সেই ছোটবেলায় যখন বইয়ে পড়তাম আমাদের এই পৃথিবীতে মহাসাগর হলো পাঁচটি আর মহাদেশ সাতটি খুব মজা লাগতো। আরও খুব খুব মজা এবং অবাক হয়েছিলাম এ কথা জেনে যে- পঞ্চাশ কোটি বছর আগে আমাদের সবগুলো মহাদেশ একসাথে ছিলো!
মহাদেশ নিয়ে যখন পড়েছি এবং শিক্ষকের মুখে শুনেছি কত কত কথা মনে ভাসতো, কত রকম প্রশ্ন জাগতো, কল্পনা জাগতো আর স্বপ্ন ঘিরে থাকতো। মনে হতো আহা যদি আমি পাখি হতে পারতাম এবং পাখির মতো উড়তে পারতাম তাহলে সারা বিশ্বের সবগুলো দেশ উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে দেখে এসে গল্প করতাম সবার কাছে। বলতাম এত এত দেশ ঘুরে ফিরে ভ্রমণ করে কত কি দেখে এসেছি। দেখেছি কত কত মানুষ কতরকম বনবনানী নদী পাহাড় জঙ্গল আর মরুভূমির শুকনো বালির বিশাল দিগন্ত। সবাই আমাকে কত যে বাহবা বাহবা বলে আদর সমাদর আর সম্মান দিয়ে কথা বলতো, মাথায় তুলে রাখতো! আমার কথা লেখা হতো বড় বড় ইতিহাসের পাতায় পাতায়। কিন্তু আমি তো কোনোদিন পাখি হতে পারবো না বা পাখির মতো আমার কোনো পাখাও নেই, তো কী করে উড়বো ঘুরবো আর দেখবো এবং মানুষকে বলবো আর ইতিহাস হবো।
সে কথা থাক তবে, আসি অ্যান্টার্কটিকার মহা রহস্যময় গল্পের কাছে।
আমরা তো সবাই জানি আমাদের এই পৃথিবীতে মহাদেশের সংখ্যা সাতটি। তো এই সাতটি মহাদেশের মধ্যে একটি মহাদেশের নাম হলো- ‘অ্যান্টার্কটিকা’ মহাদেশ। নামটি শুনেই আমার কেমন যেনো বেশ অদ্ভুত অদ্ভুত লাগছিলো। আমার কাছে অদ্ভুত লাগার কারণ হলো- বাকি সবগুলো মহাদেশের নাম শুনে মনে হয় কোনো না কোনোভাবে আমাদের এই পৃথিবীর মাটি ও মানুষের সাথে কিছু না কিছু সম্পর্ক আছে। কিন্তু অ্যান্টার্কটিকা নামটার সাথে মনে হয় যেনো তেমন সম্পর্ক নেই। পরে কোনো একদিন আমাদের স্কুলে ক্লাসে যখন ভূগোল শিক্ষক বললেন- তোমরা তো জানো, ছয়টি মহাদেশে অনেক অনেক দেশ আছে, কিন্তু অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে কোনো দেশ নেই! শুনে অবাক হয়েছিলাম ! মনে মনে ভাবলাম- আরে দেশ ছাড়া আবার মহাদেশ হয় কি করে!
এটি ভাবতে ভাবতে শিক্ষক আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বেশ কৌতূহলের সাথে বললেন- অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে কিন্তু কোনো মানুষও নেই! এ মহাদেশে বাস করে না কোনো মানুষ। এ কথা শুনে আমাদের সবার আক্কেল গুড়ুম। আর আমার ভেতরে ভেতরে খুব বিস্ময় বিষয় কাজ করছিলো এই ভেবে যে আমি অ্যান্টার্কটিকা নাম শুনে কিভাবে ভাবলাম এই নামের সাথে মানুষ ও মাটির সম্পর্ক তেমন নেই।
ভেতরে বিস্ময় ভাব লুকিয়ে রেখে শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলাম- আচ্ছা স্যার এই মহাদেশে দেশও নেই, মানুষও নেই, এ আবার কেমন করে মহাদেশ হয়?
