অনেক অনেক কাল আগেকার কথা। জাপানের শিনশিন প্রদেশের ঘটনা। সেখানে বাস করতো এক বাঁদরওয়ালা। বানরের নাচ দেখিয়ে বেড়াতো সে। এটাই তার জীবিকা। সবাই তাকে বাঁদরওয়ালা বলে ডাকে। পোষা বানরকে দিয়ে নানা ধরনের কায়দায় কৌশল দেখায়। ভীষণ মজা পায় লোকজন। মানুষ খেলা দেখে খুশি হয়ে দু’চার টাকা করে দেয়। এ দিয়েই মোটামুটি কোনোমতে চলে লোকটির সংসার।
একদিন রাতের বেলার ঘটনা। লোকটার মেজাজ ভীষণ খারাপ। মুখ ভারভার। বৌকে সে বললো, এই বানর দিয়ে আর চলছে না। এটাকে আর রাখব না। কাল সকালেই তুমি কসাইকে খবর দেবে। কসাই এসে এটাকে নিয়ে যাবে।
বৌ হতবাক। স্বামী এটা বলছে কী? বানরের আবার কী হলো? বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ কসাইকে খবর দেয়ার ব্যাপার এলো কেন? আগা মাথা কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
স্বামীকে শুধায় সে,
হঠাৎ কসাইয়ের কথা বলছো কেন? বানরটার কী হয়েছে?
বানরওয়ালা জবাব দেয়,
আর বোলো না। এটাকে দিয়ে আর কাজ চলছে না। বুড়ো হয়ে গেছে সে। খেলার কসরত, কায়দা কৌশল আগের মত মনে রাখতে পারে না। প্রায়ই ভুলভাল করে ফেলে। খেলা আর জমে ওঠে না। লোকজন চটে যায়। বিরক্ত হয়। তারা খুশি না হতে পারলে পয়সা কড়ি দেবে কেন, তুমিই বলো। এই বুড়োটাকে খোঁচাখুঁচি করে পিটিয়ে পাটিয়েও বশে আনতে পারি না। ভুল সে করবেই। ভাবছি, এই হতভাগাকে কসাইয়ের কাছে বেচে দেবো। নতুন আরেকটা জোগাড় করে নেব। কিনবো কমবয়সী দেখে। তারপর খেলার কৌশল শিখিয়ে নেব।
বৌ নরম মনের মানুষ। তার খুব খারাপ লাগলো এসব কথা শুনে। স্বামীর কাছে অনেক অনুনয় বিনয় করলো, যাতে এমন নিষ্ঠুর একটা সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়। বানরের ওপর বৌটির খুব মায়া। এতকাল ধরে তাদের সঙ্গে আছে। থাকতে থাকতে সংসারের একজন হয়ে গেছে।
বৌয়ের কাকুতি মিনতি বিফল হলো। বানরওয়ালা তার সিদ্ধান্তে অনড়। কসাইয়ের কাছে বানর বিক্রি সে করবেই। কোনো নড়চড় হবে না এই সিদ্ধান্তে।
বানরটি ছিল পাশের ঘরেই। মনিব ও গিন্নির সব কথাবার্তাই শুনেছে সে। সব শেষ হয়ে যাচ্ছে তাহলে? এ কেমন অবিচার? কালই তবে তার জীবনের শেষ দিন? বাঁচার কোনো উপায়ই কী নেই? হয়তো আছে। সাত পাঁচ ভাবতে থাকলো বানর। এটা হতে দেয়া যায় না। কিছু না কিছু করতেই হবে। আপন মনে বললো বানর,
আমার মনিবটা ভীষণ বর্বর! বছরের পর বছর আমি তার কাজ করে আসছি। কোনো ফাঁকি দিইনি। কসাইয়ের কাছে পাঠিয়ে আমাকে মেরে ফেলা কী তার পুরস্কার? জীবনের শেষ ক’টা দিন শান্তিতে স্বস্তিতে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনিব সে রকম হতে দেবেন না। তিনি আমার সর্বনাশ করতে চলেছেন। এখন আমাকে জবাই হতে হবে। লোভী মানুষ আমার হাড়মাংস রান্না করে খাবে। উহ কী পৈশাচিক ব্যাপার। নাহ, এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না।
