মালনীছড়া চা বাগানে ছিলো আমাদের বাসা। সিলেট শহর থেকে এটি পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। চা বাগানে টিলার উপর চমৎকার সবুজে ঘেরা ছিলো কোয়ার্টার। এরকম একটি সুন্দর কোয়ার্টারে থাকতাম আমরা। আব্বার চাকরি সূত্রে আমরা এখানে ছিলাম। মা-বাবা, ভাই-বোন মিলে আমাদের ছোটবেলা বেশ আনন্দের ভেতর দিয়ে কেটে যেতো।

রোজার মাস শুরু হলেই একধরনের আনন্দ কাজ করতো আমাদের। আমরা রোজার নতুন চাঁদও দেখতাম। রোজা রাখতাম সবাই। সাহরির সময় আব্বা আমাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতেন। চোখ কচলে কচলে আমরা উঠে পড়তাম। তারপর সাহরি খেয়ে ফজর নামাজ আদায় করে আবার ঘুমিয়ে যেতাম।
পনেরো রোজা গেলেই আমাদের ঈদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেতো। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের ছিলো টানাটানির সংসার। অভাব অনটন ছিলো। তব্ওু ঈদের জন্য নতুন জামাকাপড় কেনা হতো। নতুন জামা আমরা বালিশের নিচে রেখে দিতাম। মাঝে মাঝে বালিশের নিচ থেকে বের করে দেখতাম।

ঈদের রাতে মা অনেক রাত ধরে কাজ করতেন। ঈদের জন্য বিভিন্ন খাবার প্রস্তুত করতেন। নারিকেলের পিঠা, দুধের সন্দেশ, সেমাই, সমুচা ইত্যাদি তৈরি করতেন। আমরাও ঘুমাতাম না অনেক রাত পর্যন্ত। জেগে থাকতাম আম্মার সাথে। একসময় জোর করে আমাদের ঘুমাতে পাঠিয়ে দিতেন আব্বা। বাধ্য হয়ে আমরা ঘুমাতে যেতাম। কিন্তু ঘুম সহজে আসতো না। একসময় মনের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু আবার ভোর বেলা ভেঙে যেতো ঘুম। অথবা আব্বাই জাগিয়ে দিতেন। আমরা গোসল করে নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি পরে, মাথায় টুপি দিতাম। তারপর সুগন্ধি আতর লাগিয়ে রওনা দিতাম মসজিদে। মালনীছড়া চা বাগানের মজুমদারিতে ছিলো একটি মসজিদ। এখানে ঈদের নামাজ আদায় করতাম। কোনো কোনো ঈদে সিলেট ঈদগাহতে চলে যেতাম। নামাজ পড়তাম সেখানে।
নামাজ শেষে বাসায় ফিরতাম। আম্মা নতুন শাড়ি পরতেন, আব্বা নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি। এটি আমাদের মুসলমানদের সংস্কৃতি, পোশাকের দিক থেকে। আবার নামাজ শেষে কোলাকুলি। তারপর একজন আরেকজনের বাড়ি গিয়ে খাওয়া দাওয়া করা। একে অন্যের খোঁজখবর নেয়া সুখে-দুঃখে অংশগ্রহণ করা এসব মুসলিমদের সংস্কৃতির অংশ।

মুরব্বিদের সালাম করে সালামি পেতাম। একে ঈদিও বলা হতো। ১ টাকা ২ টাকা ঈদি দিতো। শুধু আমার মামাকে সালাম করলে পাঁচ টাকা পেতাম। খুব আনন্দের ছিলো বিষয়টি।
খাওয়া দাওয়া থাকতো অন্যরকম। কোরমা, কালিয়াসহ নানান পদের খাবার। সিলেটের মাশরাফিয়ার দই থাকতেই হতো। মাশরাফিয়ার দই ছাড়া আমাদের ঈদ জমতোই না।
দুপুর হয়ে গেলেই ধীরে ধীরে মন খারাপ হতো আমাদের। খারাপ হতো এজন্য যে, ঈদ বিদায় নিচ্ছে আমাদের থেকে। আমার ছোট ভাই ডাক্তার আবদুল হাই মিনার- ওর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা একটু বেশিই ছিলো। আজও আছে তেমনই। তো দুপুর হলেই মিনার বলতো- ভাইয়া, ঈদ তো চলে যাচ্ছে, শেষ হয়ে যাচ্ছে। তখন মন খারাপ হতো আমাদের। আশ্চর্যের বিষয়, এখন আমার মেয়ে- ও নিজেও এখন সন্তানের মা। ও কিনা একই কথা বলে এখন! দুপুর হলেই বলে- আব্বু, ঈদ তো চলে যাচ্ছে।

আমার স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে এখনও ঈদের আনন্দ করি। কিন্তু ঢাকায় আর ঈদের চাঁদ দেখা হয় না। আসলে দেখবো কিভাবে! ঢাকার বড় বড় ইট-পাথরের দালান-কোঠার ফাঁকে চাঁদ দেখার কায়দা নেই।
এখনকার ছেলেমেয়েরা আমাদের মতো নির্মল আনন্দের ঈদ পায় না, এটি সত্যি। হয়তো তারা তাদের মতো আনন্দ করে। কিন্তু আমরা যেমন ছোটবেলায় খোলা আকাশের নিচে ঈদের আনন্দে মেতে উঠতাম, সে রকম আনন্দ এখনকার ছেলেমেয়েরা পায় না।

Share.

মন্তব্য করুন