৮ জুন ১৯৪৭, যখন ভারত ভাগ হচ্ছিল। ৮ ডিসেম্বর ১৯৪৭, যখন পাকিস্তানের ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন শুরু হলো আর ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮, যেদিন ভাষার জন্য রক্ত দিলো বরকত, সালাম। আমরা এই দিনগুলো নিয়ে আলাপ করবো এই প্রবন্ধে। তার আগে আসাম থেকে ঘুরে আসি একটু চলো। ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকা, উপত্যকার নয়নাভিরাম সুন্দর শহর শিলচর। এই শিলচরের মাটি ভিজে গেল ১১ বাঙালির রক্তে। কেন? এই কেন’র উত্তর পেতে হলে আমাদের ৮ই জুন ১৯৪৭ এ ফিরে যেতে হবে। কি হয়েছিল সেদিন?
৮ জুন ১৯৪৭ : বরাক, আসাম।

মৌলভি আব্দুল মতলিব মজুমদার, কংগ্রেসের প্রভাবশালী মুসলিম নেতা। ৮ জুন তিনি আসেন আসাম জাতীয়তাবাদী মুসলিম কনভেনশন উদ্বোধন করতে। বলে রাখি বরাকের অর্ধেক জনগোষ্ঠী হিন্দু বাকি অর্ধেক মুসলিম, কিন্তু প্রায় সবাই বাংলাভাষী। এখানেই জন্মেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। আয়তন অনুসারে এটি একটি রাজ্য হওয়ার যোগ্য। অর্ধেক জনগোষ্ঠী মুসলিম হওয়ায় পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের সাথে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, পাশের সিলেট গণভোটে পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে পড়েছে, এই পরিস্থিতিতে পুরো বরাক না হলেও একটা বড় অংশ পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেবে এমনটা বুঝতে পেরে কংগ্রেস মৌলভি মতলিবকে পাঠায়। আব্দুল মতলিব মজুমদার বরাক উপত্যকাকে ভারতের অংশ রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে হৃদয়স্পর্শী বক্তৃতা দেন। মুসলিমদের আশ^স্ত করেন তারা- ভারতের সাথে থাকলে সুখে থাকবে, হবে না দাঙ্গা। কিন্তু আসলেই কি তারা সুখ পেয়েছে? নাকি সেদিনের সেই সিদ্ধান্তই রুয়ে দিয়ে গেছে আসাম-বাঙালি দ্বন্দ্বের নতুন বিষবৃক্ষের চারা।
৮ই জুন আসামের সাথে একীভূত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে কি ভুল করলো বরাকবাসী- তা জানতে হলে যেতে হবে ১৯৬১ সালের ১৯ মে। ১৯৬১-তে যাওয়ার আগে চলো একটু ঢাকার পরিস্থিতিও দেখে আসি।

৮ই ডিসেম্বর ১৯৪৭, ঢাকা গেইট।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের ছাত্ররা মারমুখো অবস্থান নিয়েছে তৎকালীন ঢাকা গেইট ও শাহবাগ এলাকা জুড়ে। কেন? নতুন যে দেশ গঠিত হয়েছে পাকিস্তান নামে সে দেশের পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়া হয়েছে, মুদ্রার নোট, ডাক স্ট্যাম্প থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে বাংলাকে। পাকিস্তানের একটা অংশকে পুরোপুরি অস্বীকার করার এই অপচেষ্টায় ক্ষেপে যায় ছাত্র-জনতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের ছাত্রদের এই বিক্ষোভ ছিলো পাকিস্তানি শাসকদের জন্য বিব্রতকর, এটিই ছিল ভাষার প্রশ্নে প্রথম ছাত্রবিক্ষোভ।
সময় গড়াতে থাকে, উত্তপ্ত হতে থাকে রাজপথ, তাজা রক্ত বুক পেতে নেওয়ার জন্য শাণিত হতে থাকে ঢাকা মেডিকেল প্রাঙ্গণ। আন্দোলনের পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক লেখালেখিও হতে থাকে, সেসব এর পাল্টা জবাব আসে ঢাকা থেকে প্রকাশিত উর্দু দৈনিক পাসবন, ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি মর্নিং নিউজ- এই পত্রিকা দু’টি ছিলো পাকিস্তান সরকারের পক্ষে। কী ছিলো ভাষা আন্দোলনের শুরুর দিককার পত্রিকার ভাষা?
দৈনিক ইত্তেহাদে ১৯৪৭ সালেই আলোচনার শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে। ২২ জুন ১৯৪৭ এ তারা ছাপে- ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’। ২৭ জুলাই ছাপে ‘উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে’। এভাবে একের পর এক তারা বাংলার পক্ষে প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রিপোর্ট ছাপতে থাকে।
২৭ জুন ১৯৪৭ এ সাপ্তাহিক মিল্লাত ছাপায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রেক্ষিতে উর্দু ও বাংলা’ নামক প্রবন্ধ। ৩০ জুন ১৯৪৭ সালে কলকাতার দৈনিক আজাদ ছাপে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামের নিবন্ধ। সওগাত এর ১৩৫৪ আশ্বিন সংখ্যায় ছাপা হয় কবি ফররুখ আহমদের লেখা ‘পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’। এ সমস্ত প্রবন্ধ-নিবন্ধ বাড়িয়ে দেয় জনতার মনোবল। গঠিত হয় তমদ্দুন মজলিস। সময় গড়াতে থাকে, আসতে থাকে রক্তাভ একুশের দিন।

