মাস তিনেক পর বিশ্বকাপ। আফগানিস্তান-বাংলাদেশ সিরিজ জেতার পাশাপাশি অনেক হিসাব মেলানোর বাকি ছিল বাংলাদেশের। সিরিজ জেতা হয়নি, বাকি লক্ষ্যেরও বেশির ভাগ অপূরণের খাতায়। শেষ ম্যাচটা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি দাপট দেখিয়ে জেতা গেল। কিন্তু তাতেও তো ২-১ এ সিরিজ হারের অস্বস্তি দূর হচ্ছে না। সঙ্গে যদি যোগ হয় মাঠের বাইরের বিতর্ক তাহলে একটু বাঁকা নয়নে দেখতে পারে সবাই। ওয়ানডের প্রতিশোধ টি-২০তে নিয়েই নিলো বাংলাদেশ। দুই ম্যাচের সিরিজ জিতে নিলো ২-০। অর্থাৎ টি-২০ তে আনকোরা বাংলাদেশ পৃথিবীসেরা দলটিকেই করলো হোয়াইটওয়াশ।

তামিমের অবসর নাটক
অধিনায়কত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল প্রথম ম্যাচের পর থেকেই। প্রথম ম্যাচের হারের ধাক্কার মধ্যেই নিয়মিত অধিনায়ক তামিম ইকবালের আচমকা অবসর ও প্রধানমন্ত্রীর আদেশ-অনুরোধ কিংবা শাসনীয় বার্তায় নাটকীয় ফিরে আসা সকল মনোযোগই নাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে তামিম অবসর প্রত্যাহার করলেও বিশ্বকাপে তিনি অধিনায়ক থাকছেন কি না তার সুরাহা কিন্তু হয়নি। এই অনিশ্চয়তা চলতে থাকলে নেতৃত্ব নিয়েও ক্রিকেটারদের বিভ্রান্তি বাড়বে। যা বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্যও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।

ব্যর্থ নাঈম শেখ
তামিমের এই অবসরকা- সিরিজ জুড়ে ক্রিকেটারদের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশের শরীরী ভাষায় মাঠের বাইরের আঁচ খুঁজছেন অনেকে। তামিমের বিকল্প ওপেনার কে? নাঈম শেখকে দুই ম্যাচ খেলানোর অবস্থা তৈরি হয়েছিল। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে সর্বোচ্চ রান করা বাঁহাতি ওপেনার দুই ম্যাচ খেলে হয়েছেন ব্যর্থ। প্রথম ম্যাচে ৩৩২ রান তাড়ায় ২১ বলে করেন ৯, পরের ম্যাচে ১২৭ রানের লক্ষ্যে নেমে ৮ বলে করেন ০। দুই ম্যাচেই তার আউটের ধরন নির্বাচকদের হতাশ করেছে। প্রথম ম্যাচে শর্ট বল স্ট্যাম্পে টেনে আনেন, পরের ম্যাচে ড্রাইভ করতে গিয়ে একই পরিস্থিতির শিকার হন। নড়বড়ে-আড়ষ্টভাব দূর করতে না পারা নাঈমের ওপর খুব বেশি ভরসা রাখার কথা নয়।

আফিফ ওয়ানডেতে না পারলেও টি-২০তে সফল
ওয়ানডেতে সাতে দাবি জানাতে পারলেন না আফিফ। এই পজিশন নিয়ে হাথুরুসিংহে ও সহকারী নিক পোথাস আফিফে আস্থা রাখলেও মন ভরাতে পারেননি এই তরুণ। গত এপ্রিলে ঘরের মাঠে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের মাঝপথে দল থেকে বাদ পড়েছিলেন। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের মাঠে অ্যাওয়ে সিরিজেও জায়গা হয়নি। দুই সিরিজ বাইরে থাকার সময় প্রিমিয়ার লিগে একশ’র বেশি স্ট্রাইকরেটে সাড়ে পাঁচশো রান করেন তরুণ বাঁহাতি এই ব্যাটার। তাতে সুযোগ মিলে জাতীয় দল। এবার আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে বড় পরীক্ষা ছিল আফিফের। তবে সাত নম্বরে সুযোগ পেয়ে নিজের দাবিটা জানাতে পারেননি তিনি। দুই ম্যাচ ব্যাট করে ৪ ও ০ রান করেছেন। তবে টি-২০তে দ্বিতীয় ম্যাচে ওপেন করতে নেমে আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন ১৯ বলে ২৪ করে।

