদি আমার সেরকম টাকার জোগান থাকে।
ইস! আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম আমার ছেলেটিকে। ও তো মাত্র কলেজে পা রেখেছে। এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় যায়নি। অথচ টাকা ইনকামের চিন্তা ওর ভেতর আশ্চর্যজনক ভাবে বাসা বেঁধেছে।
আমার এক পরিচিত ব্যক্তি তার ছেলের কথা বললেন- এখনও স্কুল পার হয়নি। অথচ টাকা রোজগারের চিন্তায় মশগুল হয়ে গেছে ছেলেটি। ফ্রিল্যান্সিং করার জন্য একরকম বাজি ধরেছে। ছেলেটির কোনো এক ক্লাসমেট সম্ভবত ফ্রিল্যান্সিং করে বেশ টাকা পয়সা ইনকাম করছে। তাই তার ছেলেকেও ইনকাম করার সুযোগ দিতে হবে। কী আশ্চর্য কথা সব।
আমরা এখন এমন একটি সময়ে এসে পড়েছি যেখানে কোনো নীতি নৈতিকতার শিক্ষা কিংবা অনুশীলন নেই। সত্য কথা বলার এবং সত্য পথে চলার কোনো আয়োজন নেই। সবাই শুধু সুখ পাওয়ার জন্য এবং মন ভরে খাওয়া পরার জন্য বেঁচে থাকছে।
আমার ছেলেকে আমি সেই ছোটবেলা থেকেই বলছি- বাবা আমার অনেক টাকাওয়ালা হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। তুমি অনেক টাকা রোজগার করে এনে দেবে আমাকে এটি আমি চাই না। আমি চাই তুমি একজন সমাজের আদর্শবান মানুষ হও। জ্ঞানে গুণে তুমি সম্মানী হও। সবাই তোমাকে সৎ মানুষ হিসেবে জানবে। সবাই বলবে- এই ছেলেটি একটি চরিত্রবান ছেলে। সম্পদের প্রতি কোনো লোভ নেই। কারো ক্ষতি করে না। ক্ষতি করবেও না। অন্য আর দশটি ছেলে ওকে অনুসরণ করবে। কিংবা তাদের বাবা মা বলবেন- এই ছেলেটিকে অনুসরণ করো।
এসব যখন বলতাম, আমার ছেলেটি মুগ্ধ হয়ে শুনতো। মাথা নেড়ে সাঁই দিতো। বলতো আমি এসব সুন্দর করে করবো ইনশাআল্লাহ। আমি একজন ভালো মানুষ হবো তোমাকে কথা দিলাম।
কিন্তু হঠাৎ ছেলেটির মাথায় টাকা ইনকামের চিন্তা এসে আমার এতদিনের সকল উপদেশ ওলট পালট করে দিলো। অবশ্য এ-ও নয় যে ছেলেটি সব উপদেশ ভুলে শুধু টাকার জোগাড়ের কথা বলছে! কিন্তু সত্যি হচ্ছে- কিছু না কিছু তো গড়বড় হয়েছে। আর কেনো হয়েছে এ প্রশ্ন করাই তো যায়! হয়েছে ইউটিউব নামের এক ভয়াবহ নেট মাধ্যমের কারণে।
তোমরা যারা এখনও শিশু কিশোর তারা হয়তো ভাবছো- তোমাদের এত মজার ইউটিউবকে আমি ভয়াবহ বলছি! কিন্তু কেনো ভয়াবহ বলছি সেকথা কি তোমরা ভেবেছো! যদি না ভাবো তবে একবার ভাবো। তাহলে দেখতে পাবে এই ইউটিউব কীভাবে তোমার সময়গুলো খেয়ে নিচ্ছে। কীভাবে তোমাকে লেখাপড়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। যে সময়টিতে তুমি লেখাপড়া করে নিজের জ্ঞান বুদ্ধি বাড়াবে, নিজেকে উপযুক্ত করে তুলবে সেসময় তোমাদের সময়ের বিরাট অংশ খেয়ে ফেলছে ইউটিউব নামের এক রঙিন দৃশ্য। এখানে যার যা ইচ্ছে তা-ই করে পোস্ট করে দিচ্ছে। আর তোমরা সেটাকেই সত্য মনে করে সেরকম কিছু করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছো। যেমন আমার ছেলের গল্প বললাম।
আমি আমার ছেলেকে বললাম- ধরো তুমি বড় হয়ে অনেক অনেক টাকা আয় করলে। সেই টাকা দিয়ে অনেক দেশ ঘুরলে খেলে কেনাকাটা করলে। তোমার মনের যত স্বপ্ন ইচ্ছে বা চাহিদা পুরন করলে। তারপর কি করবে?
বেশ চমকে গিয়ে থমকে গেলো আমার ছেলেটি। বললো- বাবা এটা তো ভাবিনি যে আমার স্বপ্ন পুরন হয়ে গেলে তারপর আমার কাজ কি হবে!
বললাম- এখন ভাবো তাহলে! ভেবে বলো কি হবে তারপর!
আমার ছেলেটি দুইদিন সময় নিয়ে খুব করে ভাবলো। কিন্তু তার ফলাফল সেই একইরকম হলো। অর্থাৎ এরপর কি করবে তার কোনো সমাধান দিতে পারলো না সে। কোনো সমাধান দিতে পারেনি তার ভাবনা।
আমি বললাম- তাহলে এবার বোঝো হে আমার প্রিয় বৎস! টাকা পয়সা এটি চলার জন্য দরকারী। কিন্তু টাকা ইনকাম কি একজন মানুষের বড় স্বপ্ন হওয়া উচিৎ?
আমার ছেলেটি খুব নরম কণ্ঠে জবাব দিলো- না বাবা শুধু টাকা ইনকাম করা কারো বড় স্বপ্ন হওয়া উচিৎ নয়। একটু দম নিয়ে বললো- বাবা আমি বুঝেছি কেনো তুমি সবসময় আমাকে বড় মানুষ হওয়ার কথা বলো। কেনো ভালো লেখাপড়া করে শিক্ষিত হওয়ার কথা বলো। আর কেনো বলো সত্যিকার জ্ঞান অর্জনের কথা। কারণ সত্যি মানুষ হতে গেলে জ্ঞান অর্জন করতেই হবে। জ্ঞান ছাড়া মানুষ হওয়া সম্ভব নয়।
ছোট বন্ধুরা এবার তোমরাও ভাবো যে জ্ঞান অর্জন ছাড়া সত্যিকার মানুষ হওয়া সম্ভব কিনা! নতুন বছর এসে গেছে। নতুন বছরে নতুন করে জীবনকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করতে হবে। সময়কে সুন্দর করে কাজে লাগিয়ে নিজেকে উন্নত মানুষ হিসেবে তৈরি করার কাজটি করতে হবে। তাহলেই নতুন বছর নতুন করে তোমাকে এগিয়ে দেবে।

Share.

মন্তব্য করুন