হঠাৎ বানরের মনে পড়লো, বনে এক ভালুক আছে। অনেক বুদ্ধি বয়স্ক সেই প্রাণীর। জঙ্গলের জন্তু জানোয়ার যারা আছে, বিপদে পড়লে সবাই তখন তখন ছুটে যায় তার কাছে। তার বুদ্ধি পরামর্শ নেয়। সেসব খুব কাজেও লাগে। এখন ওই ভালুকই ভরসা। তার কাছে যেতে হবে। এই মহাবিপদের সময়ে সে একটা বিহিত করে দেবে নিশ্চয়ই।
নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। মনিব ও তার বৌ ঘুমিয়ে পড়েছে। বানর কৌশলে তার বাঁধন খুলে রেখেছে আগেই। এক দৌড়ে চলে গেল বনে। সোজা সেই ভালুকের কাছে। ভালুক তাকে দেখে অবাক। বানর সময় নেয় না। বয়ান শুরু করে,
ভালুক ভাই। মহা বিপদে পড়ে ছুটে এলাম তোমার কাছে। আমাকে তুমি বাঁচাও ভাই। একমাত্র তুমিই আমাকে সাহায্য করতে পারো। আমি যে প্রাণে মারা পড়তে চলেছি। দেখতেই পাচ্ছো, বুড়ো হয়ে গেছি আমি। শরীরে আগের মতো জোর বল নেই। মনিবের মনের মত খেলা দেখাতে পারি না। নাচতে পারি না। একটুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। প্রভু আমাকে বিক্রি করে দেবে কসাইয়ের কাছে। কাল সকালেই এই দুর্ঘটনাটি ঘটবে। এই পরিস্থিতিতে আমাকে তুমি কী করতে বলো? আমি জানি তুমি একজন বুদ্ধিমান ও গুণী প্রাণী। এই মহাবিপদে তুমিই আমার একমাত্র ভরসা। বড় আশা নিয়ে তোমার কাছে ছুটে এসেছি।
প্রশংসা শুনে ভালুকের চোখ মুখ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। আনন্দে ও গর্বে। হ্যাঁ, এই প্রশংসা তার পাওনা বটে। রাজ্যের পশু-পাখি, জীব জন্তুকে সে উপদেশ পরামর্শ দিয়ে আসছে। বহুকাল ধরে। বিনিময়ে কিচ্ছু সে নেয় না। ভালুক ঠিক করলো, বিপন্ন এই বানরকে সাহায্য করবে সে। প্রাণ বাঁচাবে ওর। কিভাবে বাঁচানো যায়? সেটাই চিন্তা করে বের করা দরকার। কয়েক মিনিট ঝিম মেরে থাকলো ভালুক। চোখ বন্ধ করে আকাশপাতাল ভাবলো যেন। হঠাৎই পিটপিট করে চোখ মেললো। জিজ্ঞেস করলো বানরকে,
তোমার প্রভুর একটা বাচ্চা ছেলে আছে না?
বানর জবাব দেয়,
হ্যাঁ আছে তো। দুধের বাচ্চা। হামাগুড়ি দিতে শিখেছে মাত্র। এখন পর্যন্ত সে ভালো করে দাঁড়াতে পারে না। ওর কথা জানতে চাইছো যে? ওর সঙ্গে আমার জীবন-মরণের কী সম্পর্ক?
আছে হে, সম্পর্ক আছে। সে খুবই ছোট, তা বুঝলাম। সক্কালবেলাটায় ওই বাচ্চা কী করে? যখন তোমার মনিবের বৌ ঘর সংসারের কাজ করে, তখন ও কোথায় থাকে?
তখন বারান্দার এক কোনায় ওকে শুইয়ে রাখা হয়। নানান খেলনাপাতি দেয়া হয় ওকে। আপনমনে সেইসব নিয়ে খেলাধুলা করে বাচ্চাটা।
বেশ বেশ। ঠিক সকাল বেলা আমি চলে আসবো। সোজা তোমাদের বাড়িতে। আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই এক দৌড় দেব।
তারপর? কী হবে তারপর? বাচ্চা নিয়ে তুমি কী করবে?
