সকাল হতেই ইমাদ বের হয়ে যায়। সরাসরি কথা বলবে আজ। আর কোনো সময় নয়। হয়তো আজ তাকে জব কনফার্ম করবে নয়তো টাকাটা ফেরত দেবে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কিভাবে ভাব প্রকাশ করবে তা নিয়ে ভাবছে। অফিসের দুয়ারে আসতেই চমকে গেলো ইমাদ। খুব সস্তা দামের তালা ঝুলছে অফিসের দুয়ারটাতে। ইমাদ খুব কাতর ভঙ্গিতে তালাটা ধরলো। ভাবছে এই তালাবদ্ধ ঘরটাতে তার স্বপ্নটাও যে আটকে গেছে। মোবাইলটা বের করে অফিসের নাম্বারে কল দিতেই সুইচ অফ শুনতে পায়। নিরুপায় হয়ে তালাটার দিকে আবারো তাকালো ইমাদ। খুব ইচ্ছে করছে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে। এই বয়সেই তার জীবন ডায়েরিতে একটি ব্যর্থতার গল্প লেখা হয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর নিজেকে খুব হালকা মনে হলো। ইমাদ যেন এখন পানিশূন্য গভীর কূপে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ নেই দেখার। চিৎকারের শব্দও কোন অদৃশ্য পথে মিলিয়ে যায়। তবুও কেউ শোনার নেই। ইচ্ছে করছে না দু’কদম সামনে গিয়ে বাড়ির দিকে ছুটতে।
উদ্দেশ্যহীন মানুষ চলতে পারে না। যেখানে উদ্দেশ্য নেই আকাক্সক্ষা নেই সেখানে মানুষ থমকে যায়। জীবনের স্বাদ হারিয়ে ফেলে। অনীহা চলে আসে সাড়ে তিন হাত অকার্যকর দেহের প্রতি।

অনুশোচনার ঘোর কেটে ইমাদ স্বাভাবিক হলো। এই স্বাভাবিকতার কোন পথ নেই। বাসায় ফিরবে কি ফিরবে না এই নিয়ে চিন্তিত। বাসায় গেলে খালার টাকার হিসেব কিভাবে দেবে সে? চারদিক থেকে যেন আটকে আছে তার পথ। যাওয়ার কোন পথ নেই। বাস থেমে গেলো। লম্বা জ্যাম। মালিবাগের জ্যাম। বাস থেকে নেমে গেলো ইমাদ। কিছুক্ষণ হাঁটলো সামনের দিকে। কোন উপায় যে মাথায় আসছে না। শহরে আসতে না আসতেই এ যেন অভিশাপের পিণ্ড হয়ে আছে তার জন্য। গ্রামটাই অনেক ভালো ছিলো। জ্যাম ছেড়ে দিলো। লাফ দিয়ে আবার বাসে উঠতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে না বাসায় ফেরার। মালিবাগ রেললাইনের দিকে আসতেই মাগরিবের আজান দিয়ে দিলো। এমন অবস্থায় খোদার কাছে হাত পাতা প্রয়োজন। নামাজ পড়ে করুণ সুরে আকুতি জানালো ইমাদ। মনে কিছুটা প্রশান্তি ফিরে এলো। তবুও বাসায় ফেরার ভয় কাটেনি। টাকা ছাড়া সেই বাসায় যাওয়াই অসম্ভব।

