হিজরি সতেরো সন। সত্য ও ন্যায়ের শাসক হযরত উমর ফারুক (রা.) মুসলিম দুনিয়ার শাসক। মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি আবু উবায়দা (রা.)-এর নেতৃত্বে তখন সৈন্যগণ সিরিয়ার বিজিত হেম্স নগরীতে অবস্থান নিয়েছে। মহাবীর খালেদসহ জগদ্বিখ্যাত সেনাপতি, সেনাধ্যক্ষবৃন্দ পরবর্তী যুদ্ধের জন্য অপেক্ষমাণ।
মদিনায় হযরত উমর ফারুক (রা.)-এর দরবারকক্ষে হঠাৎ নেমে এলো বিষাদের কালো ছায়া। কাতেব রচনা করেছেন এক গুরুত্বপূর্ণ পত্র। খলিফা দরবারের সবাইকে তা পড়ে শোনালেন। দরবারের সবাই নিস্তব্ধ। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই, ভয়ে থরথর। যেন পাথর হয়ে গেছে সবাই।
পত্রবাহক কাসেদ আস্তাবল থেকে তেজি ঘোড়াটি নিয়ে ছুটলেন। পত্রখানি ভালো করে পুরে নিলেন তাঁর বুকে। মরু সাইমুমের মতো ঝড় তুলে তীর বেগে শহর-নগর-বন্দর পেরিয়ে এলেন হেম্সে। দৃঢ়চিত্তে সোজা সেনাপতির তাঁবুর সামনে এসে কাসেদ ঘোড়া থেকে নামলেন।
কাসেদ কেন এলো? শিবিরের চারিদিকে নীরবতা নেমে এলো। কিন্তু এই নীরবতা বেশিক্ষণ টিকলো না। শুরু হলো গুঞ্জন। গুঞ্জন থেকে কথোপকথন, বলাবলি ও চরম উত্তেজনা। প্রধান সেনাপতি আবু উবায়দা (রা.) চিন্তায় মগ্ন। মহাবীর খালেদ (রা.) বিমর্ষ। সাধারণ সৈন্যরা ভয়ে আতঙ্কিত। সবাই পরবর্তী পরিস্থিতির প্রতি তীক্ষ্ন নজর রাখলেন।
কাসেদ শিবিরে সরাসরি মহাবীর খালেদের সামনে গিয়ে হাজির হলেন। খলিফার পত্রখানি খালেদের হাতে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন : জনৈক শায়েরকে আপনি যে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন, সে টাকা কোথায় পেয়েছেন? যদি বায়তুলমাল থেকে দিয়ে থাকেন তবে আমানতের খেয়ানত করে ‘বিশ্বাস’ ভঙ্গ করেছেন, আর যদি নিজের অর্জিত অর্থ থেকে দিয়ে থাকেন তবে অপব্যয় এবং নিজ বাহাদুরি জাহির করেছেন। এই দুটোই ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমাহীন অপরাধ। আপনি হয় অপরাধ স্বীকার করবেন, না হয় আপনাকে পদচ্যুত করা হবে।
ওহুদ ময়দানে মুসলিম সেনাদের বিভীষিকা, রোম সম্রাটের আতঙ্ক, ইরাক সিরিয়া বিজয়ী প্রতাপশালী সেনাপতি মহাবীর খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা.) ভয়ে থরথর, নিরুত্তর সটান পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। কাসেদ বারবার তাঁকে অপরাধ স্বীকারের জন্য অনুরোধ করলেন, কিন্তু লজ্জা ও অভিমানে খালেদ নিজ অপরাধ স্বীকার না করে মনে মনে বললেন, “এ পুরস্কার কোত্থেকে দিয়েছি তা আমি স্বয়ং খলিফাকে বুঝিয়ে বলবো। এখানে সাধারণ সৈন্যদের হাজার বোঝালেও তারা বুঝতে চাইবে না প্রকৃত ব্যাপার কী?”
