অনেক অনেক বছর আগে চ্যাঙ নামে এক শিকারি বাস করত। প্রতিদিন সকালে সে তীর ও ধনুক হাতে শিকারের সন্ধানে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করত। সবসময় সে একই পথে হেঁটে হেঁটে জঙ্গলে যেত। পথের একপাশে ছিল মন্দির। মন্দিরে ছিল দুটি ডোরাকাটা বিষধর সাপ। প্রথমদিকে চ্যাঙ সাপ দুটোকে ভীষণ ভয় পেত। কিন্তু কোনোদিন তার ক্ষতি না করায় সাপ দুটোকে আর ভয় পেত না সে। বরং তাদের প্রতি এক প্রকার মায়া কাজ করত তার মনে।
একদিন শিকার করতে মন্দিরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চ্যাঙ তীব্র শব্দ শুনতে পেল। কী হয়েছে দেখার জন্য সে মন্দিরের খুব কাছে এগিয়ে গেল। এরপর সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে পেল। দেখল মন্দিরে থাকা সাপ দুটিকে বাইরের একটি সাপ আক্রমণ করেছে। প্রচণ্ড লড়াই সত্ত্বেও সাপ দুটো বাইরের সাপটির সাথে পেরে উঠছে না। চ্যাঙ তৎক্ষণাৎ তার কাঁধ থেকে ধনুক নিয়ে আক্রমণ করে বহিরাগত সাপটিকে সরিয়ে দিল। আহত অবস্থায় সাপটি জঙ্গলের ভিতরে মিলিয়ে গেল। ততক্ষণে মন্দিরে থাকা সাপ দুটির একটি সাপ সেখানে মৃত অবস্থায় পড়ে রইলো। আর অপর সাপটি আহত সাপটিকে ধরার জন্য পিছন পিছন তাড়া করল। চ্যাঙ মৃত সাপটিকে মন্দিরের পিছনে সমাহিত করে কাজে ফিরে গেল।
সেদিন রাতে ঘুমানোর সময় চ্যাঙ একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নে দেখল মন্দিরের বেঁচে যাওয়া সাপটি তার সামনে এসে শত্রুর হাত থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে। সেই সাথে তার সঙ্গীকে সমাহিত করার জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। এই মহৎ কাজের প্রতিদান স্বরূপ সাপটি তার মুখের ভিতর থেকে একটি মহামূল্যবান মণি বের করে মাটিতে রাখল। তাকে এটি কুড়িয়ে নিতে বলল। সেই সাথে এটিকে সবসময় তার জিহ্বার নিচে রাখতে বলল। আরও বলল এটি জিহ্বার নিচে রাখলে সে পৃথিবীর সকল পশুপাখি ও প্রাণীর ভাষা বুঝতে পারবে। ফলে তার জন্য শিকার করা আরো সহজ হয়ে যাবে।
এরপরই সকাল হয়ে গেল। চ্যাঙের ঘুম ভেঙে গেল এবং ঘুম থেকে উঠেই বালিশের পাশে সে মুক্তার মত উজ্জ্বল একটি মণি দেখতে পেল। ঠিক স্বপ্নে যেমনটি দেখেছিল তেমন। স্বপ্নে দেখা সাপটির নির্দেশ অনুযায়ী সে এটিকে জিহ্বার নিচে রাখল এবং সেদিনের মতো শিকার করতে বের হয়ে গেল। বনের ভিতরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে একটি হরিণ দেখতে পেল। হরিণটিকে মারার জন্য তীর নিক্ষেপ করল সে। কিন্তু তীরটি হরিণের গায়ে লাগতে ব্যর্থ হলো। হরিণটি মুহূর্তেই বনের ভিতরে লুকিয়ে পড়ল।
ঠিক ঐ মুহূর্তে একটি কাক আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিল। কাকটি কা কা করে তার কর্কশ কণ্ঠে বলছিল সে হরিণটিকে দেখতে পাচ্ছে এবং এটি ডান পাশে ১০০ কদম দূরত্বে সরে গিয়েছে। চ্যাঙ কাকটির কথা বুঝতে পারল এবং প্রমাণ পেল সাপটি তাকে অদ্ভুত মণিটি সম্পর্কে সত্যি কথাই বলেছে। অবশেষে কাকটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী সে হরিণটিকে শিকার করতে সক্ষম হলো। এরপর কাকটি চ্যাঙের কাছে উড়ে গেল এবং তার ভাগের অংশ চাইলো। চ্যাঙ হরিণের নাড়িভুঁঁড়ি এবং ফেলে দেয়া অংশগুলো কাকটিকে দিয়ে দিলো। এরপর থেকে চ্যাঙ কাকটিকে তার শিকারের সঙ্গী করে নিলো। কাক তাকে শিকারের তথ্য দিয়ে সহায়তা করত এবং এর বিনিময়ে চ্যাঙ শিকারের উচ্ছিষ্ট অংশটুকু কাকের জন্য বনের মাঝে ফেলে রাখত। কাকটি পরে এসে সেগুলো খেয়ে নিত।