রাত গভীর হচ্ছে। খালা চিন্তায় পড়ে গেলো। কোথায় বসে আছে ইমাদ। এত দেরি তো হওয়ার কথা না। ফোন সুইচঅফ। একটু পর আসলো খালু। তার মনে ঢুকছে সন্দেহ। ইমাদ নেশায় জড়িয়েছে। ‘আমি আগেই কইছিলাম। তুমি তো তার পক্ষ নিছিলা। দেখছো এখন? বাহিরে নেশা পানি নিয়ে বেহুঁশ হয়ে আছে। কালকেই গ্রামে পাঠাই দিমু।’
কিছুক্ষণ হুমহুমিয়ে শুয়ে পড়লেন খালু। খালার তবুও ঘুম নাই। তিনি জানেন ইমাদ এমন নয়। তাহলে কেন এত লেট হচ্ছে। ডাইনিং টেবিলে বসে রইলেন ইমাদের অপেক্ষায়।
চাঁদের পাশে আজ কোন তারা নেই। চাঁদের মত একা ইমাদও। ফুটপাতে গা ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে উপরের দিকে। এই শহর খুব বিষণœ মনে হচ্ছে। গ্রামেই ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু ফিরে গিয়ে কী করবে। কিছু না কিছু তাকে করতে হবে। বাসায় ফিরবে না সে। না খেয়ে মারা গেলেও নিজেকে তৈরি করা ছাড়া কারো কাছে যাওয়া যাবে না। রাত আরো গভীর হচ্ছে। সম্ভবত ১২টা পার হলো। মোবাইল বন্ধ হয়ে আছে। চার্জ দিয়ে খোলারও ইচ্ছে নেই। ক্ষুধায় শরীর কাঁপছে। ইমাদকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ফুটপাতে থাকা এক ছেলে ইশারা করল। ইমাদ কিছুই বলছে না। বসে রইলো তার জায়গাতেই। ধীরে ধীরে ঘুম চলে আসে। ইমাদকে না আসতে দেখে ফুটপাতের ছেলেটি উঠে এলো তার দিকে। হাত লাগাতেই ইমাদের ঘুম ভেঙে যায়।
– এহানে বসে রইলা কা? কই থাকো?
ইমাদ চুপ করে রইলো।
– বাসা কই তোমার?
– বাসা নাই।
– এখানে থাকবা?
– ইমাদ আবারো চুপ করে রইল। এমনিতে ক্ষিধায় শেষ। তার মাঝে এত এত প্রশ্ন।
ছেলেটা চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর আবার এলো। হাতে সামান্য খাবার।
এই নাও এটা খাও।
– খাবো না।
– খাও। ভালো এগুলা।
এই কঠিন অবস্থায় খাওয়া পেয়ে ইমাদ যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে। কথা ছাড়াই সব খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষে দেখে ছেলেটি কেমন হাস্যরসের ভঙ্গি নিয়ে ইমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইমাদের মনে ভয় ঢুকে গেল। এ আবার সাথে কিছু মিশাই দিলো নাকি?
– কয়দিন খাওনাই হ্যাঁ?
এই বলে আবার হাসতেছে। ইমাদ বুঝতে পারলো ইমাদের খাওয়া দেখে এমন হাসছে।

ক্লান্ত শরীর নিয়ে পিলারের পাশেই শুয়ে পড়ছে ইমাদ। রাত বাজে সাড়ে ৩টার মত। কেমন যেন ফিসফিস শব্দ হচ্ছে। গভীর ঘুমেও শব্দগুলো কানের সামনে বিরক্তিকর বাদ্য বাজাচ্ছে। ঘুম আলতো চোখে যেদিক থেকে শব্দ আসছে সেদিকে চোখটা ঘুরালো। নিয়ন আলোতে দেখা যাচ্ছে স্যুট পরা কেউ একজন পুরো শরীর নাড়িয়ে কথা বলছে। যার সাথে কথা বলছে সে খুবই সাধারণ পোশাকে। দুজনই বেশ ভদ্র। কৌতূহল জাগলো ইমাদের মনে, এত রাতে এইখানে কিসের আলাপ করছে? ইমাদ ঘুমের ভান ধরেই কানটাকে তাদের কথার মাঝে খাড়া করে দিলো।
– স্যার, কালো ফিতার ব্যাগটাতে এই এলাকার সবার বায়োডাটা আছে। এই ব্যাগটা পুলিশের রুম থেকে নিয়েছি।
– ভেরি গুড। সিসি ক্যামেরায় বোঝা যাবে না তো?
– না স্যার। আমরা পুরো মুখোশ পরা ছিলাম।
– যে দারোয়ান সহযোগিতা করছে তাকে কি করছো?
– স্যার, তাকে চিরনিদ্রায় রেখে এসেছি।
– গুড গুড, ভেরি গুড।
এই বলে একটু হাঁ করে হেসে নিলো সাধারণ পোশাকের লোকটা। আর সাদাটাতে কী আছে?
– স্যার এটাতে প্রভাবশালী ধনী এবং নেতাদের ডিটেইল আছে। স্যার এগুলো সব এই এলাকার।
– ওকে, কালকে আশপাশে কোনো এলাকায় অভিযানে যাবে না। কালকের মিশন পুরো সাইনবোর্ড এলাকায়। আমি এই এলাকার ফাইলগুলো নিয়ে সেটাপ রেডি করি।
– ওকে স্যার।

