অ্যান্টার্কটিকা বাদে প্রায় সারা পৃথিবীতেই মাছরাঙা দেখা যায়। পুরাতন বিশ্ব আর অস্ট্রালেশিয়াতে এদের বিস্তৃতি সবচেয়ে বেশি। কোরাসিফর্মিস বর্গের অন্তর্গত অত্যন্ত উজ্জ্বল রঙের ছোট বা মাঝারি আকৃতির একদল পাখি। পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৯৪ প্রজাতির মাছরাঙা রয়েছে। বাংলাদেশে ১২ প্রজাতির মাছরাঙা আছে।
মাছরাঙার ঠোঁট ও পা শনাক্তির লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। পা খুব খাটো এবং যুক্ত আঙুল, তৃতীয় ও চতুর্থ আঙুল প্রায় পুরো লম্বালম্বি যুক্ত। দ্বিতীয় ও তৃতীয় আঙুল গোড়ার দিকে যুক্ত। আবার কিছু প্রজাতির দ্বিতীয় আঙুল খুব খাটো বা সম্পূর্ণ লুপ্ত। পালক সাধারণত চড়া রঙের, নীল, সবুজ, বেগুনি ও লালচে বা বাদামি আঁচসহ ঝলমলে ঔজ্জ্বল্য। আর এতে আলতোভাবে থাকে সাদা বা কালো দাগ। ডানা খাটো ও গোল। লেজ খুব খাটো থেকে অনেকটা লম্বাও হয়ে থাকে। এদের আকার ও ওজনে আছে বৈচিত্র্য- ৪০ সেমির বেশি লম্বা ৪০০ গ্রাম ওজন। আবার ১০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ১০ গ্রামের বেশি ওজনের মাছরাঙাও দেখা যায়।
মাছরাঙা সাধারণত নানা ধরনের জলজ আবাস ও বনে বসবাস করে। গাছের খোড়ল, মাটির ডাল বা অন্য পাখির খোঁড়া গর্ত বা গাছের পচা গুঁড়ির ফোকর বাসা তৈরি করে। ঠোঁট দিয়ে মাটি বা পচা কাঠ আলগা করে গর্ত খোঁড়ে। এবং পায়ের সাহায্যে ময়লা গর্তের বাইরে ছুড়ে ফেলে। এ গর্তের ভেতর স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই বসবাস করে। স্ত্রী মাছরাঙা ডিম পাড়ে। ডিমগুলি দেখতে চকচকে সাদা। মা ও বাবা উভয়ই ডিমগুলিতে দিনের বেলা তা দেয়। তবে রাতের বেলা শুধু মা পাখি ডিমগুলিতে তা দেয়। ডিম থেকে বাচ্চা বের হতে ঊনিশ থেকে বিশ দিন সময় লাগে। মাছরাঙার ছোট ছোট ছানারা বাসা ছাড়ার আগে অন্তত আট সপ্তাহ মা বাবার উপর নির্ভরশীল থাকে।
মাছরাঙা শিকার ধরার জন্য পানির দিকে মাথা নিচু করে ছোঁ মারে। ছোট মাছ, ব্যাঙ ও বড় বড় জলজ পোকামাকড় ধরার জন্য গাছের ডালে অনড় বসে থাকে। প্রায় পানির নিচে ঢুকে গিয়ে শিকার নিয়ে ডালে ফিরে আসে। শিকারকে কয়েকবার ডালে আছাড় মেরে তারপর শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে মাথার দিক থেকে গিলে ফেলে।
গ্রিক পুরাণে আছে- একবার এক রাজা সমুদ্র যাত্রায় গিয়ে জাহাজ ডুবে মারা গেলেন। এ খবর শুনে রানী সহ্য করতে পারলেন না। তিনি মানসিকভাবে খুবই ভেঙে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার টানে সমুদ্রে ডুবে মারা গেলেন। এ দৃশ্য দেখে আকাশের দেবতারা রানীর উপর সহমর্মী হয়ে তাকে একটি পাখিতে পরিণত করলেন। এ পাখি অত্যন্ত শান্ত ও ধৈর্যশীল।
পাতি মাছরাঙা ছোট ঝোপঝাড়ের ডালে বসে থাকে। সারা বিশ্বে সম্ভবত ছয় লক্ষের কম পাতি মাছরাঙা আছে। মাছরাঙা পাখি জোড়ায় জোড়ায় থাকে। জোড়ার একটিকে দেখতে পাওয়া গেলে অপরটিকে ও আশপাশে দেখা যায় বা ডাক শোনা যায়। ডাল ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় উচ্চস্বরে ডাকে ক্যা- ক্যা-ক্যা-ক্যা। প্রজননকালে অবিরাম গান গায়- পিউপিউ -পিউপিউ- পিউপিউ। অনেক সময় গম্ভীর স্বরে ডাকে-মেঘ-হও-মেঘ-হও।
বন উজাড় করার ফলে মাছরাঙার আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। এ ছাড়া জলাভূমি কমে যাওয়ার ফলে মাছরাঙার ভবিষ্যৎ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে পাখিটির বিভিন্ন প্রজাতির সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে নির্জন দুপুরে পুকুর বা জলাশয়ের আশপাশের ছোট গাছের চিকন ডাল বা বাঁশের খুঁটির ওপর স্থির অপেক্ষায় থাকা চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল রঙের মাছরাঙা সহজে দেখা যাবে না।

Share.

মন্তব্য করুন