একসময় আমাদের এই মগড়া নদীতে পানির তাণ্ডব চলতো। লঞ্চ, স্টিমার সারা বছরই চলাচল করতো। তখন এত সড়ক বা পাকা রাস্তা ছিল না। চলাচলের জন্য নদীই ছিল উপযোগী পথ। বর্ষাকাল ছাড়াই নদী অথই পানিতে তলিয়ে থাকতো। আর বর্ষাকালে তো কথাই নেই। দু’কূল ছাপিয়ে পানি চলে যেতো গ্রামে। গ্রামগুলোকে তখন মনে হতো পানিতে ভাসমান সুনিপুণ এক চিত্রকর্ম। মাছের কোনো অভাব ছিল না। অতি সম্ভ্রান্ত ছাড়া সবাই প্রায় মাছ মারতো। কোন বেলা ভাতের সাথে মাছ থাকবে না সেটা হতেই পারে না। কিন্তু এ সবই এখন কেবল অতীত। বৃদ্ধ বৃদ্ধারা হয়তো সেসব কথা স্মরণ করে দু’ চোখের অশ্রু ফেলেন। নাতি নাতনীদের কাছে বলেন তাদের সেই সব সোনালি দিনের কথা। তাদের সহজ সরল জীবন যাপনের কথা। তখন তাদের হয়তো অনেক কিছুর অভাব ছিলো কিন্তু সুখের কোন অন্ত ছিলো না। যান্ত্রিক জীবনের ভয়াবহতা সেই সব পুরনো মানুষগুলোকে আতঙ্কিত করে।

অতি প্রাচীনকাল থেকেই কোন এক অজানা কারণে নদীর সাথে নদীতীরের মানুষের রয়েছে অগাধ টান। এক অবিচ্ছেদ্য আত্মার সম্পর্ক। মগড়া নদীতে এখন আর আগের মতো বুক কাঁপানো ঢেউ নেই। নেই এর বিশালতা। লঞ্চ এখন আর চলতে পারে না। শুধু মাত্র বর্ষাকালে ছোট ছোট স্টিমার চলতে পারে। মাছে ভাতে বাঙালির নদীর প্রিয় সুস্বাদু মাছ এখন আর জাল ফেলতেই লাফিয়ে ওঠে না। কমে গেছে নদীর গভীরতা। সেই সাথে কি মানুষের ভালোবাসার গভীরতাও খানিকটা কমে যায়নি? তবে রক্তের সম্পর্ক যেমন সহজেই ছিন্ন করা যায় না। এই নদী আর তার আশপাশের মানুষের সম্পর্কও তেমনি এখনো বিদ্যমান। এই টান গাছের মূলের মতো গেঁথে আছে মাটির অনেক গভীরে।
তখন বর্ষা। নদী তার পূর্বের রূপ কিছুটা হলেও ফিরে পেয়েছে। গ্রামের পশ্চিমে যেদিকে নদীটা কিছুটা বেঁকে গেছে সেখানেই রয়েছে শ্মশান। গাঁয়ের লোক তাই নীরব এ জায়গার ঘাটটাকে নাম দিয়েছে শ্মশানঘাট। গাঁয়ের প্রায় সবাই মুসলিম। কয়েকঘর হিন্দু রয়েছে। তাদের জন্যই নির্দিষ্ট করা হয়েছে এ জায়গাটাকে। নদীর পাড় ঘেঁষে গাঁয়ের সবচে বড় জঙ্গলটার পশ্চিমের মাথায়। এক সময় এই ঘাটের নাম ছিলো গরুর ঘাট। নামকরণ ব্যাপারটি একটি তাজ্জব ব্যাপার। পরিস্থিতির আলোকে আপনা আপনি সে নাম নিতে পারে বা পরিবর্তন করতে পারে। একটা সময় ছিলো যখন গাঁয়ের সবাই তাদের গরুগুলোকে গোসল করাতে এই ঘাটেই নিয়ে আসতো। এখনো গরুর ঘাট নামটি হারিয়ে যায়নি। শ্মশানঘাট ও গরুর ঘাট দুটি নামই এখনো মানুষের মুখে মুখে। শ্মশান থেকে একটু দূরেই নদীর চর বেড়ে গিয়ে বিশালাকার ধারণ করেছে। বর্ষাকালেও এখানে হাঁটু পানি বা ঊরু পানির বেশি হয় না। শ্যাওলায় ভরা এ জায়গাটিতে চিংড়ি মাছ প্রচুর পাওয়া যায়। জালি ঠেললে অন্য মাছ উঠুক বা না উঠুক চিংড়ি মাছ উঠবেই। এছাড়া ছোট ছোট পুঁটি, চান্দা, চিকরা সহ ছোট ছোট অনেক জাতের মাছ পাওয়া যায়। তাই এখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সহ স্কুলপড়–য়া ছেলেদেরও জালি ঠেলতে দেখা যায়। ছেলেমেয়েরা এ চরের নামই দিয়ে দিয়েছে ইসার চর। (চিংড়ি মাছের চর।)।