আমার মিনমিনে স্বরে প্রশ্নটি শুনে শিক্ষক ভীষণ মজা পেয়ে হা হা হা করে হেসে দিলেন! হাসলেন ঠিক কিন্তু তারপরই খুব সিরিয়াস হয়ে বললেন- শোনো হে বালক, এটিইতো মহান সৃষ্টিকর্তার বিশাল ও বিস্ময়কর সৃষ্টির রহস্যময় লীলাখেলা! তাঁর সৃষ্টিতে যে কত কত বিস্ময় এবং মহা বিস্ময় লুকিয়ে আছে তার তো কোনো শেষ নেই সীমা ও নেই। তারপর একটু শ্বাস নিয়ে খুব আন্তরিকতা মিশিয়ে বললেন- তোমাদেরকে মহান আল্লাহর এইসব মহা সৃষ্টির রহস্য আর সৌন্দর্য নিয়ে খুব করে ভাবতে হবে। সৃষ্টিকর্তার এইসব রহস্যময় সৃষ্টি নিয়ে যদি ভাবতে পারো তাহলে তুমি দেখবে এই পৃথিবী ও বিশ্বজগৎ এক মহান নিয়মের মধ্যে দিয়ে চলছে যে যার পথে। সকল সৃষ্টিই মহান আল্লাহর নিয়ম মেনে চলছে, তাঁর হুকুম মেনেই চলতে হচ্ছে সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ এবং আকাশের চাঁদ সূর্য গ্রহ নক্ষত্র ধূমকেতু ছায়াপথ নীহারিকা উল্কাপি- সব এবং সবকিছু।
আমার প্রিয় সেই শিক্ষকের কথা শুনে তেমন কিছু বুঝিনি সেদিন। কিন্তু পরে বড় হয়ে যখন সৃষ্টিজগৎ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম, মনে হলো জ্ঞানের জগতে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো জ্ঞানের ভা-ার বা জ্ঞানের কারখানা নেই। এই বুড়ো বয়সের কিনারে এসে এখন মনে হয় সব ছেড়ে ছুড়ে শুধু সৃষ্টিজগতের রহস্য উদঘাটন করাই মানুষের জীবনে মহামূল্যবান একটি বিষয়!
সেই বিস্ময়কর সৃষ্টির একটি রহস্যময় সৃষ্টি হলো- পৃথিবীর সর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যপূর্ণ এক স্থলভূমির সমাহার আর রহস্যময় সেই স্থানটি হলো, অ্যান্টার্কটিকার হিমশীতল বরফের রাজত্ব। বরফের এ রাজত্ব প্রায় ৫৪ লাখ বর্গমাইলেরও বেশি জুড়ে বিস্তৃত। এভাবে সেদিন শিক্ষক আরও কত কি সব বলেছেন তার আগা মাথা কিছুই বুঝিনি আর মনেও নেই। তার অল্প কিছু অংশ কেবল মনে ছিলো যা বললাম উপরে। কিন্তু সেদিন আমার সেই শিক্ষক অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ নিয়ে আমার মনে যে কৌতূহল জাগিয়ে দিয়েছিলেন সেই কৌতূহল থেকে আমি বিশ্বজগৎ নিয়ে নানারকম চিন্তা ভাবনা আর পড়াশোনা করছি আজও। যত ভাবি ততই অবাক আর অবাক লাগে! ততই মনে হয় হায়রে মহান আল্লাহর সৃষ্টির কাছে আমরা মানুষ তো ধরতে গেলে কিছুই না। তবুও কতরকম অহঙ্কার আর বাহাদুরির খামটি নাচ দেখাই তার তো কোনো শেষ নেই!
আমার সেই শিক্ষককে খুব মনে পড়ে- তিনি নেই পৃথিবীতে, তবুও মনে পড়ে। তার কথাগুলো বড় ভালো লাগতো সেই সময় যখন আমি তেমন কিছু বুঝিও না। বুঝি না কিন্তু শুনতে ভালো লাগতো এ-ও এক অদ্ভুত বিষয় বলে মনে হয়। কি যেনো এক টান ছিলো তার কথায় যে কারণে তিনি যতক্ষণ কথা বলতেন ততক্ষণ আমরা কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে বসে একমনে শুনতাম। সেই শোনার কারণেই হয়তো আজ মহাবিশ্ব নিয়ে পড়ছি ভাবছি দেখছি এবং আমার ছাত্রদের এসব বিষয়ে শেখাচ্ছি এবং শিখতে উৎসাহ দিচ্ছি।
সেই থেকে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ আমার কাছে এক মহা বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার মনের ভেতর। আমি সুযোগ করে অ্যান্টার্কটিকা এবং মহাবিশ্বের নানান সৃষ্টি বৈচিত্র্য নিয়ে পড়ি এবং অনুভব করি।
অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ৯৮ ভাগ এলাকাই বরফের আস্তরে ঢাকা। এ মহাদেশের মোট আয়তন ১ কোটি ৪২ লক্ষ বর্গমাইল। এই আয়তনের ৯৮ ভাগই বরফে ঢাকা, কী আশ্চর্য কথা! এই যে ৯৮ ভাগ বরফ তা কি বরফের সাধারণ আস্তরণে ঢাকা? না, সাধারণ আস্তরণ নয় বরং নিচের দিকে এক কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত পুরু বরফের আস্তরণ।
এই মহাদেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বাতাস প্রবাহিত হয়ে থাকে। বাতাসের গতিবেগ কখনও কখনও দুইশ মাইল বেগেও ছুটতে থাকে।
মাঝে মাঝে হঠাৎ বরফের ঝড় হয়। তখন চারিদিকে নেমে আসে ভয়াবহ অন্ধকার! কিন্তু এই অন্ধকার কেমন হয়?
