একজন মানুষ জীবনে ইচ্ছা, স্বপ্ন, পরিকল্পনা আর প্রাপ্তির হিসেব কতটুকু মেলাতে পারে? আমাদের দেশে মানুষের গড় আছু কমবেশি ৭০ বছর। অনেক সৌভাগ্যবান অবশ্য বেশিদিন বাঁচেন। এই সীমিত আয়ুর জীবনে মানুষের সাধ আহ্লাদের অন্ত নেই। প্রত্যেকেরই থাকে হাজারো স্বপ্ন। অনেকের হয়তো বেশির ভাগ স্বপ্নই পূরণ হয় না। আবার কিছু কিছু মানুষ হয়তো তার স্বপ্ন-সদিচ্ছার কিছু কিছু বাস্তবে রূপ দিতে পারে। মানে স্বপ্নের অনেকটাই কাছাকাছি পৌঁছে যান তারা। আমরা তাদের বলি সফল মানুষ। তাদের সাফল্যের গল্প জেনে অন্যরাও আনন্দিত হয়। অনেক উঁচুতে তার সম্মানের জায়গাটা নির্ধারিত হয়। আজ আমরা জানব, এমনি সফল এক মানুষ নাম জন গডরাডের গল্প।

লস অ্যাঞ্জেলসের বৃষ্টিস্নাত কোনো এক বিকেল। সালটা ১৯৪০। রান্নাঘরের টেবিলে বসে আছে ১৫ বছরের এক বালক। হঠাৎ কি ভেবে জীবনের একটা তালিকা লিখতে লাগলো সে। ‘মাই লাইফ লিস্ট’ শিরোনাম দিয়ে পেন্সিলের আঁচড়ে লিপিবদ্ধ করতে থাকলো জীবনের লক্ষ্য। অনাগত ভবিষ্যৎ জীবনে সে কী কী করবে তার বর্ণনা। জীবনের ইচ্ছে আর স্বপ্নের তালিকা। যেমনটি অনেকে করে থাকেন ছেলেবেলায়। লিখতে লিখতে তালিকায় স্বপ্নের সংখ্যা একশ পার হয়ে গেল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী নীল নদের অ্যাডভেঞ্চার থেকে তালিকার শুরু। সবশেষ ১২৭তম স্বপ্নটা সে লিখল, একুশ শতক পর্যন্ত বেঁচে থাকা। বৈচিত্র্যময় তালিকার দিকে নজর দিলে যা দেখা যাবে, তা বাস্তবে দূরে থাক খুব কম মানুষের পক্ষে স্বপ্নেই সেগুলো ভাবা সম্ভব। কিন্তু গডরাড সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যিনি প্রায় সবগুলো লক্ষ্যই অর্জন করতে পেরেছিলেন। ৬১ বছর বয়সে তিনি হিসেব করে দেখেন ১২৭টি স্বপ্ন আর লক্ষ্যের মধ্যে ১০৯টি পূরণ হয়েছে! অবিশ্বাস্য!

প্রথম ৮টি অগ্রাধিকার লক্ষ্যের মধ্যে ৫টি পূরণ হয় তার। ৬ হাজার ৬শ ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী নীলনদ ও পৃথিবীর সবচেয়ে প্রশস্ত নদী অ্যামাজান পাড়ি দেন তিনি। এছাড়া কঙ্গো নদী, কলোরাডো নদী, নিকারাগুয়ার রিও কোকো নদী ভ্রমণের ইচ্ছেও তিনি পূরণ করেন। বিভিন্ন দেশ বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন তালিকার ১২টিই তিনি শেষ করেন। এরপরের তালিকায় ছিল বিশ্বের ১৬টি পর্বতচূড়া অভিযান। এভারেস্ট, অ্যাকাঙ্কাগুয়া এবং ম্যাককিনলে পর্বত বাদে বাকি সবগুলো পর্বতেই তিনি সাফল্যের সঙ্গে অভিযান শেষ করেন।
এই স্বপ্নবাজ মানুষটির পরের লক্ষ্য ছিল ফটোগ্রাফি। তাও যেনতেনভাবে শখের ফটোগ্রাফি নয়। তার লক্ষ্য নিজ হাতে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত, নায়াগ্রা জলপ্রপাত, ব্রাজিলের ইগাজু, নিউজিল্যান্ডের সাদারল্যান্ড জলপ্রপাতের ছবি ধারণ করা। শুধু তাই নয় বিখ্যাত পরিব্রাজক মার্ক পোলো এবং অপরাজেয় যোদ্ধা আলেকজান্ডার দি গ্রেটের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহেও তিনি ভ্রমণ করেন এবং আলোকচিত্র ধারণ করেন।

তার স্বপ্ন ছিলো জলে অভিযানও। ফ্লোরিডার কোরাল রিফ, অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ, ফিজি দ্বীপে ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। এছাড়া চীনের মহাপ্রাচীর, সুয়েজ খাল, ভ্যাটিকান সিটি, ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, ভারতের তাজমহল, টাওয়ার অব লন্ডন, পিসার হেলানো টাওয়ার, মিশরের পিরামিড এবং চেচেন ইৎজাসহ বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানসমূহও তার পদচারণার বাইরে থাকেনি।

বিশ্বের অন্যতম সেরা ৫টি হ্রদে তিনি সাঁতার কাটতে চেয়েছিলেন এবং ভিক্টোরিয়া, সুপিরিয়র, টিটিকাকা, তাঞ্জানিয়াকা ও নিকারাগুয়া হ্রদে তিনি সাঁতার কাটেন।
গডরাড ডুবোজাহাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। সঞ্চয় করেন আকাশে ওড়া, প্যারাসুটের মাধ্যমে ড্রাইভ দেয়ার অভিজ্ঞতাও। তিনি বাঁশি এবং ভায়োলিন বাজানো শিখেছিলেন। একটা বই লেখার ইচ্ছাও ছিলো তাঁর। নীলনদ অভিযানের ওপর বইও লিখেন। এছাড়া ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ম্যাগাজিনে একটা আর্টিকেল লেখার ইচ্ছাও পূরণ হয় তার। জীবনের লক্ষ্য তালিকার মধ্যে ৫ মিনিটে এক মাইল দৌড়াতেও সমর্থ হন। তিনি ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ এবং আরবি ভাষাও জানতেন। বিমান, মোটর সাইকেল, ট্রাক্টর, সার্ফবোড, রাইফেল, পিস্তল চালানোতে দক্ষতা অর্জন করেন। পারদর্শী ছিলেন ফুটবল, বাস্কেটবল, তীর-ধনুকের খেলাতেও। খেলেছেন পোলোও। গান লেখার ইচ্ছেটাও পূরণ হয়েছে তার। ভাবছো, এত্ত এত্ত লক্ষ্য পূরণের দৌড়ে তিনি ঘর সংসার ভুলেই দৌড়েছেন! ভুল ভেবেছো। তার লক্ষ্যপূরণ তালিকায় ১২৬ এ ছিল স্ত্রী ও সংসার। তিনি ৬ সন্তানের জনক। জন গডরাডের ১২৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ১০৯টি পূরণ হয়! তার সবশেষ ইচ্ছেটাও পূরণ হয়। একুশ পর্যন্ত বেঁচে আছেন তিনি।

Share.

মন্তব্য করুন