পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম মানুষ, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. জন্মগ্রহণ করেছেন ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ হযরত ঈসা আ.-এর জন্মের ৫৭৪ বছর পর এই পৃথিবীতে জন্ম নিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.। যে মাসে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন, আরবি মাস অনুযায়ী তার নাম হলো রবিউল আউয়াল। আর সপ্তাহের যে দিনটিতে তিনি এসেছেন এই পৃথিবীর বুকে সেই দিনটি ছিলো সোমবার। সময়টি ছিলো একদম ভোরবেলা, যাকে আরবিতে বলা হয় সুবহে সাদিক। অর্থাৎ রাতের শেষে যখন ভোর হবে বা ভোর হওয়া শুরু হয়, তখন পুবের আকাশ ফর্সা হয়ে ওঠে। আকাশে ধীরে ধীরে সুন্দর আলো জেগে ওঠে। তখন পাখিরাও ঘুম থেকে জেগে উঠে গান শুরু করে দেয়। ঠিক এসময় যখন সুবহে সাদিক তখন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. এই দুনিয়াতে এলেন।
যে শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন তার নাম মক্কা। তাঁর বংশের নাম হলো কোরাইশ। মজার বিষয় হলো- কোরাইশ বংশ আরব জাতির মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ বংশ এবং সবচেয়ে সম্মানীয় বংশ। তখন আরবদের নেতা ছিলো এই বংশের লোকেরা।
নবীজির বাবার নাম আবদুল্লাহ। মায়ের নাম আমেনা। তাঁর নানার নাম আবদুল ওয়াহাব। দাদার নাম হলো আবদুল মোত্তালিব। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. যখন জন্মগ্রহণ করেছেন ঠিক সে সময় কোরাইশদের নেতা ছিলেন মহানবীর দাদা আবদুল মুত্তালিব। আবদুল মুত্তালিব ছিলেন সবার মধ্যে জ্ঞানের দিক থেকে এগিয়ে। গুণের দিক থেকে সবার চেয়ে বেশি। মনের দিক থেকে ছিলেন অনেক অনেক উদার। খুব মিশুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। সবার সাথে মিলেমিশে থাকার খুব সুন্দর গুণ ছিলো তার। সততার দিক থেকেও তিনি আর সবার চেয়ে বেশি সৎ ছিলেন। ফলে কোরাইশদের মধ্যে মানুষ হিসেবে এবং নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত। তার চেয়ে বয়সে বড়রাও তাকে খুব সমীহ এবং সম্মান করে কথা বলতেন। তিনিও কাউকে অপমান হয় এমন কোনো কথা বলতেন না।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. এই দুনিয়ার বুকে আসার আগেই তাঁর বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। ফলে একজন এতিম শিশু হিসাবেই তিনি দেখলেন এই পৃথিবীর মুখ।
আরবে তখন শিশু লালন পালনের একটি নিয়ম ছিলো। নিয়মটি হলো- যারা উঁচু বংশের মানুষ তাদের ঘরে নতুন শিশুর আগমন ঘটলে, সে শিশুকে অন্যেরা লালন পালন করতো। যারা শিশু লালন পালন করতো তারা ছিলো অপেক্ষাকৃত গরিব শ্রেণির মানুষ। তাদের দায় বলা হতো।