৮ ফাল্গুন ১৩৫৮, ঢাকা মেডিকেল।

ধীরে ধীরে আসতে থাকে আগুন ঝরা ফাগুন। বাংলা ৮ই ফাল্গুন আমরা যেটাকে একুশে ফেব্রুয়ারি বলি। এর আগে শুরু হয় পত্রিকাগুলোর বাকযুদ্ধ। করাচি থেকে প্রকাশিত দ্য ডন নিরপেক্ষ ছিলো ভাষার প্রশ্নে। ৬ ফেব্রুয়ারি সম্পাদকীয় ছাপানো হয়, ‘ভাষা নিয়ে সমস্যা নিরসন হওয়া উচিৎ’।…

নামলো মিছিল

৮ই ফাগুন ঢাকার রাজপথ থমথমে, আগের দিনের ঘোষিত কর্মসূচির ওপর ১৪৪ ধারার খড়গ ঝুলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, নীলক্ষেত এলাকায় পুলিশ, আর্মির ভ্যান ঘুরছে। হলের ভেতর চলছে রুদ্ধদ্বার বৈঠক, মিছিল নিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙবে কি ভাঙবে না। মধুদা’র ক্যান্টিনে ছেলেরা এদিকওদিক খবর পাওয়ার জন্য ওঁৎ পেতে আছে। কী হবে? মিছিল কি হবে? ওদিকে বৈঠকে মতানৈক্যের সূত্রপাত হয়েছে, একদল ১৪৪ ধারা ভাঙতে নামার পক্ষে, অন্য বড় অংশ পক্ষে না।
‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’- বুকে জমাট বাঁধা দুঃসাহস নিয়ে কিছু ছাত্র নেমে এলো রাজপথে, তখন দুপুর। ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুর বেলার অক্ত, বৃষ্টি নামে…’ বরকত নেমেছিল এই দুর্বার ছেলেদের সাথে, নেমেছিল সালাম, রফিক, জব্বার। গুলি হলো মিছিলে, বৃষ্টির মতো রক্ত ঝরলো বরকত-সালামের। একটি লাশ নিয়ে মিছিল ছুটলো মধুদা’র ক্যান্টিনের দিকে, তখনও সেখানে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিল সবাই। এক মুহূর্তে আগুনের হল্কার মতো মিছিলে যোগ হতে থাকলো মানুষের পর মানুষ। মুহূর্তে আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠলো ক্যাম্পাস। এতক্ষণ যারা নামতে গড়িমসি করছিলো তারাও নেমে এলো তুফানের বেগে। পথে নেমে এলো পুরো ঢাকা, সারা বাংলা।

পত্রিকাগুলো ছেয়ে গেল রক্ত আখরে, পরপর ঘটনা ঘটতে থাকলো।
১. এতোদিন নিরপেক্ষ থাকা দৈনিক আজাদ ২১ ফেব্রুয়ারি একটি সান্ধ্য বুলেটিন ছাপায়, সরকার সেটা নিষিদ্ধ করে।
২. বিক্ষুব্ধ জনতা দৈনিক মর্নিং নিউজ অফিস ভাঙচুর করে, আগুন লাগিয়ে দেয়। ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে এই পত্রিকা বহু রিপোর্ট করেছিল।
৩. দৈনিক ইত্তেফাকে পরেরদিন শিরোনাম হয়, ‘ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে ছাত্রসমাবেশের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ’।
৪. ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন।
৫. পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সালামকে আটক করা হয়।

২৩ ফেব্রুয়ারী ‘শহিদ সংখ্যা’ বের করে সৈনিক পত্রিকা। পত্রিকাটি তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র ছিলো। ভাষা আন্দোলনের প্রধান প্রচারযন্ত্র হিসেবেও কাজ করেছে পত্রিকাটি। পত্রিকাটির ভাষ্যে সেদিনের ঘটনা একটু দেখি, ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে নির্বিচারে পুলিশের গুলিবর্ষণ। গত বৃহস্পতিবার ৭ জন নিহত, ৩ শতাধিক আহত, ৬২ জন গ্রেফতার, শুক্রবারেও ব্যাপক সংখ্যক লোক হতাহত, রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা করার শপথ বিঘোষিত’। পাকিস্তান সরকার বাধ্য হলো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে, কিন্তু বাংলার জন্য রক্ত ঝরেছে আরেকবার। তোমরা কি সেই ইতিহাস জানো? এবার তাহলে ওটা বলেই শেষ করি।

৯ই মে ১৯৬১, বরাক উপত্যকা, আসাম।
বাংলা হয়ে গেছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, পাকিস্তানের সংবিধানের ২১৪ (১) নং অনুচ্ছেদ পুনর্লিখন করা হয়েছে, লেখা হয়েছে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ও বাংলা’। ততদিনে বহু জল গড়িয়ে গেছে বরাক নদীতে, বাংলা নামের একটা দেশ গড়ার তোড়জোড় চলছে। ঠিক এ সময় বরাক উপত্যকায় ঝরলো বাঙালির রক্ত, নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য দুই দুইবার কি রক্ত দিয়েছে আর কোনো জাতি?