ইমাদের মনে ঢুকলো সন্দেহ। পুলিশের কাছ থেকে তথ্য চুরি করে কি করবে এরা? নিশ্চয় ভদ্র চেহারার বেশ ধরে এরা বড় কোন ক্রিমিনাল চক্র। ইচ্ছে করছে ওদের গতিবেগ অনুসরণ করতে। কিন্তু ভয়ে তা আর সম্ভব হয়ে উঠছে না। ইমাদ দেখলো স্যুট পরা লোকটি নাম্বারবিহীন গাড়ি করে চলে যাচ্ছে। সাধারণ পোশাকের লোকটি যাচ্ছে ঠিক বিপরীতে। কোন দিকে যাচ্ছে তা ঘাড় বাঁকা করে দেখার সাহস মোটেও নেই এখন। ইমাদের এখন কি করণীয় তা ভেবেই যাচ্ছে। চারদিকে ফজরের আজান দিচ্ছে। ইমাদ ভাবলো পুলিশকে জানাবে। পরক্ষণেই আবার ভয় কাজ করে। পুলিশ দেখলেই তার অজানা ভয় কাজ করে। আজান শুনে মসজিদের দিকে মনটা খুব টানছে। সমস্যা হলো পোশাক। এক দিনে পোশাকের যে কঠিন অবস্থা, তাতে মসজিদে যাওয়া মোটেও সম্ভব নয়। একটু কাত হতেই আবার ডুব গেলো গভীর ঘুমে।

