সবার প্রিয় কবি জসীমউদদীনের জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯০৩ সালে। ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যু ১৩ মার্চ ১৯৭৬ সালে। তিনি একজন বড় কবি, বড় গীতিকার, ঔপন্যাসিক এবং একজন ভ্রমণ লেখক। অনেক অনেক জনপ্রিয় গান লিখেছেন তিনি। এখনো তাঁর অনেক গান মানুষের মুখে মুখে বাজে। তিনি ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান সূচক ডিলিট উপাধি পান। সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক পেয়েছেন। পেয়েছেন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক- স্বাধীনতা পদক। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পান তিনি। কিন্তু মজার বিষয় হলো, তিনি এ পুরস্কার গ্রহণ করেননি।

বাংলাদেশের চমৎকার সুন্দর রূপসী প্রকৃতি এবং সহজ-সরল মানুষ নিয়ে যে ক’জন কবি কবিতা লিখেছেন জসীমউদ্দীন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। এ দেশের মাঠ-ঘাট আর চরের বর্ণনা তাঁর কবিতায় খুব চমৎকার করে ফুটে উঠেছে। চর এবং চরের মানুষগুলোর বৈশিষ্ট্য, তাদের জীবনের নানারকম দিক বর্ণনা করেছেন তিনি। চরের মানুষের ঝগড়া বিবাদ হাতাহাতি এমনকি মারামারির কথাও লিখেছেন তিনি। যেমন গ্রামের রূপের বর্ণনা করেছেন তেমনই গ্রামের মানুষের বর্ণনাও করেছেন খুব খুব।

জসিমউদদীনের বইগুলোর নাম জেনে আসা যাক। তাঁর প্রকাশিত বই হলো- ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’, ‘মাটির কান্না’, ‘পদ্মা পাড়’, ‘বেদের মেয়ে’, ‘পল্লীবধূ’, ‘গ্রামের মায়া’, ‘জার্মানির শহরে বন্দরে’, ‘বাঙালীর হাসির গল্প’, ‘ডালিম কুমার’, ‘বোবা কাহিনী’ ইত্যাদি। বইগুলোর নাম কি চমৎকার! শুনলেই বোঝা যায় বইগুলো বাংলাদেশের গ্রাম থেকে বা গ্রামের হৃদয় থেকে বেড়ে উঠেছে।

জসীমউদদীনের কবিতা খুব সুন্দর। কবিতায় বর্ণিত চিত্রকল্পগুলো ছবির মতো চোখে ভাসে। দৃশ্যগুলো ভেসে ওঠে জীবন্ত হয়ে। তাঁর কবিতায় বাংলাদেশ পাওয়া যায়, এমন কথা সকল পাঠকই বলেন। তাঁর কবিতা পড়লে মন ফুরফুরে হয়ে ওঠে। আনন্দময় হয় মনের গহিন। কবিতা পড়তে পড়তে মনে ভেসে ওঠে বিশাল চরের পাশে গ্রাম। গ্রামের কত কি ছবি জেগে ওঠে।

আমাদের প্রিয় কবি জসীমউদদীনের কথা আমরা সবাই জানি। সবাই তাঁকে পল্লীকবি বলেই চেনেন। কারণ হিসেবে সকলেই বলেন তিনি পল্লী নিয়ে লিখেছেন তাই পল্লীকবি। পল্লী অর্থ গ্রাম। তাহলে তিনি কি গ্রামের কবি? নাকি শুধু গ্রাম নিয়ে লিখেছেন? এটি একটি প্রশ্ন বটে! এর উত্তর কিন্তু তোমরাও জানো। তা হলো তিনি শুধু গ্রাম নিয়ে লেখেননি। হ্যাঁ, তিনি গ্রামের সবুজ এবং সৌন্দর্য নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু তারও বেশি লিখেছেন গ্রামের মানুষের জীবন নিয়ে। জীবনের নানান দিক নিয়ে। গ্রামীণ জনপদের বিস্তারিত দৃশ্য নিয়ে লিখেছেন।
তাঁকে পল্লীকবি বলা হলেও তিনি একজন আধুনিক কবি।

তাঁর ‘কবর’ কবিতাটি আজো সবার কাছে অসম্ভব জনপ্রিয়। এ কবিতাটি জসীমউদ্দীন লিখেছেন যখন- তিনি কলেজের ছাত্র। আর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন তখন কবিতাটি পাঠ্যবইয়ের একটি হয়ে উঠলো। আহা কি সম্মান! একজন কবির মর্যাদা কত উঁচু হতে পারে এটি তার উপমা। কবিতায় বাংলাদেশকে জানতে হলে জসীমউদদীনের কবিতা পাঠ করতে হবে। জসীমউদদীনের কবিতা পড়লে জানা যাবে আমাদের বাংলাদেশে জেলে, তাঁতী, মজুর, চাষিদের জীবন কেমন। কেমন ছিলো তাদের পরিবার, তাদের সমাজ। বাংলাদেশের সাধারণ এ জনগণের জীবন কবিতায় তুলে এনেছেন জসীমউদ্দীন।

তাঁর একটি কবিতার নাম ‘রাখাল ছেলে’। এ কবিতাটিও খুব জনপ্রিয়। কি সুন্দর করে লিখেছেন তিনি একজন রাখাল এবং তার মায়ের কাহিনী। এ কবিতার এক জায়গায় লিখেছেন- ‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি/ শিশির ঝরা ঘাসে/ সারারাতের স্বপন আমার/ মিঠেল রোদে হাসে।’

আহা কি চমৎকার, মন মাতানো কবিতা এটি। সারা রাতের স্বপন যখন মিষ্টি রোদে হাসে, তখন তো মন আপনাতেই ভালো হয়ে যায় সকলের। জসীমউদ্দীনের কবিতা পড়লে মনে হয় বাংলাদেশের গ্রামের গাছগাছালি-পাখপাখালি আর নীল আসমান দেখা যায়। খুব সাদাসিধে মানুষগুলোর চলাফেরা, গল্পের আসর আর নানাবিধ পছন্দ-অপছন্দ পাওয়া যায়। আসলে জসীমউদ্দীনের কবিতায় বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের গ্রামের সৌন্দর্য এবং রূপ জীবন্ত হয়ে আছে। তাই এভাবেই জসীমউদ্দীন আমাদের সবার প্রিয় কবি হয়ে বেঁচে আছেন। এবং বেঁচে থাকবেন পাঠকের হৃদয়ে অন্তরে পঠন-পাঠনে। তাঁর কবিতা আর গান মানুষের মনে আর মুখে থাকবে সবসময়। বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে- বলা যায়, জসীমউদ্দীনের গান আর কবিতাও ততদিন বেঁচে থাকবে।

তবে তাঁর কবিতা আরও বেশি বেশি পড়লে, তাঁর রচনাবলি পড়লে আরও বেশি জানা যাবে তাঁকে। এটা মনে রাখতে হবে যে, কাউকে অর্থাৎ কোনো কবি বা লেখককে জানতে হলে পড়তে হবে তার লেখা। সুতরাং জসীমউদ্দীনকে জানার ইচ্ছে যাদের আছে, তারাও যেনো তাঁর কবিতা বেশি করে পাঠ করে।

Share.

মন্তব্য করুন