বাংলা সন অনুযায়ী আষাঢ় শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল। আসলে বর্ষণ শব্দটি থেকে বর্ষা বলা হয়েছে। বর্ষণ অর্থ হলো যা অনর্গল ঝরে বা ঝরতে থাকে। আর কাল অর্থ তো সময়। তাই বর্ষাকাল মানে এমন কাল বা সময় যখন বৃষ্টি অনর্গল ঝরতে থাকে ঝরতে থাকে। আসলেই তো এটা সত্যিই যে বর্ষাকালে বৃষ্টি একনাগাড়ে ঝরে অনেক সময়।
আমার ছোটবেলার সেই সব দিনের কথা খুব মনে পড়ে যায়। যখন বৃষ্টি ঝরতে দেখতে পাই। বৈশাখ মাস থেকেই ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে চলতে থাকতো। অবশ্য এ সময় মাঝে মাঝে কিছু দিন পরপর হতো বৃষ্টি। কিন্তু যে-ই না আষাঢ় মাস আসতো সেই শুরু হতো বৃষ্টির অনর্গল ঝরা। খুব করে মনে পড়ে এখনও- প্রতি বছর আষাঢ় মাসের প্রথম দিনই আকাশ কালো করে মেঘে ছেয়ে যেতো। গোটা আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা জমাট বেঁধে প্রায় অন্ধকার হয়ে যেতো। এর মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ বিজলির চমকে চোখ ধাঁধিয়ে ওঠার উপক্রম হতো। এসময় মাঠ থেকে রাখালেরা গরুর পাল, ছাগলের পাল এবং ভেড়ার পাল নিয়ে ফিরে আসতো দ্রুত। হাঁস মোরগ এবং কবুতরও ঢুকে যেতো তাদের থাকার জায়গায়। আকাশপথে পাখিরাও ফিরে আসতো তাড়াতাড়ি। চাষি ভাইয়েরা ক্ষেত থেকে লাঙল জোয়াল কাঁধে তুলে হাল চাষের গরু নিয়ে ফিরে আসতো বাড়ি। এর মধ্যে প্রচণ্ড বজ্রের নাকাড়া বাজিয়ে জোরালো বাতাস ছড়িয়ে নেমে আসতো বৃষ্টি। যারা বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে বাড়ি পৌঁছাতে পারে না তারা ভিজতে থাকে। হাওয়ার গতি যদি অত্যন্ত তীব্র হয় তো বৃষ্টির ফোঁটা কাঁটার মতো শরীরে সুঁই ফোটাতে থাকে। এসময় নিচের দিকে ফিরে সবাই চলতে থাকে। উপরের দিকে তাকানোর কোনো রকম সুযোগ হওয়ার উপায় থাকে না। কেননা বৃষ্টির ফোঁটা এতো জোরে নেমে আসে যদি চোখে এ ফোঁটা পড়ে তাহলে চোখের বেশ ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই কেউ ভুলেও এসময় আকাশের দিকে তাকানোর চেষ্টাও করে না। এমনকি গরু মহিষ ছাগল ভেড়াও আকাশের দিকে তাকায় না। এইসব পশুরাও প্রকৃতির এই ভাষা বুঝতে পারে খুব ভালো করে। তাই তো তারা নীরবে মাথা নুয়ে বৃষ্টির ভেতর ধীরে ধীরে চলতে থাকে।
আষাঢ় মাসের বৃষ্টির পানি অনেক অনেক ঠাণ্ডা থাকে। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজলে ঠাণ্ডায় শরীরে কাঁপন ধরে যেতো। এমনকি গুরু ছাগলের গাও কাঁপতো।
কিন্তু এখন ভাবি যে সেই আষাঢ় মাসের ঝুম বৃষ্টি আজ হয় না কেনো! এখন তো আষাঢ় কখন আসে কখন যায় বোঝারও উপায় থাকে না। আষাঢ় মাস শেষ হয়ে যায় কখনও কখনও কোনো কোনো বছর। কিন্তু বৃষ্টির কোনো দেখা মেলে না। আকাশ কালো করে সেই কালো মেঘও জমে না আর এখন। মনে প্রশ্ন জাগে কেনো এমন হয়ে গেলো বা হয়ে যাচ্ছে!
এর উত্তর নানারকম করে দেয়ার চেষ্টা করছেন পরিবেশবিদেরা। কেউ কেউ বলছেন এটা হলো আবহাওয়ার একটি পরিবর্তন। আবহাওয়ার পরিবর্তনে শীতও কমে গেছে আবার বৃষ্টিও কমে গেছে অনেক। কিন্তু আবহাওয়ার পরিবর্তনটা কেনো হয়েছে এটাও তো একটি প্রশ্ন। এর জবাবে তারা বলেন মানুষ গাছগাছালি বনজঙ্গল কেটেকুটে সাফ করে ফেলেছে বলে সময়ে বৃষ্টি হচ্ছে না। হলেও খুব অল্প স্বল্প কিছু হচ্ছে। আবার নদীনালা পুকুর ডোবা বিল-ঝিল সবই ভরাট করে শুধু বিল্ডিং আর দালানকোঠা তুলে ফেলছে। ইট আর পাথরের প্রাসাদে কেমন করে ঝরবে বৃষ্টির মতো সুমিষ্ট পানির ধারা!