কী আর করবো? সোজা দৌড় দেব বনের দিকে। তারপর দেখবে মজা। বাচ্চার মা সব কাজ ফেলে টেলে তার স্বামীকে বিষয়টি জানাবে। এই ফাঁকে তুমি আমার পিছু নেবে। কিছুদূর দৌড়ানোর পর তুমি আমার নাগাল পেয়ে যাবে। নাগাল যাতে পাও, সে ব্যবস্থাই করবো আমি। মোট কথা হলো, অপহৃত বাচ্চাটাকে তুমি উদ্ধার করবে। করে নিরাপদে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাবে। ব্যস, আর কিছু না। তারপর দেখো, কী কাণ্ড হয়। যা হবে, সে টুক আর বললাম না। তুমি নিজেই দেখতে পাবে। তোমার কোনো দুশ্চিন্তা আর থাকবে না।
বানর জানতে চায়,
ঠিক কোন্ সময়টাতে এ ঘটনা ঘটাতে চাও। সকালে তো কসাইকে খবর দিতে যাবে মনিবের বৌ। ভালুক হাসিমুখে বানরকে আশ্বস্ত করে,
অতশত ভাবছো কেন বাপু? সাতসকালেই যা ঘটানোর ঘটিয়ে ফেলবো। কসাইকে খবর দেওয়ার আগেই। যাও তো, এখন বাড়ি যাও। নিশ্চিন্তে ঘুমাও গিয়ে। মরণের ভয় কোরো না আর।

দুই.
ভালুক বন্ধুকে অজস্র ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বাড়ি ফিরে এলো বানর। দুশ্চিন্তা কিছু কমেছে তার। তবে পুরোপুরি দূর হয়নি। আচ্ছা এই প্ল­্যানটা ঠিকঠাক মতো কাজ করবে তো? যদি একটু ভুলভাল হয়ে যায়। কী হবে তাহলে?
রাতে ভালো ঘুম হলো না বানরের। হওয়ার কথাও না। কী না কি ঘটে, তা নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই। প্ল­্যান যদি কোনোভাবে ভণ্ডুল হয়ে যায়, তাহলেই সেরেছে। নির্ঘাত মরণ। কসাইয়ের ধারালো দায়ের কোপ তার ঘাড়ে পড়বে। কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না আর। এসব চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলে ঘুম কী আর পায়? কোনোমতেই পায় না। আকাশ-পাতাল ভাবনায় মাথা গরম হয়ে থাকে। বানর তক্কে তক্কে ছিল, কখন ভোর হয়। ভোর হওয়ার পরে আসল খেলার শুরু। জীবন মরণের খেলা যাকে বলে। উরে বাপস। কী হবে? ভাবলেই রক্ত হিম হয়ে আসে।
ভোর হলো। অন্যান্য দিন যে রকম হয়, সে রকমই। আলাদা কিছু না। বানরের জীবনে অবশ্য আজকের ভোরটা বড়োই আতঙ্কের। কে জানে, হয়তো এটাই তার জীবনের শেষ ভোর। সেটা আবার নাও হতে পারে। কী যে হবে শেষ পর্যন্ত, অনুমান করা শক্ত। বানর ভয়ে আতঙ্কে সিঁটিয়ে আছে। মহা নাটকীয় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘটবে ভয়ঙ্কর সেই ব্যাপারটা। কসাইকে খবর দিতে যাওয়ার আগেই কাণ্ডটি ঘটে যাবে।