গাড়ির হর্নে ঘুম ভাঙলো। অ্যাম্বুলেন্স। রাস্তা ব্লক করে দিয়েছে পুলিশ। এমন কাণ্ড দেখতে ভীড় জমাচ্ছে মানুষ। একজনকে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে উঠালো। সবাই বলাবলি করছে- কি হইছে কি হইছে! ইমাদ তাকিয়ে আছে। নিশ্চয় এটা সেই দারোয়ানটা। যে ভেতর থেকে ভদ্রবেশে থাকা লোকদের সাহায্য করছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যা দেখে নির্দ্বিধায় বলা যায় অনেক ভয়ানক কিছু হতে যাচ্ছে। ইমাদের কাছে যে তথ্য আছে তা দিলে হয়তো পুলিশের সামান্য উপকারও হতে পারে। যাই হোক পুলিশকে এমন তথ্য দিতে হবে। সত্যের উপর ক্ষতি হলেও বিনিময় ভালো কিছু আসে। ইমাদ পুলিশকে জানানোর চিন্তা স্থির করলো। কিন্তু বলার মত কোন সুযোগই পাচ্ছে না। চারদিকে যেভাবে সিকিউরিটি দেয়া হয়েছে তাতে বড় কোন পুলিশকে বলাও যাবে না। ইমাদ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সুযোগের অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর একজন পুলিশ বের হলেন ভেতর থেকে। খুব দ্রুত বের হয়ে অকিটকিতে কি যেন বললো। ইমাদ এই সুযোগ মিস করলো না। দৌড়ে গিয়ে পুলিশের কাছে দাঁড়ালো। সাথে সাথে বাঁশি দিয়ে ইমাদকে আটকে দিলো গার্ড। ইমাদ চিৎকার দিয়ে বললো আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। প্লিজ আমাকে বলতে দিন। ইমাদের এমন কথা শুনে ব্যস্ততা ছেড়েই ইমাদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন পুলিশ অফিসার। পুলিশের তাকানো দেখে গার্ডরা ইমাদ থেকে সরে দাঁড়ালো। অফিসার কিছুক্ষণ ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর ইশারা দিয়ে গার্ডদের সরে যেতে বললেন। ইমাদের তখনই হাত-পা কাঁপা শুরু হলো।
পুলিশ অফিসার একটু সামনে এসে জানতে চাইলেন কি এমন গুরুত্বপূর্ণ।
– আমি কাল রাতে এই দিকের ফুটপাতে কিছু তথ্য চুরির কথা শুনছি।
এতটুকু শোনাতেই পুলিশ চোখ বড় করে ধমক দিয়ে বললো চুপ। এ বিষয়ে আর কোথাও বলছিস?
– জি না স্যার।
অফিসার গার্ডকে বললো ওকে ভেতরে নিয়ে আসো।
ইমাদকে ভেতরে আনা হলো। অফিসার তাকে নিয়ে গেলো প্রাইভেট রুমে। চেয়ার টেনে তাকে বসতে বলল।
ইমাদের পুরো শরীর কাঁপা শুরু করছে। মনে মনে ভাবছে না বলাই ভালো ছিলো। এখন ভয়ে তার অবস্থা খারাপ।
– শান্ত হও। ভয় পাওয়ার কিছু নাই। যা যা জানো বলো। এই রফিক এখানে এক গ্লাস পানি দাও।
ইমাদ নিজেকে কিছুক্ষণ স্থির করে নিলো।
-নাম কি তোমার?
-ইমাদ।
-থাকো কোথায়?
-টিটিপাড়া খালার বাসায় থাকতাম, এখন ফুটপাতে।
-মানে? ফুটপাতে কেন?
ইমাদ ফুটপাতে থাকার কারণ পুরোটা অফিসারকে বললো।
-তারপর?
-আমি ওদিকের মোড়ে যে কারেন্টের পিলার আছে সেটার নিচে শুয়ে ছিলাম। সময় তখন সাড়ে তিনটার মত হবে। আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি তখন পাশে দু’জন ব্যক্তির আওয়াজ শুনতে পাই। ভদ্র দুজনই।
অফিসার তখন কিছু নোট করে নিলেন।
– দেখতে কেমন ছিলো?
– একজন স্যুট পরা ছিল, বাকি জন নরমাল ড্রেসে ছিলো। নরমাল ড্রেসে যে ছিলো সে স্যুট পরা লোকটির বস।
– কিভাবে বুঝলে তুমি?
– কথা শুনে মনে হলো…।
– আচ্ছা তারপর বলো।
– এত রাতে এভাবে কথা বলতে দেখে আমার সন্দেহ হলো। আমি ঘুমের ভান ধরে তাদের কথা শুনতেছিলাম। তারা এখান থেকে তথ্য চুরির কথা বলছে। দুটি ব্যাগে তথ্য নিয়েছে। একটাতে এলাকার সবার তথ্য আরেকটাতে এলাকার ধনীদের তথ্য।
কথা বলতে বলতে ইমাদের মাথায় ঝিম ধরে গেলো। চোখ কেমন যেন ঘোলাটে মনে হচ্ছে। কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না। তারপর কি ঘটছে কিছুই জানে না ইমাদ। হুঁশ ফেরার পর নিজেকে পুলিশ হসপিটালে আবিষ্কার করে। হাতে স্যালাইন লাগানো। পাশে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ অফিসারসহ বেশ কয়েকজন। ইমাদের চোখ খোলার পরেই অফিসার পাশে এসে জিজ্ঞস করলেন- কয়দিন খাওনাই তুমি?
ইমাদ চুপ করে রইলো। ঠিকমত তো সে আজ কয়েকদিনই খাচ্ছে না।
– কেমন লাগছে এখন? অফিসার বললেন।
– ভালো।
– বাকি ঘটনা এখন বলতে পারবা?
– জি।
ইমাদ ধীরে ধীরে সব বললো।
একটা ল্যাপটপ নিয়ে আসলো পুলিশ। অফিসার সেটা থেকে ফুটেজ নিয়ে ইমাদকে দেখায়। তারপর অফিসার দ্রুতই চলে গেলেন। যাওয়ার আগে নার্সকে বলে গেলেন যেন ইমাদের কোনো ক্ষতি না হয়।

দুর্বলতা অনেকটাই কেটে গেছে। ইমাদ দেখছে আশপাশের পুলিশগুলোকে। এদের বাহির থেকে খুবই ভয়ানক মনে হলেও ভেতর থেকে খুবই সাধারণ। ভাবতে ভাবতে ঘুমের ঘোরে ডুব গেলো। রোদের প্রখরতা কমে গেছে। হন্তদন্ত হয়ে অফিসার আসছে ইমাদের দিকে।
কেমন আছো ইমাদ?
– জি ভালো।
নার্সের কাছে জানতে চাইলো, সে কি ঠিকমত চলাচল করতে পারবে কিনা?
নার্সের হ্যাঁ সম্মতিতে অফিসার তাকে সাইনবোর্ড নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
অফিসার তার গাড়ি করে নীরবে ভিন্ন রাস্তা দিয়ে সাইনবোর্ড পৌঁছে। পুলিশি পোশাকে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত ছদ্মবেশে আছে। ইমাদকে নিয়ে গেলো সিসিটিভি ফুটেজ রুমে। অফিসার বললেন, এখান থেকে মনোযোগ দিয়ে যতটুকু সম্ভব সকল মানুষদের যেন খেয়াল করতে। কাল রাতের দুজনার কেউ আছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে। ইমাদ দেখতে লাগলো সিসিটিভি ফুটেজ।

