নেভশেহির তুরস্কের একটি প্রদেশের নাম। সেখানকার একটি এলাকা হলো কাপাডোশিয়া। এলাকাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩ হাজার ফুট উঁচু কিন্তু সেটি ছিল ডাইনোসরের দখলে। ডাইনোসর যুগের পতনের আরো পরে সেখানে ঘটে এক ভয়াবহ অগ্নুৎপাতের ঘটনা। সেই অগ্নুৎপাতের লাভার গরম আবরণের নিচে চাপা পড়ে বিশাল এই কাপাডোশিয়া। কিন্তু লাভা সেখানে স্থায়ী হয়নি। বছরের পর বছর রোদ-বৃষ্টি ও বাতাসের আর্দ্রতার প্রভাবে লাভার আবরণে পরিবর্তন আসে। গলিত লাভা রূপ নেয় নরম শিলামাটিতে। ধীরে ধীরে এই শিলামাটিতে জন্মে লতা-গুল্ম ও নানা প্রকার সবুজ উদ্ভিদ। এর সাথে সাথে গড়ে ওঠে মানববসতি।

ডেরিনকুয়ু নির্মাণ ও বসবাসের ইতিহাস
ঐতিহাসিকদের মতে, কাপাডোশিয়ায় খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০-১৬০০ শতাব্দী পর্যন্ত বসবাস করতো হিট্টাইট সম্প্রদায়ের মানুষজন। সেখানকার বৈরি প্রকৃতি, আগ্রাসী জনগোষ্ঠী দুর্র্ধর্ষ ডাকাতদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে চলছিল তাদের জীবন। একসময় তারা বুঝতে পারেন, নিজেদের অস্তিত্ব ও সম্পদের সুরক্ষার জন্য অদূরে নরম শিলামাটি খুঁড়ে নির্মাণ করতে হবে এক সুরক্ষিত পাতাল শহর। সেই ভাবনা থেকেই কঠোর পরিশ্রম করে মাটির প্রায় ২৫০ ফুট গভীরে ছড়িয়ে যায় নগরীর পরিসীমা। এভাবে গড়ে তোলে তারা কারুকার্যখচিত সুরক্ষিত এক গোপন শহর ডেরিনকুয়ু। শান্তিপ্রিয় হিট্টাইট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ হাজার মানুষ একত্রে বসবাস করতো এ শহরে। সে শহরে তারা নির্বিঘেœ যাতায়াতের জন্য মাটির উপরি তৈরি করে ৬০টি গোপন দরজা। এছাড়াও শহরের অলিতে-গলিতে আলো-বাতাস ও অক্সিজেন চলাচল যেন সহজে করতে পারে তার জন্য নির্মিত হয় আরো প্রায় ১,৫০০ চিমনি।
বুদ্ধিমান হিট্টাইটরা আরও করলো কি শত্রু বা অন্য জাতি থেকে বাঁচতে মাটি কেটে তৈরি করে অগণিত আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গপথ। যেন অন্য কেউ এ শহরে এলে মুহূর্তেই দিকভ্রান্ত হয়ে যায়। দ্বিধায় পড়ে যায় শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশের মূল সুড়ঙ্গ নিয়ে। এভাবেই তৈরি হয় এককালের জটিল ও দুরূহ গঠনবিশিষ্ট রহস্যময় ডেরিনকুয়ু পাতাল নগরী।

