ছেলেটি ভীষণ দুষ্টু। খুবই ডানপিটে। বাবার পিটুনি খেতে হয় প্রায়ই। পাড়া-প্রতিবেশীরাও দুরন্ত স্বভাবের জন্য পছন্দ করেন না ওকে। স্কুলে ভর্তি করানো হলো। সেখানকার অভিজ্ঞতা, স্মৃতি মোটেও সুখের নয়। পরে এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘বোধ হয় ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্র ছিলাম। বাবা তো হালই ছেড়ে দিয়েছিলেন। শিক্ষক বললেন, আমার নাকি মগজ বলতে কিছুই নেই।’
ওই বয়সেই খুব রাগ হয়েছিল তাঁর। স্কুলে আর যাননি। মা শিক্ষককে বলেছিলেন, ‘ছেলেটাকে আমি বাড়িতে রেখেই মানুষ করতে চাই। দেখি, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।’ ছেলেকে একটু একটু করে গড়ে তুললেন মমতাময়ী মা। পরম যত্ন, স্নেহ, দরদ, ভালোবাসায়। সবকিছুতে মা ওকে উৎসাহ দিয়েছেন। নয় বছর বয়সে শিশুটি তার হাতে পেল দারুণ একটা বই। সেটির নাম হচ্ছে ‘স্কুল অব ন্যাচারাল ফিলোসফি’। মন দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া হলো প্রতিটি অধ্যায়। দশ বছর বয়সে মা এনে দিলেন ‘ডিকশনারি অব সায়েন্স’। ছেলেটি ঝুঁকলো রসায়নের দিকে। কিছু পয়সাকড়ি জমাতে পারলেই হলো। কিনতো অ্যাসিড এবং রকমারি রাসায়নিক জিনিসপত্র।
খেলনার দিকে কোনো খেয়াল নেই শিশুটির। তার শোবার ঘর বড্ড এলোমেলো। হয়তো ব্যাটারি বানানোর কাজ চলছে। ঘরের মেঝে ও টেবিলে গড়াগড়ি খাচ্ছে সালফিউরিক অ্যাসিড। বড়ো হয়ে ছেলেটি বলেছে, ‘মায়ের সঙ্গে আমার মতটা প্রায় একইরকম থাকতো। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চাইলেই শুধু মা যেন একটু বিরোধী হয়ে যেতেন।’ পরে অবশ্য বাবাও আস্থাশীল হয়েছেন ছেলের ওপর।
এই ছেলেটির নাম হচ্ছে টমাস আলভা এডিসন। অসাধারণ মেধাবী এক বিজ্ঞানী তিনি। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ব্যবহার করতে হয়- এমন বহু বহু জিনিস তিনি উদ্ভাবন করেছেন। বৈদ্যুতিক বাতি, গ্রামোফোন রেকর্ড, টেলিফোন, এমনকি সিনেমা- সবকিছুতেই রয়েছে তাঁর হাতের ছোঁয়া, মহতী ও মূল্যবান অবদান। আমেরিকার ওহাইয়োতে তাঁর জন্ম। ১৮৪৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। মারা গেছেন ১৯৩১ সালের ১৮ অক্টোবর। বেঁচে ছিলেন ৮৪ বছর।
কী পরিমাণ পরিশ্রম যে তিনি করতে পারতেন, তা কল্পনা করাও কঠিন। দেখা গেছে, টানা ছয় রাত না ঘুমিয়ে কাজ করেছেন। দু’হাজার তিরানব্বইটি পেটেন্ট নিয়েছিলেন। ১৮৮২ সালে এক বছরেই ১৪১টি পেটেন্টের দরখাস্ত করেছিলেন তিনি। টমাস আলভা এডিসনের নোটবই ও ডায়েরির সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার।
এডিসনের বাবার নাম স্যামুয়েল অগডেন এডিসন। তিনি ছিলেন কানাডার লোক। ১৮৩৭ সালে কানাডায় দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। টালমাটাল পরিবেশ-পরিস্থিতি। স্যামুয়েল তখন চলে গেলেন আমেরিকায়। কোথায় যাচ্ছেন, কী করবেন, কিছুই জানা নেই। স্ত্রী, চার ছেলেমেয়ে রয়ে গেল কানাডায়। স্যামুয়েল পরিশ্রমী ও উদ্যোগী লোক। দু’বছরের মধ্যেই ছোটখাটো একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে সমর্থ হলেন। তারপর কানাডা থেকে আমেরিকায় নিয়ে এলেন পরিবারের সবাইকে।
