বারাক হোসেন ওবামা জুনিয়র ১৯৬১ সালের ৪ আগস্ট আমেরিকার হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের রাজধানী হনুলুলুর কুইন্স মেডিক্যাল সেন্টারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আমেরিকার ৪৪তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার বাবা ছিলেন একজন আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ বা কালো চামড়ার মানুষ। অন্য দিকে তার মা ছিলেন ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক। আমেরিকার ইতিহাসে বারাক ওবামাই আফ্রিকান বাবার সন্তান হিসেবে অর্থাৎ একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। শ্বেতাঙ্গ বা সাদা মানুষদের শাসন করা দেশ আমেরিকার ইতিহাসে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
ওবামার বাবা বারাক হোসেন ওবামা সিনিয়রের বাড়ি আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার একটি গ্রামে। তিনি ছিলেন একজন মুসলমান। মেধাবী ছাত্র হওয়ায় সরকারি বৃত্তি পেয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি সুদূর কেনিয়া থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন। আমেরিকা ৫০টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত একটি বিরাট দেশ। হাওয়াই হচ্ছে এই ৫০টি অঙ্গরাজ্যের একটি। হনুলুলু হচ্ছে এই অঙ্গরাজ্যের রাজধানী। ওবামার বাবা হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু কালো চামড়ার মানুষ হওয়ার কারণে তাকে ক্লাসের সবাই অন্য চোখে দেখত। শ্বেতাঙ্গ বা সাদা চামড়ার ছাত্রদের সাথে তাকে বসতে দেয়া হতো না। ক্লাসের এক কোণে চেয়ার-টেবিল আলাদা করে নিয়ে তাকে বসতে হতো।
অন্য দিকে ওবামার মা স্ট্যান অ্যান ড্যানহাম ছিলেন আমেরিকার নাগরিক এবং শ্বেতাঙ্গ বা সাদা চামড়ার মানুষ। তাদের পরিবারের উপাধি বা পদবি ছিল ‘ড্যানহাম’। এই পরিবারটি বিভিন্ন সময়ে কানসাস, টেক্সাস ও ওয়াশিংটন রাজ্যে বসবাস করত। কিন্তু ভালো আয়- রোজগারের সন্ধানে সেখান থেকে তারা হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের রাজধানী হনুলুলুতে চলে আসে। সেখানে ১৯৬০ সালে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে রুশ ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রে বারাক ওবামা সিনিয়রের সাথে স্ট্যান অ্যান ড্যানহামের পরিচয় হয়। এই পরিচয় থেকে তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেও রাজ্যের আইন এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ওই সময় হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে কালো ও সাদা চামড়ার মানুষের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ ছিল। কেবল হাওয়াই নয়, আমেরিকার আরো অনেক অঙ্গরাজ্যেই শে^তাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ বা সাদা ও কালো চামড়ার মানুষের মধ্যে বিয়ে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু স্ট্যান অ্যান ড্যানহাম ও বারাক হোসেন ওবামা সিনিয়র সব বাধা-বিপত্তি অগ্রাহ্য করে ১৯৬০ সালে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬১ সালের ৪ আগস্ট তাদের ঘরে জন্মগ্রহণ করে এক ছেলে সন্তান। বাবা-মা আদর করে নাম রাখেন বারাক হোসেন ওবামা জুনিয়র। ওবামার ডাক নাম রাখা হয় ব্যারি। বারাক শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘আশীর্বাদপ্রাপ্ত’। কিন্তু বারাক ওবামার শিশুকাল ছিল খুবই দুঃখের আর বেদনার।
জন্মের পর ব্যারির দিনগুলো বাবা-মায়ের আদরে ভালোভাবেই কাটছিল। কিন্তু বেশি দিন তার কপালে এই সুখ সইলো না। ওবামার বাবা উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার জন্য হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাইলে এ নিয়ে স্ত্রীর সাথে তার মনোমালিন্য ও বিরোধ সৃষ্টি হয়। এরপর তারা আলাদা থাকতে শুরু করেন। এর একপর্যায়ে ১৯৬৪ সালে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে রেখে চলে যান ওবামার বাবা। তখন ওবামার বয়স মাত্র দুই বছর। এই বয়সেই বাবার আদর- স্নেহ ও ভালোবাসা থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হতে হয় ওবামাকে। পরবর্তীতে ওবামার বাবা কেনিয়া সরকারের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ হিসেবে চাকরি করেছেন। বাবা-মায়ের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ওবামার সাথে তার বাবার আর মাত্র একবার দেখা হয়েছিল। তখন ওবামার বয়স ১০ বছর। এরপর আর কখনোই ওবামা তার বাবার দেখা হয়নি।
ওবামার বাবার সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার কিছু দিন পর ওবামার মা হাওয়াই বিশ^বিদ্যালয়ে পড়তে আসা লোলো সোয়েতোরো নামে ইন্দোনেশীয় এক ছাত্রের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই ঘরে তার একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয়েছিল মায়া। এরপর ওবামকে তার মা ও সৎ বাবার সাথে ইন্দোনেশিয়ায় চলে যেতে হয়। রাজধানী জাকার্তার শহরতলিতে খুবই সাধারণ পরিবেশে তারা বসবাস করত। সেখানে প্রথমে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ও এর তিন বছর পর একটি সরকারি স্কুলে ওবামাকে ভর্তি করা হয়। সেখানে পড়ার সময় সম্পূর্ণ বৈরি পরিবেশের সাথে লড়াই করে শিশু ওবামাকে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছিল। মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই ওবামা ইন্দোনশিয়ার ভাষা ও সংস্কৃতি শিখে নিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের গায়ের চামড়া কালো বলে স্কুলে ওবামাকে ছাত্রদের দিক থেকে নানা ধরনের বিরূপ আচরণের শিকার হতে হয়।
