‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’ সেই বিখ্যাত গল্প তো তোমরা জানোই। জার্মানের এক ছোট্ট শহর হ্যামিলন। যেখানে ইঁদুরের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল শহরের মানুষের জীবন। শহরের মেয়র একবার ঘোষণা করেছিলেন এ যন্ত্রণাময় জীবন থেকে যে তাদের বাঁচাতে পারবে তাকে মোটা অঙ্কের পুরস্কৃত করা হবে। কিছুদিন পর হ্যামিলন শহরে উদয় হলো রঙচঙা পোশাকে রহস্যময় এক বাঁশিয়াওলা। তার জাদুময়ী বাঁশির মোহনীয় সুরে ঘর, গলি ও গর্ত ছেড়ে সব ইঁদুর বেরিয়ে ছুটতে থাকে বাঁশিওয়ালার পেছন পেছন। সেই প্রাচীন ৭০০ শত বছর আগের গল্পে দেখা বাঁশিওয়ালার বাকি কাহিনীতে কী ঘটেছিল তা তো তোমাদের জানাই আছে। এই আধুনিক যুগে এসে যদি কেউ বলে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকে খুঁজে পেয়েছি, এ কথা যেমন সম্পূর্ণ অবাস্তব তেমনি বিরাট হাস্যকর মনে হবে।
কিন্তু কাল্পনিক গল্পের বাস্তবতা কে না দেখতে চায়। কে না দেখা পেতে চায় সেই রহস্যময় মোহনীয় বাঁশিওয়ালার। তাকে কাছে পেলে কে না ডুব দিয়ে শুনতে চাইবে তার মন্ত্রমুগ্ধ বাঁশির সুর।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি! হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। তাহলে তো এবার সেই বাঁশিওয়ালাকে দেখতে ও বাঁশির সুর শুনতে যেতে হবে জার্মানের হ্যামিলনে। সেখানে যেতে লাগবে পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট- এসব কিছুই তো তোমার নেই। আসলেই। চিন্তা করো না উপায় একটা আছে। এসব কিছুই লাগবে না। চলো ঝটপট যশোরের কেশবপুর যাই। কেশবপুরেই থাকে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। নাম তার মাহতাব আলী। গ্রামে সে মৌমাছি মাহতাব নামেই পরিচিত। একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। ছোটবেলায় তেমন পড়াশোনা করেননি। তার বাবা কালা চাঁদ মোড়ল ছিলেন একজন মৌয়াল। ১০-১২ বছর বয়স থেকেই মাহতাব আলী বাবার সঙ্গে মৌচাক ভাঙার কাজে নেমে পড়েন এবং বাঁশি বাজানো রপ্ত করেন। মাহতাব সুন্দরবন, যশোর, সাতক্ষীরা ও এর বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে মৌচাক ভেঙে মধু সংগ্রহ করেন। মৌচাক ভাঙতে ভাঙতে মৌমাছির প্রতি তার একধরনের ভালোবাসা জন্মে। মৌচাকে মৌমাছি তাড়াতে মৌয়ালরা সাধারণত ধোঁয়া ব্যবহার করে। কিন্তু মাহতাব ছিল ব্যতিক্রম। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো মাহতাব ছোটবেলা থেকেই বালতির শব্দে মৌমাছি তাড়ানোর কৌশল রপ্ত করেন। তার ভাবনার কারণ মানুষ বাঘ, ভাল্লুক ও সিংহের মতো মাংসাশী প্রাণীকে যদি পোষ মানাতে পারে তবে সে কেনো সামান্য মৌমাছিকে পোষ মানাতে পারবে না। তাই চিন্তা করলেন শুধু তাড়ানো নয় বালতিতে অন্য শব্দ করে কিভাবে মৌমাছিদের তার কাছে আনা যায় সে কৌশল আগে রপ্ত করা চাই। এ ভাবনা থেকে বালতি দিয়ে রপ্ত করতে থাকেন মৌমাছি কাছে আনার কৌশল। বাড়িতে রাখা মৌচাকের পাশে বসে বালতির শব্দেই চেষ্টা করলেন মৌমাছি তার কাছে আনার কৌশল এবং পেরেছেনও বটে। তখন মৌমাছিরা মৌচাক ছেড়ে উড়ে এসে তার গায়ে বসতে শুরু করে। সংখ্যায় তেমন কিছু নয়। তখন তিনি তাদের খাবার দিলেন। এ সফলতার পর তিনি সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বালতি ছেড়ে শুরু করেন থালা বাজানো। এবার মৌমাছির সংখ্যা আগের চেয়ে বেশি এসেছে এবং তার গায়ে বসেছে। এখানেও সফল হওয়ার পর তার চিন্তা এবার আরো উচ্চমাত্রায় গিয়ে ঠেকে। ছোটবেলায় যে বাঁশি বাজানো রপ্ত করেছিলেন এবার সে বাঁশির সুর দিয়ে চেষ্টা করলেন মোমাছিরা কাছে আসে কিনা। এ তো মহাবিস্ময়! বাস্তবের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা কি তবে কেশবপুরেই জন্মালেন। বাঁশের বাঁশির সুর প্রয়োগ করা মাত্র ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি এ বাঁশরির কাছে আসতে শুরু করল। গুনগুন শব্দে মৌমাছি বসতে শুরু করল তার গায়ে। অথচ মাহতাব নিজে কোনো বৃক্ষ বা তার ডাল নয়। কোনো বৃক্ষের সাথে সেঁটে থাকা মৌচাক নয়। অথবা মৌচাক চাষের কোনো বাক্সও নয়। তবু তাকে দেখতে লাগছে এক জীবন্ত মৌচাক। বাঁশি বাজানো শেষ তো মৌমাছিরা নিমিষে উড়ে যায় আসল মৌচাকে। এ তো কেশবপুরের বাঁশিওয়ালার রহস্যময় বাঁশির ভাষার চমক।

Share.

মন্তব্য করুন