টেলিগ্রাফ আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৮৩৮ সালে। তারপর গোটা আমেরিকায় টেলিগ্রাফ নিয়ে ধুমসে কাজ হচ্ছে। বালক এডিসন বাড়িতে বসেই একটা টেলিগ্রাফ বানিয়ে ফেললেন। তখন তাঁর বয়স দশ বা এগারো বছর। সালটা ১৮৫৭ কিংবা ১৮৫৮ হবে। মমতাময়ী মা আদরের ছেলের কাজকর্মের সুবিধের জন্য ভাড়ার ঘরটা ছেড়ে দিলেন। স্নেহময় কণ্ঠে বললেন পুত্রকে, যা করতে মন চাইবে তোমার, এখানে করো। তবে অন্য ঘরগুলো যেন নোংরা না হয়।
স্বশিক্ষিত, গুণী ছেলেটির বয়স যখন বারো বছর, তখনকার ঘটনা। ইচ্ছে হলো, আয়-উপার্জন করবেন। এত কম বয়সে কোন কাজ আর মিলবে? ট্রেনে খবরের কাগজ বিক্রি শুরু করা গেল। এতে অল্প স্বল্প যা উপার্জন হচ্ছে, তা দিয়ে নানা ধরনের রাসায়নিক আর যন্ত্রপাতি কেনা চলছে। যে রেলগাড়িতে হকারের কাজ করেন, সেটির গন্তব্য ডেট্রয়েট। যাত্রা শুরু হতো সকালবেলা। পৌঁছতে সময় লাগতো ঘণ্টা তিনেক। গাড়িটা আবার ফিরে আসত রাত সাড়ে নয়টার দিকে। দিনভর অনেক অনেক সময় হাতে। কী করা যায়? সময়টুকু অর্থবহ কোনো কাজে লাগাতে পারলেই হলো। ট্রেনের একটা ফাঁকা কামরায় এডিসন একটা গবেষণাগারই বানিয়ে ফেললেন। চলন্ত গাড়িতেই ছাপা হতে থাকলো সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। সেটির নাম ‘উইকলি হেরাল্ড’।
টমাস আলভা এডিসন সম্পর্কে একটি গল্প চালু রয়েছে। সেটি হলো : ট্রেনের কামরায় একদিন ভেঙে গেল ফসফরাসের একটি শিশি। এতে আগুন ধরে যায়। ক্ষিপ্ত বিরক্ত যাত্রীরা তাঁকে মারধর করে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে যেতে বাধ্য করে। এমনই মারপিট করা হয় যে, তাঁর একটা কান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। লোকজনের মুখে মুখে গল্পটা এরকমই হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আসল ঘটনা কিন্তু অন্যরকম। এডিসন পরবর্তীকালে প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন নিজেই। লিখেছেন, ‘খবরের কাগজে আমার দুই হাত ভর্তি। ওদিকে ট্রেন ছুটতে শুরু করেছে। উঠতে পারছি না আমি। একজন গার্ড আমার কান ধরে ট্রেনে তুলে নিলেন। সেই থেকে মাথার যন্ত্রণা শুরু। কানটাও চিরদিনের মতো গেল।’
তেরো বছর বয়স হওয়ার আগেই তাঁর দুটো কান একেবারে অকার্যকর হয়ে পড়লো। আফসোস করে তিনি বলতেন, ‘বারো বছর বয়স থেকে পাখির গান আর শুনতে পাই না।’ ঠিক করলেন, কানে যখন শুনতেই পাচ্ছেন না, সুতরাং নিজেকে অন্যভাবে তৈরি করে নিতে হবে। হার মানা চলবে না। কাজ, শুধু কাজ। একমনে কাজ করে যাওয়া চাই। বই পড়তে হবে অনেক অনেক। বয়স যখন পনেরো, ডেট্রয়েট পাবলিক লাইব্রেরির সদস্যপদ নিলেন। তখন সদস্য হতে লাগতো দু’ডলার। সেই কালে এই টাকা নিতান্ত কম ছিল না। অল্প কয়েকটা বাদে লাইব্রেরির সব গ্রন্থই পাঠ করা হয়ে গিয়েছিল। একবার মহাবিজ্ঞানী নিউটনের লেখা বিখ্যাত বই ‘প্রিন্সিপিয়া’ পড়ার জন্য নিলেন। অনেক সময় লাগল পড়তে। হয়তো বোধগম্য হয়নি। বইটা ফেরত দিয়ে দিলেন। দুঃখিত হয়ে বলেছিলেন, ‘অঙ্কের প্রতি ভালোবাসাটা এই বই কেড়ে নিলো। কোনোদিন আর অঙ্ক শিখে উঠতে পারিনি।’