সন্ধ্যা পার হলো। সময় এখন প্রায় নয়টা। দুজনার একজনকেও দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে চারদিকে পুলিশের তৎপরতা। আলসে এবং বিরক্তি ভর করছে ইমাদের মন এবং শরীরে। তবুও মনোযোগ স্থির রাখার অপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নিয়মিত। থানার রাস্তায় পুলিশের গাড়ি ছাড়া অন্য সব গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ। মালামালবাহী ট্রাক যেতে দিচ্ছে তবে সম্পূর্ণ চেকাপ করে।
একটা ট্রাকের দিকে ইমাদের চোখ পড়লো। সামান্য স্লো করে একজন সহযোগী চালক নামলো গাড়ি থেকে। নেমেই কথা বলতেছে পুলিশের সাথে। ইমাদ সাথে সাথে ডাক দিলো অফিসারকে। অফিসার দ্রুত এসে বিষয়টা খেয়াল করলেন। কয়েকজনকে নিচে গিয়ে আড়ালে কি বিষয়ে কথা বলছে তা নিশ্চিত হতে পাঠালেন। একটু পরেই এদিক সেদিক হাঁটতে দেখা যাচ্ছে একজন ভদ্রলোককে। ইমাদ বলে উঠলো-‘স্যার! এই লোকটাকে সম্ভবত ওই রাতে দেখেছি।’
– আর ইউ শিউর?
– আমার তাই মনে হচ্ছে।
– নিশ্চিত বলতে হবে। স্ক্রিনটা আরেকটু জুম করো তো। এবার ভালো করে দেখো।
ইমাদ এবার নিশ্চিত হলো সেই রাতের দু’জনের একজন এই।
– ইয়েস স্যার। এই লোকই।
সাথে সাথে অফিসার তার প্ল্যান অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিলো। ইমাদকে পাঠানো হয়েছে অফিসারের রুমে। রাত হতে না হতেই পুরো ক্রিমিনাল টিম ধরা পড়লো। এই খবরটি অফিসার এসেই ইমাদকে দেয়। পরের দিনেই সবার সামনে অফিসার ইমাদের কথা বলেন। সবার সামনে ইমাদকে এর বিনিময় সম্মানী দেন।
কল দেয়া হয় ইমাদের মায়ের কাছে। কথা বললেন অফিসার নিজেই। ইমাদের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ায় মা দিশেহারা হয়ে গিয়েছে। ছেলের ফিরে আসার সংবাদ সাথে বীরত্বের কথা জেনে কান্নাই যেন থামছে না। থানায় ছুটে আসলো খালু। সাথে খালাও। অফিসার তাদের হাতেই তুলে দিলেন ইমাদকে। কিন্তু ইমাদের কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছিলো রাস্তার পাশের সময়টাই ভালো ছিলো। হিসাববিহীন জীবন। খালা-খালুর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ইমাদের হারিয়ে যাওয়া সংবাদ সবার অবস্থা খারাপ করে ছাড়ছে। খালুর মুখে কোন কথা নাই, খালা ক্রমাগত প্রশ্নই করে যাচ্ছে। ইমাদ চুপ। কোন জবাব দিতে তার ইচ্ছে করছে না। সিএনজির ঝাঁকুনিতে চোখে ঘুম চলে এলো।

