আমাদের এই দেশে ইতিহাসের নানান নিদর্শন রয়েছে এটা আমরা কম বেশি সকলেই জানি। তবে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্মেও ধারণা নেই বললেই চলে। ঠিক তেমনই ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অতি প্রাচীন স্থাপনার একটি চন্দনপুরা তাজ মসজিদ। বন্দরনগরীর চকবাজার ওয়ার্ডের সিরাজউদ্দৌলা সড়কে এই মসজিদ অবস্থিত।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খানের সেনাবাহিনী আরাকান মগরাজাদের কবল থেকে চট্টগ্রামকে মুক্ত করলে এখানে মোগল শাসন কায়েম হয়। তখন শাহি ফরমান বলে বিজিত অঞ্চলে অনেকগুলো মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে সে সময়কার হামজা খানের মসজিদ, আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ, অলি খাঁ জামে মসজিদ অন্যতম। বাংলায় মোগল শাসনামলে এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শিল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও মূলত ব্রিটিশ শাসনামলে চন্দনপুরা তাজ মসজিদটি প্রথম সংস্কার করেন মাস্টার হাজী আব্দুল হামিদ।
চট্টগ্রাম নগরীর সিরাজউদ্দৌলা সড়কের পশ্চিম পাশে মোগল স্থাপনা শিল্পের আদলে ১৮৭০ সালে মাটি ও চুন সুরকির দেয়াল আর টিনের ছাদের মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন আবদুল হামিদ মাস্টার। তখনও মাটির দেয়ালে কারুকাজে ভরপুর ছিল। তার বংশধর ব্রিটিশ সরকারের ঠিকাদার আবু সৈয়দ দোভাষ ১৯৪৬ সালে এই মসজিদের সংস্কার কাজে হাত দেন। মসজিদের কারিগর ও নির্মাণসামগ্রী ভারত থেকে আনা হয়। এতে প্রায় ৫ লাখ টাকারও অধিক খরচ হয়। চারপাশের দেয়ালগুলো ভেন্টিলেশন সিস্টেমের। দেয়ালের ফাঁক গলে ঢুকছে আলো। আলোর ঝরনাধারায় ভিতরটা করছে ঝলমল। আছে বাতাসের কোমল পরশ। ব্রিটিশ আমলে শুরু হয়ে পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালের দিকে মসজিদের প্রথম সংস্কার কাজ সমাপ্ত হয়।
অনেকের কাছে এ মসজিদটি চন্দনপুরা বড় মসজিদ বা তাজ মসজিদ নামেও পরিচিত। এখন মসজিদটির বয়স ১৫৩ বছর। চট্টগ্রামের পর্যটনশিল্পের পরিচয় তুলে ধরতে মসজিদটির ছবি ব্যবহার করা হয় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রকাশনায়। এসব প্রকাশনায় এ মসজিদের ছবি থাকায় বিদেশ থেকে পর্যটকরাও আসেন এখানে। আবু সৈয়দ দোভাষ সেই সময়ে কলকাতা থেকে কারিগর ও দিল্লিসহ বিভিন্ন স্থান থেকে উপকরণ এনে ১৩ শতক জায়গার ওপর দোতলা মসজিদটি গড়ে তোলেন।
মসজিদের চারদিকে যেন রঙের মেলা। মসজিদটির প্রতিটি অংশে সবুজ, নীল, হলুদ, সাদা, গোলাপিসহ হরেক রঙ ব্যবহার করা হয়। লতা-পাতার নকশা আর নানান কারুকাজে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সুনিপুণ হাতে। অনেক দূর থেকে দেখা যায় মসজিদটির বাহ্যিক সৌন্দর্য।
মসজিদে রয়েছে ছোট-বড় ১৫টি গম্বুজ। এর মধ্যে বড় গম্বুজটি নির্মাণ করতে প্রায় ১৩ মণ রুপা ও পিতলের প্রয়োজন হয়েছিল। প্রতিটি গম্বুজে যাওয়ার জন্য আছে সিঁড়ি। গম্বুজ ও সিঁড়িতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মোগল স্থাপত্য নিদর্শনের প্রতিচ্ছবি। গম্বুজের চারপাশে রয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ সাহাবির নাম। যখন মাইকের ব্যবহার ছিল না, তখন চারতলা সমান উঁচু মিনারে উঠে আজান দেওয়া হতো। এ রকম দু’টি মিনার এখনও আছে। বর্তমানে প্রতি পাঁচ বছর পর একবার রঙ করা হয়। বৈরী আবহাওয়ায় মসজিদের অনেক জিনিস যেমন নষ্ট হয়েছে তেমনি সংস্কারের সময়ও অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। পরবর্তীতে বড় গম্বুজে সবুজ, গোলাপি ও হলুদ রঙ করে দেওয়া হয়।
বর্তমানে এই মসজিদে একজন ইমাম, একজন হাফেজ ও দু’জন মুয়াজ্জিন রয়েছেন। প্রতিদিনই নতুন নতুন মুসল্লি এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসেন এবং দেখতে আসেন। আশপাশেও অনেক নতুন মসজিদ গড়ে উঠলেও এই মসজিদে নিয়মিত মুসল্লির সংখ্যা বাড়ছে। সাধারণত দিনে গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ লোক নামাজ পড়েন এ মসজিদে। শুক্রবার জুমায় পাঁচ হাজার মুসল্লি ছাড়িয়ে যায়। তখন মসজিদে জায়গা সঙ্কুলান না হলে মসজিদসংলগ্ন রাস্তা বন্ধ করে সেখানেই নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। মসজিদটিতে রয়েছে দুর্লভ ইসলামী নিদর্শনাবলির সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। যা দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন।

যেভাবে যাবেন:

চন্দনপুরা মসজিদটি চট্টগ্রামের নবাব সিরাজউদ্দৌলা রোডে অবস্থিত। চট্টগ্রাম শহরে নেমে রিক্সা বা সিএনজি নিয়ে এই মসজিদ ঘুরে যেতে পারেন। চট্টগ্রামের জিইসি থেকে সিএনজিতে ১০০ টাকায় মসজিদের সামনে চলে যেতে পারবেন। দেশের নানান প্রান্ত থেকে প্রথমে চট্টগ্রামে আসতে হবে। চট্টগ্রাম শহরের যেকোনো স্থান থেকে সিএনজি যোগে যেতে পারবেন। এছাড়াও লোকাল গাড়িও আছে। ভাড়া দূরত্বের ওপর নির্ভর করবে।

Share.

মন্তব্য করুন