এবার জানা যাক এডিসনকে নিয়ে মজার একটি গল্পের কথা। তাঁর তৈরি করা প্রথম বাল্বটি কাজের লোকের হাতে দিলেন। রেখে আসতে বললেন সেটা। লোকটি সেই বাল্ব ভেঙে ফেলে। এডিসন কিছু বলেননি ওকে। আরেকটা বাল্ব তৈরি করলেন খেটে খুটে। তারপর জ্বালিয়ে দেখলেন, হ্যাঁ ঠিক আছে। সেই লোকটাকেই আবার বললেন, রেখে আসতে। বেশ ভয় পাচ্ছিল লোকটা। যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন, বললেন তারা, এ আপনি কী করছেন? ও তো আবার ভেঙে ফেলবে।
এডিসন এ কথার জবাবে বললেন, বাল্ব ভাঙলে আমি বানাতে পারব। কিন্তু আজ ওকে এই কাজটা করতে না বললে ওর আত্মবিশ্বাসটা যে আর কখনো জোড়া লাগবে না।
এডিসনের বিরুদ্ধে অভিযোগও আছে। পেটেন্টের ব্যাপারটাই ধরা যাক। তাঁর আগেও দারুণ অনেক আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু তখনো বিজ্ঞানীরা পেটেন্ট করে সব নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখতেন না। কিন্তু এডিসন ছিলেন অন্য ধাতের লোক। তিনি কিছুই ছাড়তে চাইতেন না। একবার এক পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে লেখা হলো : তিনি মহান বিজ্ঞানী। প্রবন্ধটি পড়ে বললেন তিনি :
আমি বিজ্ঞানী নই। আমি একজন উদ্ভাবক। বিজ্ঞানী হচ্ছেন মাইকেল ফ্যারাডে। অর্থের জন্য কাজ করেন না তিনি। কিন্তু আমি করি। প্রতিটি কাজকেই বিচার করি অর্থমূল্যে। যে কাজে উপযুক্ত অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, সে কাজে আমি আগ্রহ দেখাই না।
অর্থের বিনিময়ে উদ্ভাবিত যন্ত্র তিনি বিক্রি করতেন ঠিকই। যখন গবেষণার কিংবা কারখানায় কাজ করতেন, তখন কিন্তু সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন বিজ্ঞানীর মতই। তাঁর প্রচষ্টা ও গবেষণার বিষয় ছিল বহুমুখী, বিচিত্র এবং ব্যাপক। আবার যাওয়া যাক বিদ্যুৎ প্রসঙ্গে। এডিসনের আকাক্সক্ষা : এমন কোনো অবদান তিনি রেখে যেতে চান, যে কাজের জন্য পৃথিবী তাঁকে চিরদিন স্মরণ করবে। বিদ্যুতের বাতি তখন ছিল। দাম ছিল খুব বেশি। তিনি ভাবলেন, এমন কোনো বাতি কি তৈরি করা যায় না, যেটা হবে খুব অল্প দামের। জ্বলবেও অনেক বেশি দিন? কাজে নেমে পড়লেন। তাঁর সঙ্গে ৫০ জন সহকারী। বিভিন্ন রকমের ধাতু দিয়ে ১,৬০০ রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। দীর্ঘ প্রয়াস। চলতেই থাকলো। তৈরি করা সম্ভব হলো কার্বন ফিলামেন্ট। এডিসন লিখে গেছেন সেই শ্রমসাধ্য উদ্ভাবনের কাহিনী। লিখেছেন :