বেশ কিছুদিন এভাবেই চলছিল। একদিন বিকেলে কাকটির সহায়তায় একটি বুনো শুয়োর শিকার করল চ্যাঙ। বরাবরের মতই সে নিজের অংশটুকু নিয়ে অবশিষ্ট অংশটুকু কাকটির জন্য বনের মাঝে ফেলে রাখল। কিন্তু অন্য একটি পাখি এসে সেগুলো খেয়ে ফেলল। সেই সাথে কাকটি সেখানে কিছু না পেয়ে খুবই রেগে গেল। সে ভাবল, চ্যাঙ তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। একাই শিকারের পুরো অংশ নিয়ে নিয়েছে।
দ্রুতই কাকটি চ্যাঙ এর বাড়িতে যেয়ে এর প্রতিবাদ করল। চ্যাঙ তাকে বলল, সে ঠিকই তার জন্য খাবার রেখে এসেছিল বনের মধ্যে। কিন্তু কাকটি তার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করল না। বরং তাকে মিথ্যুক বলে অভিহিত করল। চ্যাঙ এই কথা শুনে খুবই রেগে গেল। সে কাকটির দিকে তীর নিক্ষেপ করল। কিন্তু কাকটি তার ডানা ও পায়ের সাহায্যে তীরটিকে ধরে ফেলল এবং প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্যে সেটি নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেল।
এর ঠিক কিছুদিন পরে প্রহরীরা চ্যাঙকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করতে এল। চ্যাঙ কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। প্রহরীরা জানাল, বনের অদূরে একজন ব্যক্তিকে সে খুন করেছে। নিহত ব্যক্তি তীরবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে এবং তীরটিতে তার নাম খোদাই করা ছিল। চ্যাঙ বুঝতে পারল কাকটি তার তীর নিয়ে সেখানে রেখে এসেছে। নির্দোষ চ্যাঙ কিছু বলার আগেই তারা তাকে ধরে নিয়ে জেলে পুরে দিল।
চ্যাঙের জীবন দিনের পর দিন কারাগারের অন্ধ-প্রকোষ্ঠে কাটতে লাগল। একদিন সে কারাগারের দেয়ালে অনেকগুলো পিঁপড়ার দল দেখতে পেল। তারা খাবার সাথে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে ছুটছিল। চ্যাঙ অদ্ভুত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখে জাদুকরী মণি থাকার কারণে সে প্রাণিজগতের সবার ভাষা বুঝতে পারত। তাই সে কৌতূহলবশত পিঁপড়াদের জিজ্ঞেস করল- তারা এমন আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় কোথায় যাচ্ছে। পিঁপড়াগুলো তাকে জানাল বিশাল বড় এক বন্যা আসতে যাচ্ছে রাজ্যে। তাই জীবন বাঁচাতে তারা আগে থেকেই খাবার নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে। চ্যাঙের আর কিছুই বুঝতে বাকি রইলো না। সে তাড়াতাড়ি প্রহরীদের মাধ্যমে রাজার কাছে বন্যা হওয়ার আগাম খবরটি পৌঁছে দিল। ফলে রাজ্যের মানুষ আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে লাগল। অগ্রিম প্রস্তুতি নেয়ার ফলে সবাই বিশাল ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেল।