মহানবী যেহেতু কোরাইশদের উচ্চ বংশে জন্ম নিয়েছেন তাই তাঁকেও লালন পালনের জন্য আরেকজনকে দিতে হয়েছে। যিনি শিশু মহানবীকে লালন পালনের ভার নিয়েছিলেন তার নাম হলো হালিমা। একটি অদ্ভুত বিষয় ছিলো এখানে। শিশু মহানবী এতিম বলে কেউ তাকে গ্রহণ করতে রাজি হলো না। কারণ যারা লালন পালন করবে তারা তাদের সুযোগ সুবিধার জন্য করবে। অর্থাৎ অনেক টাকা পয়সা পাওয়ার আশায় তারা শিশু লালন পালন করে। যেহেতু শিশু মহানবী এতিম তাঁর বাবা নেই তো কে তাদের টাকা পয়সা দেবে, এমন চিন্তা থেকে তারা শিশু নবীকে গ্রহণ করতে চায়নি।
এদিকে বিবি হালিমাও অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোনো ধনী ঘরের শিশু জোগাড় করতে পারলো না। কারণ তখন বিবি হালিমার গোত্রে খুব বড়সড় দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছিলো। দুর্ভিক্ষে তাদের উট ভেড়া দুম্বা শুকিয়ে প্রায় হাড্ডিসার হয়ে গেছিলো। কারণ তখন বৃষ্টি হচ্ছিল না একটুও এবং অনেকদিন ধরে। ফলে উট মেষ দুম্বার যে খাবার, মরুভূমির ঘাস লতাপাতা বৃষ্টির অভাবে তেমন কিছুই জন্মাচ্ছিলো না। খাবারের অভাবে গৃহপালিত সকল প্রাণীদের মাংস শুকিয়ে হাড্ডির সাথে লেগে গেলো। যে উট দুম্বা দুধ দিতো সেগুলোর ওলানের দুধও শুকিয়ে গেলো। আর এসব ঘটনা ঘটলো হালিমার গোত্রে। যে কারণে হালিমার কাছে বড়লোক কেউ তাদের শিশুকে লালন পালনের ভার দিতে চায়নি। তাই হালিমা সিদ্ধান্ত নিলো শিশু ছাড়াই সে ফিরে যাবে তার এলাকায়। তার মন খুব খারাপ। কেউ তাকে শিশু দিলো না। যার ফলে সে টাকা পয়সা বা সম্পদ পাবে না। তার অভাবও যাবে না। এমন মন খারাপ অবস্থায় সে যখন ফিরে যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিলো ঠিক তখন খবর পেলো শিশু নবী মুহাম্মদ সা. এর কথা। হালিমা সব শুনে ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো যে খালি হাতে ফিরে যাওয়ার চেয়ে এ এতিম শিশুটিকে নিয়ে যাবে সঙ্গে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি শিশু মুহাম্মাদকে গ্রহণ করলেন। তারপর চলতে থাকলেন তার বাড়ির পথে।
কিছুদূর যেতে না যেতেই একটি বিস্ময়কর বিষয় লক্ষ্য করলেন তিনি। দেখলেন শিশু মুহাম্মদকে বহনকারী দুর্বল উটটি মনে হলো আশ্চর্যজনক ভাবে ভীষণ শক্তিশালী হয়ে উঠলো। এই উটটি ছিলো নারী উট, একে বলা হয় উটনি। উটনিটি যেমন শক্তিশালী হয়ে গেলো তেমনই উটনির ওলান ভরে গেলো দুধে। এতই বিস্মিত হলো যে সে বিস্ময় তিনি কিছুতেই গোপন রাখতে পারছিলেন না। তিনি তার স্বামীকে চুপিচুপি এ বিস্ময়কর ঘটনার কথা বললেন এবং বাস্তবেও তাকে দেখালেন। তারা দু’জন খুব খুশি মনে ফিরলেন নিজের গোত্রের কাছে, নিজ বাড়িতে।
তারপরের ঘটনা আরও বিস্ময়কর! তা হলো- হালিমাদের সকল উট মেষ দুম্বা ভেড়া সবগুলোর শরীর নাদুস নুদুস হয়ে গেলো। দুধ দেয়ার যেগুলো সেগুলো প্রচুর পরিমাণে দুধ দেয়া শুরু করলো। মাঠে যেখানে ঘাস বলতে কিছুই ছিলো না সেখানে সবুজ ঘাস আর প্রাণীগুলো খাওয়ার মতো লতাপাতা প্রচুর পরিমাণে জন্মাতে থাকলো। রাতারাতি হালিমার পরিবার এবং সেই উসিলায় হালিমার গোত্রের লোকজনেরও উন্নতি ঘটতে লাগলো।