হ্যাঁ এগুলো সত্যি কথাই পরিবেশবিদেরা বলেন। এর প্রমাণ কিন্তু আছে। কোথায় আছে সে কথা আমরা অনেকেই জানি না। আবার জানলেও খেয়াল করার প্রয়োজন অনুভব করি না। এটা আছে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে সূরা রোমে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- জলে স্থলে যত বিপর্যয় সংঘটিত হয় তা সবই মানুষের হাতি কামাই। তাহলে বোঝা যাচ্ছে প্রাকৃতিক সকল সমস্যার জন্য মানুষ দায়ী। মানুষ ভুল পথে চললে বা ভুল কাজ করলে জলে এবং স্থলে বিপর্যয় দেখা দেয়। এই যে প্রচণ্ড ঝড় তুফান সাইক্লোন সুনামি জলোচ্ছ্বাস হয় এগুলোর জন্যও মানুষেরা দায়ী। মানুষের অন্যায় কাজকর্মের জন্য এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসে বারবার। তাই আমাদেরকে সবসময় ভালো কাজ করার চেষ্টা করতে হবে এবং ভালো কথা বলতে হবে।
নিজে যেমন ভালো কাজ করতে হবে ঠিক অন্যকেও ভালো কাজ করার উপদেশ দিতে হবে। একজন আরেকজনের উপকার করার মন রাখতে হবে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের উপকার করলে এবং ভালো কাজ নিজে করে অন্যকে করার কথা বললে অবশ্যই আমরা প্রাকৃতিক এসব বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবো ইনশাআল্লাহ। অতি বৃষ্টি অনাবৃষ্টির হাত থেকে আমরা বাঁচতে পারবো অর্থাৎ মহান আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়ে দেবেন।
বলতেছিলাম আমার ছোটবেলার বৃষ্টির কথা। সেই যে আষাঢ় মাসে শুরু হতো বৃষ্টি এ বৃষ্টি একনাগাড়ে শ্রাবণ ভাদ্র এমনকি আশ্বিন মাসেও হতো। তবে আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রায় একটানা বৃষ্টি হতেই থাকতো হতেই থাকতো। মাঝে মাঝে একদম একটানা পাঁচ দিন সাত দিন এমনকি নয় দিনও বৃষ্টি থামতো না। সারাদিন সারারাত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাঝে মাঝে একটু আধটু থামতো বৃষ্টি। তাও ফোঁটা ফোঁটা ঝরতেই থাকতো। এ কয়দিন সূর্যের মুখ কেউ দেখতে পেতো না। দেখবে কি করে সূর্য দেখাই যেতো না। মনে হতো বুঝি সূর্য আর কোনোদিন উঠবেই না আকাশে। এসময় পুকুর দীঘি মাঠঘাট নদী-নালাতে পানি উপচে পড়তো। মাঠে এত পানি জমা হয়ে যেতো যে মাঠকেই মনে হতো বিশাল সাগর বা নদী।
মিষ্টি পানির এমন ভরে ওঠার আনন্দে মাছেরা লাফালাফি করতো আর ঘুরে বেড়াতো। মাছরাঙা বক ডুবুরি পাখিরা মাঠে মাছ শিকারে নেমে পড়তো। জেলেরা তো মাছ ধরতোই আবার এমনিও মানুষেরা মাছ ধরার চেষ্টা করতো। ঝাঁকিজাল মেরে বা চাঁই বসিয়ে কিংবা বিভিন্ন ধরনের জাল ফেলে মাছ ধরতো। আহা সেই আনন্দের দিনগুলো এখন আর নেই কোথাও। কোথায় যে হারিয়ে গেলো খুব করে ভাবতে থাকি। ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে ফিরে যাই সেই সব দিনগুলোতে যেখানে আমি আমার শৈশবকাল এবং কৈশোরকাল ফেলে চলে এসেছি। সেই সব বৃষ্টির দিনগুলো যে দিনগুলোতে ছোটবড় মিলে লুডু খেলেছি। বৃষ্টিতে দল বেঁধে ভিজতে ভিজতে হাত পা সাদা করে ফেলেছি।
কিন্তু আজ আর সেইরকম বৃষ্টির দেখা পাই না আমরা কেউ। আমরা যারা বড় হয়ে গেছি, অনেক বয়স হয়ে গেছে তারা যেমন পাই না। যারা এখন ছোট কম বয়স শিশু-কিশোর তারাও তেমন বৃষ্টি দেখেই না।
তাই আমাদেরকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা সবাই ভালো হয়ে ভালো করে সত্য পথে চলবো। সত্য পথে চললে আমরা আবার ফিরে পাবো সেই সুন্দর সব দিন।

Share.

মন্তব্য করুন