সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ হলো। বাইরে বেশ কুয়াশা পড়েছে। শাহিন লেপ দিয়ে মাথা ঢেকে শুয়ে আছে। সে আজ স্কুলে যাবে না। মা শায়লা পারভিন রুটি ডিম ভাজি বানিয়ে ছেলেকে ডাকলো-
শাহিন, ওঠ্ বাবা। স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যাবে। নয়টায় ক্লাস। তাড়াতাড়ি কর বাবা। আমারওতো স্কুলে যেতে হবে।
মায়ের কথা শুনেও শাহিন চুপ মেরে শুয়ে আছে। মনে মনে বলছে, যতই ডাকো আজ আমি স্কুলে যাব না। আজ রফিক স্যারের ক্লাস। বাপরে বাপ রফিক স্যারের যা রাগ। তার উপর আমি অঙ্ক পারি না। না বাবা আজ আমার স্কুলে যাওয়া চলবে না। ওহ্ বাবা পা টা খুব ব্যথা করছে। বাহ্, ভালোই তো হলো মাকে এই পায়ের ব্যথার কথা বললে মা আমাকে জোর করে স্কুলে পাঠাবে না। কাল ফুটবল খেলতে গিয়ে পটকা এমন একটা কিক মারল। মারলিতো ফুটবলে লাগলো আমায় পায়, গাধা কোথাকার। মারলিতো মারলি এমন জোরে মারলি পা-টা সত্যিই খুব ব্যথা করছে। যাক পটকা তুই যা করেছিস ভালোই করেছিস।
কিছুক্ষণ পর খুঁড়াতে খুঁড়াতে শাহিন বিছানা ছেড়ে উঠে মায়ের কাছে গেল।
মা বলল- কিরে তুই খুঁড়াচ্ছিস কেন। কী হয়েছে।
শাহিন আহ্লাদের সুরে বলল- ও মা, এই দেখ পায়ে অনেক ব্যথা। কাল বিকেলে ফুটবল খেলতে গেলাম। রাগ করোনা, তুমিইতো ফুটবল খেলা পছন্দ কর। তাইতো গেলাম। খেলার সময় পটকা ফুটবল মনে করে আমার পায়ে এমন জোরে একটা লাথি মারল। মা খুব ব্যথা করছে।
– আচ্ছা এই ব্যথা নিয়ে স্কুলে যাবি কিভাবে? থাক বাবা আজ স্কুলে যেতে হবে না। ঘরে বসে পড়। টেবিলে রুটি ডিম আছে খেয়ে নিস। আর টি টেবিলের নিচে কৌটা থেকে একটা নাপা খেয়ে নিস। আমি তাহলে যাই। সাবধানে থাকিস।
বেরিয়ে গেল শায়লা পারভিন। শাহিন দরজা বন্ধ করে মনে মনে বলল- মা এখনো আমাকে একা রেখে যেতে ভয় পায়। আরে আমিতো এখন বড় হয়েছি। ক্লাস সেভেনে পড়ি। আর আমিতো একাই। বাবা নেই। মা চাকরি করে। কি করবে মা, চাকরি না করলে আমাদের চলবে কিভাবে।
আজ সে ইচ্ছে করেই স্কুলে যায়নি কিন্তু একজনের জন্য তার খুব মন খারাপ লাগছে। তিনি হলেন জহির স্যার। স্কুলে একজন তরুণ শিক্ষক এসেছেন। তিনি সব ছেলেমেয়েকে খুব ভালবাসেন। তাদের নতুন দিনের গল্প বলেন। শাহিনকেও খুব ভালোবাসেন। তাকে দেখে শাহিনের বাবার কথা মনে পড়ে যায়। একা একা ভালো লাগছে না। পড়তেও ভালো লাগে না তার। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল, তারপর ছবি আঁকতে শুরু করল। সে খুব সুন্দর ছবি আঁকে।
বিকেলে শায়লা পারভিন বাসায় ফিরে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে- বাবা আমারতো আসতে দেরি হয়ে গেল। দুপুরে খেয়েছিস বাবা।
শাহিন হেসে বলে- মা এত চিন্তা কর কেন। খেয়েছি তো।
– কী খেয়েছিস বাবা।
– ভাত খেয়েছি। তরকারিওতো ছিল।
– রাতে মাছ রান্না করে দেব। মজা করে খাস।
– মা শোন, আমাদের স্কুলে না একজন টিচার এসেছে খুব ভালো। দেখতেও খুব সুন্দর। সুন্দর জামা কাপড় পরে। উনি যখন হাসেন তখন পাশের বাসার রুমকির চাচার মত দেখা যায়। যখন চুপ করে থাকেন তখন নানো বাড়িতে গফুর মামা আছে না তার মত দেখা যায়। আর আমাকে যখন আদর করেন তখন কার মত দেখা যায় জান মা?
– আমি জানবো কি করে? বল কার মত দেখা যায়।
– একদম বাবার মতো। মা ও-মা, তুমি চুপ করে আছ কেন?
– এমনিই। তুই বল না, আমি শুনছিতো।
– মাগো বাবা যেখানে চাকরি করত, ঐ যে রাঙ্গামাটি। একটা গান আছে না,
রাঙ্গামাটির দেশে যা, লাল পাহাড়ের দেশে যা। অ মা আমার ঐখানে খুব যাইতে ইচ্ছে করে। একদিন চল না মা। মাগো, ঐ দেশের মাটি কি সত্যিই রাঙা। লাল পাড়ার আছে ঐখানে?
– শায়লা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে যা বাবা আর কথা বলিস না। দেখি রান্নার ব্যবস্থা করি।