রনি আর নাজমুলের স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। অথচ পাতিলে তেমন মাছ রাখা যায়নি। নাজমুল বলে, রনি ভাই, আমি আর মাছ মারমু না। ইস্কুলের সময় অইয়া গ্যাছে। যাই খালাম্মা বকবো।

ক্যান? তোর মাছ মারা অইয়া গ্যাছে? দেহি তর পাতিল দেহি। বলে রনি। ওর চোখ নাজমুলের পাতিলের দিকে।
কোমরে রশি দিয়ে বাঁধা পাতিলটাকে টেনে এগিয়ে দিলো সে রনির দিকে। রনি দেখে বলে,
কি রে নাজমুল, একটা তরকারির বোঝও তো মারস নাই। অহনই যাবিগা?
তে কিতা করমু? ইস্কুলে না গেলে তো বুঝই খালাম্মা গোসা করবো। তুমি না গেলে একলা একলা মারতে থাহো। আমি যাই। চলে যেতে যেতে বলে নাজমুল।
আইচ্ছা তুই যা। আম্মারে কইছ আমার আইতে দেরি অইবো। চিৎকার করে নাজমুলকে বলে রনি। বলেই আবারো জালি ঠেলতে থাকে সে। এ মাথা থেকে ও মাথা। ও মাথা থেকে এ মাথা। কোনো ঠেলায় হয়তো ওঠে। আবার কোনো ঠেলায় ওঠে না। কিন্তু সে দমবার পাত্র নয়। ওর আজকে এক তরকারির মতো মাছ মারতেই হবে। একটা ঝোপে জালির ধাক্কা লাগতেই হঠাৎ করে ভেসে ওঠে একটা ঢোড়া সাপ। তারপর রনির পাশ দিয়ে চলে যেতে থাকে এঁকে বেঁকে। রনি ভয় পায় না। এসব দেখে সে অভ্যস্ত। সে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে সাপের চলে যাওয়া দেখে। রনি ভাবে নদীও তো একটা সাপের মতোই। এঁকে বেঁকে চলে গেছে কোন অজানায়। কত দূরে। ইস সেও যদি নদীর শেষ মাথায় যেতে পারতো। রনি হয়তো জানে না যে, নদীর যেখানে শেষ সেখানেই সাগরের শুরু। আর সে এক বিশাল কিছু যা মানুষের জীবনের মতোই। যেখানে শুধু হতাশা আর ভয়ের ছাপ।
নাহ। এ কয়টা মাছে কি আর সালুন অইবো? তবু আইজ আর মারমু না। অহন জাইগা। মনে মনে বলে রনি। জালি আর পাতিলটা পাড়ে রেখে সে আবার নেমে পড়ে নদীতে। গোসলের জন্য। দুই তিনটা ডুব দিয়ে বুক পানিতে দাঁড়িয়ে শরীর মাজতে থাকে সে। এমন সময় একটা নৌকায় চেপে আট থেকে দশজন মাঝি জাল ফেলতে থাকে নদীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত। বিশাল সে জাল। যে জালকে রনি বলে ‘রাক্ষুসে জাল’। নদীর এপার থেকে ওপার একদম গভীর পর্যন্ত যা কিছু এর ভেতরে পড়ে সব আটকে যায়। বেরোবার কোনো পথ খুঁজে পায় না। রনি এসব দেখে সহ্য করতে পারে না। চিৎকার করে বলে ওঠে, আনহেরা যুদি বেক মাছ মাইরালান তে আমরা কিতা মারবাম? নৌকার সবাই প্রায় একসঙ্গেই হেসে ওঠে। কী বলে এই অবোধ বালক। তারা জেলে। মাছ ধরাই তাদের কাজ। যত বেশি মাছ তত বেশি আয়। ডিমওয়ালা মাছ নিয়েও তারা চিন্তা করে না। যা পায় সব চলে যায় তাদের মাছ রাখার খলুইয়ে। একজন চিৎকার করে রনির উদ্দেশে বলে, ঐ বাততি পোলা, অনেক ট্যাহা দিয়া সরহারের কাছ থাইক্যা এই গাঙ আমরা লিজ লইছি। সারা গাঙ আমরার। বেবাক মাছ আমরার।