ফ্রিজিয়ান-অটোমান যুগ
ইতিহাসের বাঁক ঘুরে একসময় সুরক্ষিত ডেরিনকুয়ু শহর ফ্রিজিয়ানদের হাতে কুক্ষিগত হয়। সেখান থেকে চলে যায় বাইজেনটাইনদের হাতে। যুদ্ধে আত্মগোপনের ঢাল স্বরূপ বাইজেনটাইনরা এর ব্যবহার শুরু করে। যখন আরব-বাইজেনটাইন যুদ্ধ শুরু হয় তখন আরবদের অতর্কিত হামলা থেকে স্বর্ণমুদ্রা, গবাদিপশু ও প্রাণের সুরক্ষায় বাইজেনটাইনরা হামলে পড়তো এসব গুহায়। আর আরবরা আক্রমণ করলেই সৈন্য-সামন্ত ব্যতীত অন্যরা নিজেদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে লুকিয়ে পড়তো এখানে।
একসময় বাইজেনটাইনরাও পরাজিত হয় অটোমানদের কাছে। এভাবে শহরটি আরো একবার হাত বদল হয়। বিংশ শতাব্দীর পূর্বে তারা এ পাতাল শহরকে বন্দীদের জন্য ব্যবহার করা শুরু করে। ইতিহাসবিদদের ধারণা, তাদের আগে গ্রিকরাও মঙ্গোলিয়ানদের হাত থেকে বাঁচতে বসতি গড়ে এখানে।
তারপর কেটে গেছে আরও শত বছর। অগণিত বিবর্ণ ঘটনার মধ্য দিয়ে অবসান হয় অটোমান অধ্যায়ের। ফলে গ্রিস ও তুরস্কের যুদ্ধের পর ১৯২৩ সালে উভয় ভূখণ্ডের মধ্যে আদান-প্রদান হয় নিজেদের জনগণ। সেসময় সেখানে বসবাসরত খ্রিস্টান অধিবাসীরা ছেড়ে যায় রহস্যময় এই পাতাল শহর। অবশেষে চূড়ান্তভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে গড়ে ওঠা এই পাতাল নগরী।

পুনঃ আবিষ্কার
গ্রিকরা এই শহর ছেড়ে চলে গেলে শূন্য অবস্থায় ডেরিনকুয়ুর কেটে যায় আরো বহু বছর। আর মানুষরাও ভুলে যায় প্রাচীন এ নগরীর আদিকথা। এদিকে আধুনিক রাষ্ট্র তুরস্কও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ১৯৬৩ সালের দিকে ধর্মভীরু তুর্কিদের বসবাসও শুরু হয় এখানে। এসময় মধ্যবয়স্ক এক লোক নিজ গৃহের সংস্কার করছিলেন। হাতুড়ির আঘাতে ঘরের দেয়াল ভাঙছিলেন। এমন সময় আচমকা ধসে পড়ে কক্ষের নড়বড়ে মেঝে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি লুটিয়ে পড়েন জরাজীর্ণ মাটির গুহায়।
গুহায় ক্ষয়ে যাওয়া মাটির দরজার দিকে এগিয়ে যান তিনি। এরকম অসংখ্য গুহার সমাহার দেখতে পান। মনের অজান্তেই তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন তিন হাজার বছরের পুরনো পাতাল ডেরিনকুয়ু শহর। মুহূর্তেই এ ঘটনার খবর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। প্রত্নতাত্ত্বিকরাও ছুটে আসেন। তাদের অনুসন্ধানে একে একে বেরিয়ে আসে রহস্যময় নগরীর গোলকধাঁধাপূর্ণ গঠনশৈলীর ইতিহাস। প্রায় ১৮ তলাবিশিষ্ট এ শহরের বিভিন্ন তলায় খুঁজে পাওয়া যায় ভোজনকক্ষ, গুদামঘর, প্রার্থনাকক্ষ, আস্তাবল, ভূগর্ভস্থ রত্নভাণ্ডার, তেলের ঘানিসহ আরও অনেক কিছু। শহরের দ্বিতীয় তলায় দেখা মিলেছে কিছু অদ্ভুতদর্শন সমাধিরও।
এ থেকে অনুমান করা হয়, দ্বিতীয় তলাটি প্রার্থনালয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও একপাশে মৃত মানুষদের বিশেষ নিয়মে সমাহিত করার কাজে ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়াও সুপেয় পানি জন্য নলাকৃতির বিশেষ সুড়ঙ্গ। ইতিহাসবিদদের ধারণা, স্কুল, গির্জা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারও ছিল এখানে। সবমিলিয়ে এক পরিপূর্ণ সমৃদ্ধ শহর ছিল এই ডেরিনকুয়ু পাতাল নগরী।
১৯৬৯ সালে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বিচিত্র সংস্কৃতির এ নগরীর দ্বার পর্যটকদের জন্য উন্মোচিত করা হয়। তবে দুর্ঘটনা এড়াতে সেখানে বিপজ্জনক কিছু স্থান এখনো রাখা সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। রহস্যের চাদরে ঘেরা তুরস্কের ডেরিনকুয়ু শহর এখনো পৃথিবীর সৌন্দর্যবিলাসী পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে তারই দিকে।

Share.

মন্তব্য করুন