৮ই জুন ১৯৪৭, বরাকের মানুষ আসামের সাথে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তখনও কিন্তু ভাষার প্রশ্নে দ্বন্দ্ব ছিলো না আসামে। মাত্র ১৩ বছর পর ১৯৬০ সালে আসাম রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিলো আসামের সরকারি ভাষা হবে শুধুই অসমিয়া। আসামের প্রায় অর্ধেক বরাক উপত্যকা, বরাকের মানুষের দাবিকে পাত্তাই দিলো না আসাম রাজ্য সরকার। আসামের কংগ্রেস সরকার খাজা নাজিমুদ্দিনের মতোই ঘোষণা দিলো, ‘অসমিয়া এবং অসমিয়াই হবে আসামের একমাত্র ভাষা’। পাকিস্তান, ভারত দু’জায়গাতেই বাংলা প্রতিহিংসার শিকার হলো। কি হয়েছিল সেদিন?

৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৬১, গঠিত হয় তমদ্দুন মজলিসের মতো ‘কাছাড় গণসংগ্রাম কমিটি’। ১৯ মে সকাল সন্ধ্যা বন্ধের ডাক দেয় গণসংগ্রাম কমিটি। আসাম সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে হরতালের উপর। পুরো উপত্যকা ছেয়ে যায় আর্মিতে। গ্রেফতার করা হয় গণসংগ্রাম কমিটির প্রথম সারির প্রায় সব নেতাকে। কিন্তু কোনো কিছুই থামাতে পারে না বরাকের মানুষকে। বরাক রেলস্টেশন থেকে নামে মানুষের ঢল। আর্মির ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে চলে একদল যুবক। তাদের সামনে ছিল সাহসের দেয়াল, বুকে ছিল বাহান্ন’র প্রেরণা।

১৯ মে, দুপুর ২:৩৫। মধ্যদুপুর। আর্মিরা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে, মুখোমুখি জনতা। ঠিক যেন বাহান্ন’র সে দুপুর। যেন স্থান-কাল পাল্টে গেছে, পুনরাবৃত্তি ঘটছে ইতিহাসের। মিছিল যত সামনে এগিয়ে আসছে আর্মিরা কর্ডন করে চারপাশ ঘিরে ফেলছে। আর্মিদের বৃত্ত ভাঙার চেষ্টা করলো মিছিল, ঠিক তখনই মুহুর্মুহু গুলি হলো, গুলির পর গুলি। টিয়ারগ্যাসে ধোঁয়াটে হয়ে উঠলো চারপাশ। ধোঁয়া কেটে গেলে দেখা গেল ৯টি তাজা লাশ পড়ে আছে, বৃষ্টির মতো রক্ত ঝরছে। ‘বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথা…’
তারপর? তারপর বহুকাল চলে গেছে, আসামের রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে অসমিয়া ও বাংলা। সেই রেলস্টেশনে হয়েছে শহিদ মিনার। বাংলা ছড়িয়ে পড়েছে বরাক নদী-বুড়িগঙ্গা হয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে। কতদূর সিয়েরা লিওন, সূদুর আফ্রিকার এই দেশের দ্বিতীয় অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা। বরকতেরা রক্ত দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে বরাকের মানুষ। সে রক্তের নদী বেয়ে বাংলা এখন বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর ভাষা।

৮ই জুলাই, ৮ ডিসেম্বর, ৮ ফাল্গুন।
তিনটি ভিন্ন তারিখ পাল্টে দিয়েছিল ইতিহাসের গতিপথ, ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেওয়া এই তিনটি তারিখ অন্যরকম হলেও হতে পারতো। তোমরা নিশ্চয়ই বাটারফ্লাই ইফেক্টের নাম শুনেছো! যদি এমন হতো ৪৭-এ বরাক উপত্যকা পাকিস্তানের অংশ হতো, তাহলে কি বাহান্ন’র ঘটনা ঘটতো? ঘটতো একষট্টি? আজকের বাংলাদেশের মানচিত্র কেমন হতো একবার ভাবো তো! অন্যরকম হতো তাই না?
চলো, ঢাকায় শহিদ হওয়া সালাম-বরকতদের পাশাপাশি বরাক উপত্যকার শহিদদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাই।

Share.

মন্তব্য করুন