কিছুক্ষণ পরেই প্রচণ্ড আঘাত অনুভব করলো ইমাদ। তারপর অচেতন। চোখ খুলতেই নিজেকে আবিষ্কার করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটা রুমে। চারদিকে গ্লাস দেওয়া। হাতে এবং মাথা ব্যান্ডেজ করা। মাথা নাড়ালেই প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হয়। মনের ভেতর ভয়। কোথায় আছে সে। খালা-খালু কই? কি এমন হলো মুহূর্তেই। মাথা নাড়িয়ে চারদিক দেখবে সেই অবস্থাও নাই। নাড়ালেই ব্যথা। খুব করে কানতে ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণ পর একজন ডাক্তার এলো। মাথায় এবং হাতে চেকাপ করলো। ইমাদের কোন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না। কাজ শেষে আবার চলে গেলো। ইমাদ কিছুক্ষণ চিৎকার করলো। চিৎকার শুনে ডাক্তার দৌড়ে আসলো। কী সমস্যা?
আমি এখানে কেন? খালা-খালু কই?
ডাক্তার কিছু না বলেই ইনজেকশন ঢুকিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা মনে হতে লাগলো। ইমাদ বুঝতে পারছে তাকে যে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে। চোখ আর খোলা রাখার সামর্থ্য হলো না। ঘুমিয়ে পড়লো।

নির্দিষ্ট সময়ের পর ঘুম ভাঙলো ইমাদের। রাত না দিন কিছুই জানা নেই। বোঝা যায় না কিছু এই কাচের বদ্ধঘরে। ঘাড় ঘুরাতেই দেখা মিলল দুজন লোকের। বেশ স্মার্ট পোশাক। ইমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
– কেমন আছো?
– আমি এখানে কেন? আমার খালা খালু কোথায়?
– উনারা আছে বাসায়। তুমি চিন্তা করো না।
– তাহলে আমাকে এখানে কেন আনলেন?
– ভয় পেয়ো না। তোমাকে দিয়ে আমাদের অনেক কাজ আছে। তুমি এখন থেকে এখানে কাজ করবে। এখানে থাকবে।
এই বলেই চলে গেলো। ইমাদের ভয় বেড়ে গেছে আরো। এখানে থাকতে হবে মানে?

অনেক বড় এই ঘর। চারপাশ গ্লাস দেওয়া। কেউ কারো সাথে কথা বলতে পারবে না কাজ ব্যতীত। বিশাল এক রুমে অনেকগুলো কম্পিউটারে ঝুঁকে আছে প্রায় অর্ধশত লোক। সবাই নিজের কাজ করছে। ইমাদকে নিয়ে গেলো ২২৩ নং রুমে। ইমাদের বয়সের আরও অনেকেই আছে।
ইমাদকে দাঁড় করানো হলো আলাদা। এক্সরে মেশিনের মত একটা মেশিনে ইমাদকে শোয়ানো হলো। বেল্ট দিয়ে বেঁধে দেওয়া হলো তার পুরো শরীর। চিৎকার করে যাচ্ছে ইমাদ। মুহূর্তেই সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেলো। হাত এবং মাথায় কেমন যেন ঠাণ্ডা ফিল হচ্ছে। অনুভূতি চলে যাচ্ছে। ইমাদ চিৎকার করে যাচ্ছে। এই চিৎকার শোনার কেউ যেন নেই। সুঁই ঢুকানো হলো মাথায় এবং হাতে। সব কিছু ঝাপসা হতে লাগলো। তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো মাথায়। এখন চিৎকার করলে যন্ত্রণা আরো বাড়ে। ইমাদ ধীরে ধীরে সব কিছু ভুলে যাচ্ছে। একসময় অজ্ঞান হয়ে যায় ইমাদ।
মেশিন থেকে বের করে শোয়ানো হলো সাদা কাপড়ের উপর। দেখে মনে হচ্ছে ইমাদ আর নেই। ডাক্তার এসে চেকাপ করে।
Sir this is correct time.
Ok!
ঙশ!
ইমাদকে নেয়া হলো আরেকটি রুমে। মধু সংগ্রহকারী ভোমরের মত ভোঁ-ভোঁ শব্দ পুরো রুম জুড়ে। ইমাদ মুখে শব্দ করছে।
– কে তুমি?
– জানি না।
– কোথা থেকে আসছো?
– জানি না।
– তোমার বাড়ি কই?
এবার কোনো জবাব নেই। ওখানকার সাইকোলজিস্ট ভয় পেয়ে গেছে। ইমাদের কিছুই আর মনে পড়ছে না। বাড়ির নাম শোনার পর কেমন যেন মাথায় ঝিম ধরে বসলো।
দ্রুত তাকে ব্ল্যাক ফাইলের মেডিসিন দাও। কুইক!
ইমাদকে মেডিসিন দেয়া হলো। এতে সে স্মৃতি মনে আনতে পারবে না।
– স্যার। আপনি এখন তাকে পরিচয় শেখাতে পারেন। আর এই মেডিসিনটা নিয়মিত তার খাওয়ায়ে দেবেন। এতে সে স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারবে না।
ইমাদ স্মৃতিভ্রষ্ট হলো, কার্যত মারাই গেলো। এখন সে পৃথিবীতে বেঁচে আছে নতুন নামে। গোমরুজ। এখানকার সবাই পৃথিবীতে নতুন পরিচয়ে। এদের গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন রূপে। কাজে লাগানো হচ্ছে সাইবার ক্রাইমে। গোমরুজকে গড়ে তোলা হচ্ছে একইভাবে। সবচেয়ে মেধাবী হলো গোমরুজ।