বাড়ির গিন্নি ঘুম থেকে উঠলেন। সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভেঙে গেল তার। রোজই তিনি এ সময় উঠে পড়েন। উঠেই ঘর সংসারের কাজে লেগে পড়তে হয়। আজও তাই হচ্ছে। ঘরের জানালা দরজা খুললেন প্রথমে। তারপর নাশতা বানানোর জোগাড় যন্তরে মন দেয়া। বাচ্চাটাকে বারান্দায় মাদুরের ওপর শুইয়ে দিলেন। সে আপনমনে খেলছে। হাসছে ফিকফিক করে। হঠাৎ কোত্থেকে হুমদো একটা ভালুক চলে এলো বাড়িতে। এসেই ছোঁ মেরে তুলে নিলো ছোট শিশুটিকে। নিয়ে ভোঁ দৌড়। চোখের পলকে ঘটে গেল অভিনব এই ঘটনাটি। মনিব গিন্নি যখন ব্যাপারটা টের পেলেন, ততক্ষণে ভালুক দৌড়ে বেশ কিছুটা পথ পার হয়ে গেছে। বানরও এরই মধ্যে পিছু নিয়ে ফেলেছে তার। সে রকমই কথা। গিন্নি হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন তড়িঘড়ি। হাত-পা ছুড়ে চেঁচিয়ে স্বামীকে ডাকলেন। বললেন, ওগো একটা ভালুক আমাদের বাবুকে নিয়ে গেছে। শিগগিরই দৌড়াও। ছেলেটাকে উদ্ধার করো।
স্বামী বেচারা তখনও ঘুমুচ্ছিলেন। আচমকা হৈ চৈ শুনে ঘুম চটে গেল তার। পড়িমরি করে দৌড়ালেন বনের দিকে। ভালুক তাদের ছেলেকে নিয়ে যেদিকটায় গেছে সেদিকে। ভালুক ততক্ষণে চলে গেছে অনেক দূরে। বানর গেছে তার পিছু পিছু। বানরওয়ালা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন যে, ভালুককে ধাওয়া করেছে তারই পোষা বানর। প্রায় ধরেই ফেলেছে মনে হয়। হ্যাঁ হ্যাঁ, ধরে ফেলেছে ঠিক। বাচ্চাটাকে ছিনিয়েও নিতে পেরেছে। শাবাশ। বানরটা বুড়ো হলে কী হয়, ওর তেজ ভীষণ। এত বড় একটা ভালুককে হটিয়ে দিতে পেরেছে। কী দুঃসাহস। হটানো শুধু নয়, খোকাকে উদ্ধার পর্যন্ত করে ফেলেছে। এও কী সম্ভব? নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। বানরটা যে কী উপকার করেছে, তা বলার মতো না।
বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সগর্বে বাড়ি ফিরে এলো বুড়ো বানর। তার পেছন পেছন মনিব। বৌ তখন বললে বানরওয়ালাকে,
এই উপকারী জীবটাকে তুমি কসাইয়ের কাছে বেচতে চাও? তুমি নিজেই একটা কসাই। ও যদি আজকে না থাকতো, আমার বাবুকে কী ফিরে পেতাম আর? চিরজন্মের জন্য ওকে হারাতে হতো। খবরদার। এই বানরকে বেচে দেওয়া দূরে থাক, কোনোরকম কষ্ট দেওয়ার কথা পর্যন্ত তুমি চিন্তা করবে না আর।
বানরওয়ালা কাচুমাচু হয়ে জবাব দেয়,
বৌ, তুমি খাঁটি কথাই বলেছো। আসলে আমারই অন্যায় হয়ে গেছে। গুরুতর একটা পাপ করতে যাচ্ছিলাম আমি। ভাগ্যিস বেঁচে গেছি। বেঁচে গেছে আমাদের বাচ্চা ছেলেটাও। এই বানরটা যে এত সাহসী, এত তেজি, সেটা আমি জানতাম না। ও সত্যিকারের খাঁটি বন্ধু আমাদের। কসাইকে খবর দেওয়ার কোনো দরকার নেই আর। সবার জন্য চমৎকার নাশতা বানাও দেখি। বানরটাকেও খুব ভালো করে খেতে দাও। ওর মত উপকারী স্বজন এই দুনিয়ায় দ্বিতীয় কেউ নেই আমাদের। ও তো আমাদের সংসারেরই একজন।
এরপর থেকে বানরকে আর কোনো জ্বালাতন সহ্য করতে হয়নি। মালিক তাকে আর কোনোদিন মারধরও করেনি। সব সময় ভালো ভালো খাবার খেতে দিয়েছে। বানরের দিনকালও কেটেছে বেশ সুখে শান্তিতে।

Share.

মন্তব্য করুন