হালিমা এবং তার স্বামী খুব করে বুঝে গেলেন যে মুহাম্মদ নামে যে এতিম শিশুটি তারা নিয়ে এলেন এই শিশু কোনো সাধারণ শিশু নয়। এই শিশু একটি কল্যাণের এবং বরকতময় শিশু, যার উসিলায় তাদের দুর্ভাগ্য সৌভাগ্যে রূপ লাভ করেছে।
তারা স্বামী স্ত্রী দুজন বিশেষ করে হালিমা এই আশ্চর্যজনক এতিম শিশুটার যত্ন নিতে শুরু করলেন। হালিমা কোনোভাবেই শিশু মুহাম্মদকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেন না। তার যত্নে এতটুকুও অবহেলা বা গাফিলতি করেন না।
আরেকটি বিষয় আরও বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন হালিমা। তা হলো শিশু মুহাম্মদকে যখন দুধ খাওয়াতেন তিনি, শিশু মুহাম্মদ সবসময় একটি দুধই পান করতেন। আরেকটি দুধ জোর করেও তাকে খাওয়ানো যেতো না।
হালিমা খুব সহজে বুঝে গেলেন এই শিশু আরেকটি দুধ হালিমার আপন সন্তানের জন্য রেখে দিতেন। তাই কখনো জোর করলেও সেই দুধটি মুখে নিতেন না শিশু মুহাম্মদ।
অল্প দিনের মধ্যে হালিমা আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করলেন। তা হলো শিশু মুহাম্মদ খুব অল্প দিনের মধ্যে বেশ বেড়ে উঠেছেন। অর্থাৎ বয়সের তুলনায় তিনি খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠছেন বলে দেখতে পেলেন হালিমা।
তারপর দেখলেন- শিশু মুহাম্মদ কখনো ক্ষুধা বা অন্য কোনো সমস্যার কারণে কখনও কান্না বা চিৎকার করে না।
আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করে হালিমা অবাক হয়ে গেলেন! সে বিষয়টা হলো- শিশু মুহাম্মদ কোনো কিছুতে কান্না করেন না ঠিক কিন্তু একটি অবস্থায় তিনি সবসময় কেঁদে উঠতেন। যখন তার শরীর থেকে পোশাক খুলে ফেলতেন তখনই তিনি কান্না করতেন! তখন পোশাক পরিয়ে দিলে সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যেতো তার কান্না।
তারপর দেখলেন শিশুটা সবসময় হাসি মুখে থাকে। এবং আপন মনে নিজে নিজে হাত পা ছুড়ে খেলতে থাকেন। কিন্তু একটু খেয়াল করলে বোঝা যেতো আসলে সে একা নয় মনে হয় অন্য কারো সাথে খেলছে। বা অন্য কেউ তাকে খেলা করাচ্ছে।
এমনই আরও আরও অনেকগুলো বিষয় দেখে হালিমা এতই অবাক এবং বিস্মিত হয়ে গেলেন যে তার ভেতর একধরনের ভয়ও কাজ করছিলো! যদি এ শিশুর কিছু হয়ে যায়! যদি কেউ এই শিশুর ক্ষতি করে ফেলে। তাই তিনি শিশুটিকে বুকের কাছে আগলে রাখতেন। সবসময় সাবধান থাকতেন যেনো এতটুকুও অযত্ন না হয় শিশুটির। যত বড় হচ্ছে শিশুটি ততই তার ভেতর বিস্ময়কর নতুন নতুন বিষয় প্রকাশ পেতে লাগলো।
এমন বিস্ময়কর শিশু হালিমা তার জীবনে কখনও দেখেননি কিংবা কারো কাছে শোনেননি। একদিকে অলৌকিক সব বৈশিষ্ট্য অন্যদিকে এত সুন্দর চেহারা গায়ের রঙ চোখের চাহনি এবং মাথার চুল। সবমিলিয়ে হালিমা বুঝে গেলেন এ এক অনন্য শিশু যার কোনো তুলনা জগতে নেই! তাই তো সত্যি হয়েছে তাঁর মতো শিশু জগতে আর ছিলো না এখনও নেই। এবং পৃথিবীতে হবেও না কখনও।
তিনি শেষ নবী। তারপর আর কোনো নবী আসবেন না এই পৃথিবীতে। তাই আমাদের সঠিক পথে চলার জন্য তাঁরই অনুসরণ করতে হবে। তাঁর শিক্ষাগুলোর আলোকে আমাদের জীবনকে গড়ে তুলতে হবে।

Share.

মন্তব্য করুন