দুই বছর পার হলো। গোমরুজ হয়ে উঠলো দুর্দান্ত একজন। পুরো নেটওয়ার্কিং কন্ট্রোল তার হাতে। বানানো হলো মোবাইল সিম। সিমটা বিক্রি হবে তরুণদের কাছে। এই সিম যার ফোনে ইন্সটল করা হবে তার সাইকোলোজিক্যাল কন্ট্রোল নিয়ে নেয়া হবে। এখান থেকেই সবাইকে কন্ট্রোল করা হবে। গোমরুজের পাশে থাকে নিয়মিত একজন ডাক্তার। যে খাবারে প্রথম দিন থেকেই মেডিসিন দিয়ে যাচ্ছে। মেডিসিন গ্যাপ গেলেই গোমরুজ তার স্মরণশক্তি ফিরে পেতে পারে। সিমের কাজ শেষ। এখন সময় হয়েছে লোভনীয় অফারে তরুণদের কাছে পৌঁছে দেয়া। গোমরুজের নেতৃত্বাধীন রয়েছে অনেকগুলো ছেলে। যারা গোমরুজের মত দুর্দান্ত। ভেতর থেকে বসে এরাই কন্ট্রোল করবে দেশের তরুণদের। ইমাদ হয়ে জীবনের প্রথম যাদের চক্রান্ত থেকে এই সমাজকে বাঁচিয়েছে আজ গোমরুজ নামে সেই ইমাদই হলো এই চক্রান্তকারীর প্রধান। এবং এই সমাজ নয় এই দেশের তরুণকে ধ্বংস করছে সে।

সিম বিক্রি হচ্ছে ধারণার বাইরে। জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তরুণদের মাঝে। ২ লক্ষ তরুণের ফোনে এই সিম। নির্দেশ অনুযায়ী আজ প্রথম অভিযান। দুই লক্ষ তরুণকে কন্ট্রোল করে দেশের বড় একটি অংশ দখল করা হবে। হাতে সময় আর দু’ঘণ্টা।
দীর্ঘ দুই বছর গোমরুজের পেছনে সময় দিচ্ছেন ডাক্তার। তিনি চেয়েছেন গোমরুজ ফিরে আসুক। আবার হয়ে উঠুক ইমাদ। এই দুই বছর তিনি নিয়মিত ঔষধ ব্যবহারে সতর্ক ছিলেন। সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে ঔষুধের পরিবর্তে স্মরণশক্তি ফিরে পাবার চেষ্টা চালিয়ে যান। ধীরে ধীরে গোমরুজ আবার হয়ে ওঠে ইমাদ। তারপর থেকেই মাদ এবং ডাক্তার তৈরি করে নতুন প্ল্যান। মুক্ত করবে এই দেশের তরুণদের। দীর্ঘদিন ধরে গোপনে সেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দু’জনে।
আজ তাদের সেই স্বপ্ন পূরণের দিন। একে একে সবাইকে নিয়ন্ত্রণের কাজ চলছে। সময় যত কমছে ইমাদ তত অস্থির হয়ে উঠছে। সুযোগ খুঁজছে এই পুরো নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার। সবাই তার কাজে নজর রাখছে। ইশারায় ডাক্তারকে ডাকলো ইমাদ।