এর উত্তর তো সবার জানা- তাই না! অর্থাৎ অন্ধকার তো কালোই হয়, তাই হবে!
কিন্তু না, অ্যান্টার্কটিকা তুষার ঝড়ের অন্ধকার মোটেই কালো নয় বরং একদমই সাদা। কি শুনে খুব অবাক মনে হচ্ছ বুঝি! হ্যাঁ অবাক হলেও এটিই সত্যি যে অ্যান্টার্কটিকা তুষার ঝড়ের অন্ধকার হলো সাদা অন্ধকার।
অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে ঋতু মাত্র দুটি- শীত আর গ্রীষ্ম ঋতু। কিন্তু মজার বিষয় হলো শীত ঋতুতে একটানা চার মাস সূর্য ওঠে না। কি অদ্ভুত বিষয়টি! এ সময় বরফ এতোটাই ঠা-া হয়ে যায় যে তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ৮০ ডিগ্রিতে নেমে যায়।
আবার গ্রীষ্ম ঋতুতে সূর্য দিগন্ত রেখার চারদিকে ঘুরতে থাকে ঘুরতে থাকে। ফলে সূর্য আর অস্তই যায় না।
আরেকটি অন্যরকম মজার বিষয় হলো চাঁদ নিয়ে। দীর্ঘ রাতে যখন চাঁদ ওঠে ওই চাঁদটি আমাদের পূর্ণিমা চাঁদের মতোই হয়। মজাটা হলো একবার চাঁদ উঠলে অ্যান্টার্কটিকার আকাশে একটানা সাতদিন দেখা যায় চাঁদটি।
আরেকটি বিস্ময়কর বিষয় হলো- অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে পৃথিবীর মিষ্টি পানির ৭০ ভাগ পানি জমা করে রাখা হয়েছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বরফের চাঁই আছে এই অ্যান্টার্কটিকায়। এর নাম হলো- ‘দ্য রস আইস শেল্ফ।’
এই বরফের চাঁই এর আয়তন হলো ১৯ লক্ষ ৭ হাজার বর্গমাইল। আবার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বতমালার একটি হলো- গ্যাম্বার্টসেভ। এর দীর্ঘতা প্রায় ৭ শ পঞ্চাশ মাইল। উচ্চতা হলো ৯ হাজার ফিট। বিস্ময়ের বিষয় হলো এটি অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থিত এবং এটি বরফের আস্তরে ঢাকা।
বরফের তিন কিলোমিটার গভীরে আছে মিষ্টি পানির হ্রদ।
এসব শুনে এবং জেনে আমার ভেতরটা বড় বেশি অবাক হয়ে আছে। মহান আল্লাহর সৃষ্টির এত এত গূঢ় রহস্য আছে যা অনুভব করা এবং ভাষায় বর্ণনা করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি কোনোদিন। এবং ভবিষ্যতে হবেও না। তবে মানুষের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এগিয়ে চলছে, নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে নতুন নতুন বিষয়ও জানা হবে।
যারা আজ ছোট বিশেষ করে তোমরা যারা পড়াশোনা করছো, তোমাদেরকে অবশ্যই আরও এগিয়ে যেতে হবে। আরও আরও বিষয় জানতে হবে, জানাতে হবে পৃথিবীবাসীকে।
আমি আশা করি অ্যান্টার্কটিকার এতসব বিস্ময়ের সাথে তোমরা আরও বিস্ময় যোগ করবে। তোমাদের আবিষ্কারে বিস্মিত হবে পৃথিবীর মানুষ!

Share.

মন্তব্য করুন