“ফিলামেন্ট তৈরির পর ওটাকে কাচ তৈরির কারখানায় নিয়ে যেতে হবে। ব্যাচিলরের (সহকর্মী) হাতে কার্বনের ফিলামেন্ট। পেছনে আমি। এমনভাবে দু’জনে চলেছি, মনে হচ্ছে যেন কোনো মহামূল্যবান সম্পত্তি নিয়ে যাচ্ছি। কাচের কারখানায় সবেমাত্র পা দিয়েছি, সম্ভবত অতি সতর্কতার জন্যই হাত থেকে ফিলামেন্টটি মাটিতে পড়ে দু’টুকরো হয়ে গেল।
হতাশ মনে ল্যাবরেটরিতে ফিরে গেলাম। নতুন ফিলামেন্ট তৈরি করে আবার চললাম কাচ কারখানায়। কপাল মন্দ। এবার এক স্বর্ণকারের হাতের স্ক্রু ড্রাইভার পড়ে ভেঙে টুকরো হয়ে গেল। আবার ফিরে গেলাম। রাত হবার আগেই নতুন একটা কার্বন নিয়ে এসে বাল্বের মধ্যে ঢোকালাম। বাল্বের মুখ বন্ধ করা হলো। তারপর কারেন্ট দেওয়া হলো। মুহূর্তে চোখের সামনে জ্বলে উঠলো বৈদ্যুতিক বাতি।”
প্রায় ৪০ ঘণ্টা জ্বলেছিল প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি। তারিখ ১৮৭৯ সালের ২১ অক্টোবর। সেদিন টমাস আলভা এডিসন কল্পনাও করতে পারেননি যে, তাঁর সৃষ্ট আলোই দুনিয়ার সব জায়গার অন্ধকার দূর করে দেবে। প্রথম দিকে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন বাল্বের ওপর। এর পরের কাজ গোটা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো। সে লক্ষ্যে নতুন এক ধরনের ডায়নামো তৈরি করা হলো। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার জেনারেটর, ল্যাম্প তৈরি, শেষাবধি সেটা জ্বালানোর উপায় বের করা- সবই করলেন এই সাধক। যখন নিউ ইয়র্কে প্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র গড়ে তোলা হলো- টমাস এডিসনই ছিলেন অল ইন ওয়ান। তিনিই ছিলেন একাধারে এই কেন্দ্রের সুপারিনটেনডেন্ট, ফোরম্যান, এমনকি শ্রমিকও।
আমরা জেনেছি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসে টমাস আলভা এডিসন খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন বিজ্ঞানী। তাঁর উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের সংখ্যা অনেক। যেমন: বাল্ব, গ্রামোফোন, চলচ্চিত্র, কিনেটোস্কোপ, সিনেমার ক্যামেরা, মিমিওগ্রাফ, ভিটাস্কোপ, ভিউস্কোপ, টেসিমিটার, কিনেটোগ্রাফ, কার্বন মাইক্রোফোন, ভ্যাকিউম টিউব, ফোনোগ্রাফ সিলিন্ডার, প্রবাহযোগ্য বিদ্যুৎ, টেলিগ্রাফ ইত্যাদি। তাঁর ছোটবেলার মজার একটি ঘটনা জানা যাক। যখন তিনি ছোট্টটি, পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল না। বোধ হয় সেজন্যই ইচ্ছেমতো দুষ্টুমি করার সুযোগ পেতেন। তিনি দেখলেন, ডিম পাড়ার পর মুরগি সেসব ডিমের ওপর বসে থেকে তা দেয়। তিনি ভাবলেন, মুরগি যদি এ কাজ করতে পারে, আমি কেন পারব না? যেই ভাবা সেই কাজ। ঘরের কোনায় খড়টড় দিয়ে তার ওপরে ডিম রেখে বসে পড়লেন তিনি। তারপর কী হলো? ওই যা হয় আর কী!
প্রতিভায় মোটেও বিশ্বাস করতেন না তিনি। বলতেন, পরিশ্রমই হচ্ছে প্রতিভার মূল কথা। তাঁর মৃত্যুর পর নিউ ইয়র্ক পত্রিকায় লেখা হয়, ‘মানুষের ইতিহাসে এডিসনের মাথার দাম সবচেয়ে বেশি। কারণ, এমন সৃজনীশক্তি অন্য কোনো মানুষের মধ্যে দেখা যায়নি।’

Share.

মন্তব্য করুন