নির্ভয়ে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী কাসেদ খালেদের মাথা থেকে সেনাপতির শিরস্ত্রাণ খুলে তা দিয়ে তাঁর গলা জড়িয়ে দিলেন। সাথে সাথে খালেদ সেনাপতির পদ থেকে পদচ্যুত হলেন। কোন উত্তর না দিয়ে খলিফার আদেশ মেনে নিলেন মহাবীর খালেদ (রা.)। মদিনা যাবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে যুদ্ধ করলেন শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে।
হযরত খালেদ (রা.)-এর পদচ্যুতি সারা মুসলিম জাহানে আলোড়ন সৃষ্টি করলো। নানা কথা উঠলো খলিফা সম্বন্ধে, হলো নানা গুঞ্জরণ, নানা সমালোচনা। কেউ বললো, খালেদ বেহিসেবি, কেউ বললো, খালেদ স্বেচ্ছাচারী। আবার কেউ বললো, খালেদের অনুপস্থিতিতে মুসলিম বাহিনী আর কোনো নতুন বিজয়ের মুখ দেখবে না ইত্যাদি নানা কথা।
হযরত উমর (রা.) জানেন খালেদের প্রকৃতি। আর খালেদ (রা.) জানেন হযরত উমর (রা.) কত বড় উদার, কত বড় ন্যায়বান শাসক। খালেদ কাউকে তেমন কিছু না বলে হেম্স থেকে সরাসরি খলিফা উমর (রা.)-এর দরবারে হাজির হলেন। খলিফার প্রতি লক্ষ্য করে সসম্মানে খালেদ (রা.) বললেন, আমিরুল মু’মিনিন! নিশ্চয়ই আপনি আমার প্রতি অবিচার করেছেন।
হযরত উমর (রা.) বললেন- বলো, তুমি পুরস্কারের ঐ টাকা কোত্থেকে দিয়েছো?
“যুদ্ধলব্ধ গনিমতের মাল থেকে আমি যা পেয়েছি তা থেকে”- খালেদ গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন। সাথে সাথে বললেন : আমার নিকট যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রদত্ত মোট অর্থের অতিরিক্ত বিশ হাজার টাকা আছে, তা এক্ষুনি বায়তুলমালে জমা দিলাম।
হযরত উমর (রা.) হযরত খালেদ (রা.)-কে সম্বোধন করে বললেন, “খালেদ! আল্লাহ্র কসম, তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি এবং আমি তোমায় সম্মানও করে থাকি।”
হযরত উমর (রা.)-এর কথায় হযরত খালেদের সব ব্যথা, সব অভিমান দূর হয়ে গেল।
এরপর উমর (রা.) ইসলামি খেলাফতের প্রতিটি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নিকট হযরত খালেদ (রা.)-এর পদচ্যুতির ব্যাখ্যা প্রদান করে চিঠি লিখলেন :
আমি খালেদের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে বা বিশ্বাস ভঙ্গের দরুন তাঁকে পদচ্যুত করিনি, তবে আমি দীর্ঘদিন যাবৎ লক্ষ করছি যে, ক্রমশ লোকেরা কেবল খালেদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। প্রতিটি জয়ের কারণ খালেদের অবদান বলে আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে। সৈন্যরা হয়ে পড়ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এতে হয়তো খালেদের হৃদয়ে জাগবে আত্মগৌরব। তাই আমি খালেদকে পদ থেকে সরিয়ে দিলাম, যাতে সবাই বুঝতে পারে যে, “জয়-পরাজয় সেনাপতির হাতে নয়; তা একমাত্র আল্লাহ্র হাতে।”
অবসান হলো সকল উত্তেজনার। সম্মান বাড়লো মহাবীর খালেদের। ইসলামের ন্যায়ের বিধান হলো আরো উজ্জ্বল।
উল্লেখ্য, মহাবীর খালেদ ছিলেন দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.) এর আপন ফুফাতো ভাই।

Share.

মন্তব্য করুন