রনি আর দুই তিনটা ডুব দিয়া পাড়ে উঠে আসে। জালির ভেতর পাতিলটা রেখে কাঁধে তুলে নেয় জালিটা। শেষ বারের মতো একবার পেছন ফিরে তাকায় সে। দেখতে পায় গুছিয়ে নেওয়া জালের ভেতর লাফাচ্ছে অসংখ্য রূপালি মাছ। ঘাড় ঘুরিয়ে জোরে হাঁটা দেয় সে।

সন্ধ্যার পর বাড়িতে ফেরে শামসু মিয়া। উঠান ভিজে থপথপে হয়ে আছে। সে নিজেও ভিজে চুপসে আছে। সারা বিকাল ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যার পরও টিপ টিপ করে ঝরছে। কাপড় খুলে খেতে বসলো শামসু মিয়া। ভাতের সাথে রনির ধরা সেই গুঁড়া চিংড়ি মাছ। মাছ দেখেই তো শামসু মিয়ার চোখ কপালে উঠলো। কি রে রনি, আইজ তুই স্কুলে যাস নাই? সারাদিন ধইরা এইসব গুঁড়া মাছ মারছস? হুঙ্কার দিয়ে ওঠে শামসু মিয়া। রনিও খেতে বসেছিল। সে কিছু বললো না। রনির মা মুখ টিপে হাসলো। রনির ছোট বোন সুমা বলে ওঠে, হাছাই আব্বা। বাই আইজ ইস্কুলে যায় নাই।
কাইল থাইক্যা ইস্কুলে যাবি। রনির মাথায় হাত দিয়ে বলে শামসু মিয়া। এইসব গুঁড়া মাছ দিয়া কিতা অইবো। হুদাহুদি সময় নষ্ট করিস না। আমিতো বাজার থাইক্যা মাছ কিইন্যা আনমুই।
এক গ্লাস পানি খেয়ে আবারো বলে, মাছতো আমরাই মাইরা খাইছি। আমরার কহালে লেহাপড়া আছিন না। মা বাপও লেহাপড়ার কথা কয় নাই। লক্ষ্মী বাপ আমার, মন দিয়া লেহাপড়া কর।
রাতে ঘুমাতে গিয়েও রনির মন প্রাণ জুড়ে থাকে নদী আর মাছ। এসবের কথা ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে। স্বপ্ন দেখে সে। স্বপ্ন জুড়ে থাকে শুধু নদী, মাছ আর সমবয়সীদের নিয়ে পানিতে ছোটাছুটির দৃশ্য। রনি দেখে মাছ তার সাথে কথা বলছে। হরেক রকম মাছ। পুঁটি, চান্দা, খইলা, কটকটি, গুতুম, ইছা, পাবদা, কাইক্যাসহ আরো কতো মাছ। সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। রনি জানে ভালো ছেলেদের সবাই আদর করে। গ্রামের লোকেরাও তাকে খুব আদর করে। এখন তাকে বেশি করে পড়তে হবে। আব্বা আম্মার আশা তার পূরণ করতেই হবে। রনি তখন বন্ধুদের সাথে স্কুলের পথে।

Share.

মন্তব্য করুন