জাকার্তার স্কুলে পড়ার সময় শিশু ওবামা তার ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা খাতায় লিখে প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয় আমরা বড় হয়ে কী হতে চাই, তাহলে আমরা সাধারণত কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বড় সরকারি কর্মকর্তা, আবার কেউ অনেক বড় ব্যবসায়ীসহ নানা কিছু হওয়ার কথা বলব। ছোটবেলায় এ ধরনের কিছু হওয়ার স্বপ্ন সবার মনের মধ্যে থাকাটাই স্বাভাবিক।
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার স্কুলে পড়ার সময় ওবামার ক্লাসের ইস ডারমাওয়ান নামে একজন শিক্ষক সব ছাত্রকে তার জীবনের লক্ষ্য বা জীবনে সে কী হতে চায় তা উল্লেখ করে একটি রচনা লিখতে বললেন। সব ছাত্রের লেখা শেষ হলে শিক্ষক সবার খাতা জমা নিয়ে একটি একটি করে দেখতে লাগলেন। ক্লাসে ওবামা ব্যারি নামে পরিচিত ছিলেন। ব্যারির খাতা দেখার সময় শিক্ষক চমকে উঠলেন। কারণ ক্লাসের একটি ছাত্রের উদ্দেশ্যের সাথেও ব্যারির উদ্দেশ্যের বা জীবনের লক্ষ্যের কোনো মিল নেই। ব্যারি লিখেছে সে তার দেশের প্রেসিডেন্ট হতে চায়। এ ঘটনার ঠিক তিন বছর পর জাকার্তার একটি সরকারি স্কুলে ভর্তি করা হয় ওবামাকে। সেই স্কুলেও তাকে একই ধরনের একটি রচনা লিখতে বলা হয়। সেই স্কুলের শিক্ষিকা ক্যাটরিনা সিনাগা সব ছাত্রছাত্রীকে এই রচনা লিখতে বলেছিলেন। এবারও ওবামা একই কথা লেখেন যে, তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে চান। সেই শিক্ষিকা ক্যাটরিনার এখনো মনে আছে সেদিনের পিচ্চি ওবামার এত বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখার কথা। বড় হয়ে ওবামা ঠিকই তার স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন। তিনি হয়েছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।
জাকার্তার স্কুলের বৈরি পরিবেশসহ নানা সমস্যার কারণে ওবামাকে নিয়ে তার মা খুব চিন্তিত ছিলেন। ফলে তিনি ওবামাকে এই পরিবেশ থেকে উদ্ধার করে আমেরিকায় তার মায়ের কাছে (ওবামার নানী) কাছে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলে ৪ বছর পর ওবামাকে আবার আমেরিকায় ফিরে আসতে হয়। ১৯৭১ সালে হাওয়াইতে এসে তাকে আবার নতুন করে লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে হয়। এ সময় ওবামা তার নানা-নানীর সাথে থাকতেন। অন্য দিকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য ওবামার মাকে প্রায়ই আমেরিকায় আসতে হতো। এ সময় ওবামা তার মায়ের কাছেই থাকতেন। ১৯৮০ সালে ওবামার মা তার ইন্দোনেশীয় স্বামী সোয়েতোরোকে ডিভোর্স দিয়ে স্থায়ীভাবে আমেরিকায় চলে আসেন। কিন্তু তার আগে ১৯৭৯ সালে ওবামা হনুলুলুর মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনাহু স্কুল থেকে পাস করে লস অ্যাঞ্জেলসের অক্সিডেন্টাল কলেজে ভর্তি হন।
পরে তিনি নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৮৩ সালে সেখান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ¯œাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ওবামা যথেষ্ট মেধার পরিচয় দিয়ে শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। এরপর ওবামা ম্যানহাটানে বিজনেস ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন নামে একটি প্রকাশনা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর চাকরি করেন। এ সময় তিনি ইলিনয় রাজ্যের রাজধানী শিকাগোর দক্ষিণাঞ্চলে অনেকটাই দারিদ্র্য কবলিত লোকজনের মধ্যে একজন সমাজসংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এখানে তিন বছর কাজ করার পর তিনি হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৯১ সালে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এখানে পড়ার সময় ওবামা হার্ভার্ড ল রিভিউ ম্যাগাজিনের সভাপতি নির্বাচিত হন। প্রথম একজন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকান হিসেবে তিনিই প্রথম এই মর্যাদা লাভ করেন। এরপর শিকাগোতে সিডলে অষ্টন নামে একটি আইনি প্রতিষ্ঠানে সহযোগী হিসেবে কাজ করার সময় সেখানে জুনিয়র আইনজীবী হিসেবে কর্মরত মিশেল রবিনসন নামে এক যুবতীর সাথে ওবামার পরিচয় হয়। ১৯৯২ সালে তারা দুজন বিয়ে করেন। মালিয়া ও শাশা নামে তাদের দুই মেয়ে রয়েছে।
এরপর ওবামা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পাশাপাশি তিনি নাগরিক অধিকার বিষয়ক আইনজীবী হিসেবেও কাজ করতে থাকেন। একই সাথে তিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে যোগদান করেন এবং ১৯৯২ সালে দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বিল ক্লিনটনের পক্ষে ইলিনয় রাজ্যে প্রচারণায় ও ভোটারদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এভাবেই ধীরে ধীরে তিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন। এই ধারাবাহিকতায় ওবামা ইলিনয় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সিনেট সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দুই দফায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমেরিকার সফল প্রেসিডেন্টদের একজন হিসেবে ওবামর নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Share.

মন্তব্য করুন