রাজা চ্যাঙের আন্তরিকতায় খুব খুশি হলেন এবং রাজ্যের মানুষের জীবন বাঁচানোর প্রতিদানস্বরূপ তিনি চ্যাঙের শাস্তি মওকুফ করে কারাগার থেকে মুক্ত করে দিলেন। সেই সাথে চ্যাঙকে নিজের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিলেন। চ্যাঙ তার অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়ে খুব সহজেই পশু-পাখিদের মাধ্যমে বিভিন্ন দুর্যোগের আগাম খবর নিতে লাগল। আগেভাগেই এসব তথ্য দিয়ে রাজ্যকে সে ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে সাবধান করতে লাগল। এমনকি ঘোড়া, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর সাহায্যে বহিরাগত কোনো শত্রুর আক্রমণের আগেই সে রাজাকে তা জানিয়ে দিত। তবে সে কখনো তার এই বিশেষ ক্ষমতার রহস্য কাউকে বলল না।
এভাবে তার জীবন খুব ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু এক বসন্তের সকালে চ্যাঙ রাজার নৌবহরে করে সমুদ্রযাত্রা করেছিল। জাহাজ থেকে শোনা যাচ্ছিল ঢেউয়ের বিমোহিত শব্দ। অসাধারণ সুন্দর দৃশ্য ছিল সমুদ্রের চারিদিকে। এমন সময় সে দেখল জাহাজের চারদিকে ডলফিনেরা খেলা করছে। জাহাজের পাশে নেচে আর হেসে বেড়াচ্ছিল তারা। এ দৃশ্য চ্যাঙকে বিমোহিত করে ফেলল। সেও ডলফিনদের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল এবং মনের সুখে গান গাইতে লাগল। এক পর্যায়ে সে এত জোরে হাসতে লাগল যে হঠাৎই তার মুখ থেকে মহামূল্যবান মণিটি বের হয়ে সমুদ্রে পড়ে গেল। হতভম্ব হয়ে চ্যাঙ দ্রুত সাগরে ঝাঁপ দিল এবং সেটিকে খুঁজতে লাগল। সেই সাথে দ্রুত রাজাকে সে মণির রহস্য সম্পর্কে জানাল এবং রাজা তার সাথে থাকা সৈন্যদের সেটি উদ্ধার করার নির্দেশ দিলেন। তারা সমুদ্রে নেমে অনেক খোঁজাখুঁজি করল কিন্তু কিছুই উদ্ধার করতে পারল না। দিনশেষে নিষ্ফল উদ্ধার অভিযান শেষ হল।
পরদিন চ্যাঙ একাই সমুদ্রে যেয়ে মণিটির সন্ধান করতে লাগল। সেদিনও সে এটি খুঁজে পেল না। সে খুবই হতাশ হয়ে পড়ল। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর মণির সন্ধানে চ্যাঙ সমুদ্রের তীরে কাটিয়ে দিল। সমুদ্রের বালুতীরে কাঁকড়াদের গর্তগুলোতেও হাত দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুঁজল। খুঁজতে খুঁজতে সমুদ্র তীরের প্রতিটি বালুকণা দেখা হয়ে গেল তার। কিন্তু কোথাও নেই তার সেই হারানো গুপ্তধন। চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে দিনে দিনে সে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ল। অখুশি, অসন্তুষ্ট ও নিরানন্দ জীবন নিয়ে চ্যাঙ এভাবেই একদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
চ্যাঙের জীবনের এ ঘটনা মানবসমাজকে একটি চরম বাস্তবতার শিক্ষা দিয়ে গেল। সৃষ্টিকর্তা নানা বিচিত্রতা ও প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য দিয়েই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাই স্রষ্টা প্রদত্ত ক্ষমতার বাইরে মানুষের বাড়তি কোনো ক্ষমতা লাভের আশা করা উচিত নয়। এ ছাড়াও মানুষের পক্ষে অসাধ্য এমন কোন কাজের পিছনে মানুষের কখনোই ছোটাছুটি করা উচিত নয়। তাহলে দিনশেষে চ্যাঙের মত ব্যর্থ ও বিষাদগ্রস্ত হতে হবে এবং কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।

Share.

মন্তব্য করুন