কোন উপায় খুঁজুন বাকিদের রুম থেকে বের করার।

ওকে। তুমি সময়ের দিকে খেয়াল রাখো। আমি এখান থেকে পালাবার গোপন পথে পাহারা দিয়ে রাখছি। আজ এই দেশের জন্য আমরা আমাদের জীবন দেবো, নয়তো বিজয়ী হয়ে বেঁচে ফিরবো। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে তুমি কাজ করে যাও।
ইমাদ কাজ করে যাচ্ছে তার গোমরুজ পরিচয়ে। নিজের ভেতর ইমাদ সত্ত্বাকে প্রকাশ করেনি কখনো। আজ তার ভাগ্য নির্ধারণ হবে। কিছুক্ষণ পর নাস্তা আসলো। সবার ট্যাবিলে নাস্তা। ইমাদ মুখে দেবে এমন সময়ে ডাক্তার এলেন। ‘গোমরুজ, তুমি একটু পরে খাও। বাকিদের খাওয়ার বিরতি দিয়ে পুরোটা প্রজেক্ট তুমি একবার ভালো করে চেক করে নাও।’

ইমাদের বুঝতে দেরি হলো না। ইমাদ সবাইকে সামান্য সময়ের বিরতি দেয়। ডাক্তার চলে যায়। ইমাদ শুরু করে নেটওয়ার্ক নষ্ট করার কাজ। হাতে সময় আর দশ মিনিট। উত্তেজনা যেন আরো বাড়ছে। শীতাতপ রুমেও ঘামছে সে। ডাক্তার এর মাঝে দেশের পুলিশ ফোর্সের সাথে নিজের যোগাযোগও সচল রাখেন।
ডাক্তার তার ফোনে কিছু বাটন টিপে বলতে লাগলেন-
ডব ধৎব ফড়হব. ঋড়ৎপব ঢ়ষবধংব.

বলা শেষে লাফ দিয়ে পার হয়ে গেলেন সুড়ঙ্গের গেট। একে একে ডাক্তারের নিয়োজিত সবাইকে বের করা হলো। সবশেষে ইমাদ লাফ দেয়। পেছন থেকে ফাঁকা বুলেট লাগে ইমাদের পায়ে। গেইটের মুখে পড়ে যায় ইমাদ। ডাক্তার দৌড়ে এসে ইমাদকে ধরে। বাকিরা ইমাদকে নিয়ে যায় গেটের বাহিরে। ডাক্তার শেষ সুড়ঙ্গের গেট লাগাতে যায়। এই গেইট না লাগালে সবাই ধরা পড়বে তাদের ফোর্সের গুলিতে। ভারী এই গেইট লাগাতেই ফোর্সের বুলেট এসে ভেদ করে ডাক্তারের হাত। শব্দ করে ওঠেন তিনি। ইমাদ দেখতে পায় ডাক্তার পড়ে গেছে মাটিতে। চিৎকার দিয়ে দৌড়ে আসতে লাগলো ইমাদ। বাধা দিলো অন্যরা। এখান থেকে ফিরে যেতে হবে, নয়তো সবাই আটকা পড়বো। ডাক্তার তার শেষ দম নিয়ে আটকাতে চেয়েছিলেন গেইট। আরেকটি বুলেট লাগলো ডাক্তারের গায়ে। সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি। চিৎকার দিয়ে উঠলো ইমাদ। কিন্তু পেছনে ফেরার সাধ্য নেই। ছুটতে হচ্ছে সামনে। নিথর দেহ নিয়ে পড়ে আছেন ডাক্তার। ছুটতে পারছেন না তিনি। ছুটিয়ে দিয়েছেন একদল তরুণকে। যাদের হাতে এই দেশ।

চলে এলো পুলিশ। ডাক্তার জানিয়েছেন তাদের। সুড়ঙ্গের গেইট আটাকাতে পারেননি ডাক্তার। বেরিয়ে এলো ফোর্স। সবার পেছনে ইমাদ। আহত পা নিয়ে বেঁচে ফেরার চেষ্টা। ছুটে আসে পুলিশ। শুরু হয় বন্দুুকযুদ্ধ। ইমাদের বাহিনীকে হেফাজতে নিচ্ছে পুলিশ। একে একে সেইফ জোনে ঢুকছে। পারেনি ইমাদ। বুলেটের নিশানা হলো ইমাদের মাথা। ইমাদের রাজ্যে নেমে আসে চিরনিদ্রা। যে নিদ্রায় কখনো ভোর হয় না।

Share.

মন্তব্য করুন