শাহিন পরের দিন স্কুলে গিয়ে জহির স্যারের সাথে দেখা করে। আগের দিনের আঁকা ছবিটা দেখায় তাকে। স্যার তো ছবি দেখে অবাক। জিজ্ঞেস করে বলতো তুমি কিসের ছবি এঁকেছ?
সে বলে, বাবা যেখানে কাজ করতেন, রাঙ্গামাটির দেশ।
– তুমি গিয়েছিলে সেখানে?
– না স্যার। যাইনি। বাবা বলেছিলেন নিয়ে যাবেন। বাবাতো আর ফিরেই এলেন না।
মাকে বলি মা শুনতেই চায় না। কিন্তু আমার মন চলে যায় ঐ লাল পাহাড়ের দেশে।
– মন খারাপ করো না। একদিন ঠিক যেতে পারবে। আমরা স্কুল থেকে পিকনিকের আয়োজন করব। রাঙ্গামাটি যাবো সবাই মিলে। আমি থাকি আর নাই থাকি তোমরা যাবে। যাহোক তুমি রাঙ্গামাটি যাওনি কিন্তু সে জায়গার ছবি আঁকলে কিভাবে।
– বাবা বলতেন ঐ জায়গার কথা। যেমন বলতেন তেমন করে এঁকেছি।
– না দেখেই শুধু মনে মনে চিন্তা করে কি চমৎকার একটি ছবি এঁকেছ তুমি। তুুমি একদিন খুব বড় একজন শিল্পী হবে। কখনো ছবি আঁকা ছেড়ে দিও না। আগামীকাল আমি চলে যাব। আমেরিকায় চলে যাচ্ছি। সাত দিন আছি বাংলাদেশে। তোমরা সবাই খুব ভালো থেকো।
জহির স্যারের কথা শুনে শাহিনের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সে চুপ হয়ে গেল। তার মাথার উপরের আকাশ আরো অন্ধকার হয়ে গেল। সে মনে মনে ভাবে, যখন বাবা ছিলেন তখন চারিদিক ফুরফুরে ছিল। আকাশটা ছিল খুব পরিষ্কার। যেদিন বাবা মারা গেলেন সেদিন আকাশটা একদম অন্ধকার হয়ে গেল। আজ সেই আকাশটা আরো বেশি অন্ধকার হলো।
শাহিনের মলিন মুখটা দেখে জহির স্যার বলল, কী হয়েছে শাহিন? চুপ করে আছ কেন? কি ভাবছ?
শাহিন শান্ত কণ্ঠে বলে- ভাবছি, বাবাতো চলেই গেছে। যে বাবার মতো সেও চলে যায়। স্যার আমি একদিন আপনাকে স্বপ্নে বাবা বলে ডেকেছিলাম। আর তখন আকাশটা খুব ঝকঝকে ছিল।
মন খারাপ করো না। আবার দেখা হবে। খুব ভালো থেকো।
স্যার ক্লাসেও তার চলে যাবার কথা সবাইকে বলল। ক্লাসে খুব সহজ সরল একটি ছেলে আছে। ওর নাম নাঈম। ওর মা বাবা সব আছে। ওরা খুব বড়লোক। নাঈম জহির স্যারকে খুব ভালোবাসে। স্যার চলে যাওয়ার কথা শুনে ও কান্নকাটি শুরু করে দিলো। ওর কান্না দেখে শাহিনও কেঁদে ফেলল। কিন্তু সে কান্না কেউ দেখতে পেল না। স্যার ওকে কোন রকম বুঝিয়ে কান্না থামাল।
পরের দিন ঠিকই জহির স্যার চলে গেলেন। শাহিনের খুব মন খারাপ। সে ভেবেছিল, জহির স্যার তাকে এত ভালোবাসেন সেই একদিন ওকে লাল পাহাড়ের দেশে নিয়ে যাবে। স্যারই চলে গেল তার আর লাল পাহাড়ের দেশে যাওয়া হলো না। তার আর স্কুলে যেতে ভালো লাগে না। তার কিছু ভালো লাগে না। পড়তে ভালো লাগে না। খেতে ভালো লাগে না। সে দিন গুনে, স্যার চলে গেছেন পাঁচ দিন হলো। আর মাত্র দুদিন আছেন বাংলাদেশে। ভাবতে ভাবতে গাড়ির হর্নের শব্দ শাহিনের কানে এলো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। দেখত পেল একটি লাল রঙের গাড়ি এসে থামল। গাড়ির দরজাটা খুলে গেল। শাহিন একি দেখছে। জহির স্যার। সে দৌড়ে দরজা খুলে বাইরে যায় জহির স্যারের কোমর জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।
জহির স্যার খুব মিষ্টি করে বলে- কান্না কেন, এইতো আমি ফিরে এসেছি। তোমাদের সাথেই থাকবো। তোমার সাথে। তোমাকে লাল পাহাড়ের দেশে নিয়ে যাবো।
শাহিন আকাশের দিতে তাকিয়ে দেখে পরিষ্কার আকাশে ঝলমলে রোদ্দুর।

Share.

মন্তব্য করুন