বোলিংয়ে স্বস্তি
মোস্তাফিজুর রহমান, তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদ, শরিফুল ইসলাম ও ইবাদত হোসেন। হতাশার ভিড়ে পেস বোলিংয়ে ছিল কিছুটা স্বস্তি। বিশ্বকাপ স্কোয়াডে যদি বাংলাদেশ পাঁচ পেসার রাখে তবে পাঁচজনই তৈরি। এই সিরিজে তাদের সবাইকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলানোর পরিকল্পনা ছিল। তাতে সফলই বলা যায় টিম ম্যানেজমেন্টকে। মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম দুই ম্যাচে খুব ভালো না করলেও তার জায়গা নিয়ে প্রশ্ন নেই। হাসান মাহমুদ এই সিরিজে তার চেনা ছন্দে ছিলেন না, বিশেষ করে দ্বিতীয় ম্যাচে তার পারফরম্যান্স ছিল সাদামাটা। দ্বিতীয় ম্যাচে চোট পাওয়া ইবাদত হোসেন আগামী কদিন থাকবেন বিশ্রামে, তার চোট নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তাসকিন আহমেদ চোট থেকে ফিরে ধীরে ধীরে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছেন শরিফুল ইসলাম। তৃতীয় ম্যাচে ২১ রানে ৪ উইকেট নিয়ে করেছেন ক্যারিয়ার সেরা বোলিং।

স্পিনারে কম্পিটিশন
সাকিব তো অলরাউন্ডার। তিনি দলে থাকা মানে টু ইন ওয়ান। ব্যাটসম্যান ও বোলার। এছাড়া বিকল্প বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে কে যাচেছন ভারত। তাইজুল ইসলাম নাকি নাসুম আহমেদ? তাইজুল স্কোয়াডে থেকে শেষ ম্যাচে ৯ ওভারে ৩৩ রান দিয়ে পেয়েছেন ২ উইকেট। টি-২০তে উইকেট পাওয়ায় এশিয়া কাপের আগে নাসুমও বিবেচনায় আসতে পারেন।
সাকিব কীর্তি
আফগানিস্তানের বিপক্ষে তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে ৩৬ বছর বয়সী এই বাঁহাতি তারকা অলরাউন্ডার গড়লেন দুটি কীর্তিও। ১০ ওভারে একটি মেডেনসহ মাত্র ১৩ রান খরচায় তিনি নেন ১ উইকেট। এরপর ৫ চারের সাহায্যে ৩৯ বলে ৩৯ রান আসে তার ব্যাট থেকে। হয়েছেন আফগানদের বিপক্ষে সিরিজ সেরা।
সাকিব এই ম্যাচে নেমেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৩৯৭১ রান নিয়ে। ৬৬ টেস্টে ৪৪৫৪, ২৩৫ ওয়ানডেতে ৭১৭২ ও ১১৫ টি-২০তে ২৩৪৫ রান ছিল তার নামের পাশে। অর্থাৎ ১৪ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করতে ২৯ রান দরকার ছিল তার। ১৫তম ওভারে সাকিব পূরণ করে ফেলেন তিন সংস্করণ মিলিয়ে ১৪ হাজার রান।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৬০০ উইকেট সাকিবের হয়েছিল আগেই। এবার ১৪ হাজার রানের মাইলফলকও ছোঁয়া হলো তার। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৪ হাজার রান ও ৬০০ উইকেটের ‘ডাবল’ গড়ার নজির স্থাপন করলেন সাকিব।
এই সংস্করণে উইকেট শিকারের তালিকায় বাঁহাতি স্পিনারদের মধ্যে তিনি এখন যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে আছেন। তার উইকেট ৩০৫টি। সমান সংখ্যক উইকেট রয়েছে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ড্যানিয়েল ভেট্টরির। তিনি অবশ্য খেলেছেন ২৯৫ ম্যাচ। ৪৪৫ ম্যাচে ৩২৩ উইকেট নিয়ে সবার উপরে অবস্থান করছেন শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন ওপেনার সনাথ জয়সুরিয়া।

এশিয়া ও বিশ্বকাপের রসদ পাওয়া গেছে
ওয়ানডে সিরিজে হারলেও টি-২০ সিরিজে আফগানিস্তানের বিপক্ষে জিতল বাংলাদেশ। এই জয় আগামী এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপে আফগানদের বিপক্ষে লড়াইয়ে টাইগারদের আত্মবিশ্বাস জোগাবে।
দ্বিতীয় টি-২০তে সফরকারীদের ৬ উইকেটে হারায় বাংলাদেশ। এতে দুই ম্যাচের সিরিজ স্বাগতিকরা দল জিতে নেয় ২-০ ব্যবধানেই। বৃষ্টির বাগড়ায় ম্যাচ নেমে আসে ১৭ ওভারে। মোহাম্মদ নবি-রশিদ খানরা করতে পারে ৭ উইকেটে ১১৬ রান। ডিএলএস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১১৯ রান। সেই রান তারা ৪ উইকেট হারিয়ে তাড়া করে ফেলে ৫ বল বাকি থাকতে।
সামনের এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপে আফগানিস্তানকে মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে। এশিয়া কাপে দুই দল আছে একই গ্রুপে। এরপর বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ধর্মশালায় মুখোমুখি হবে তারা। এবার টি২০তে পাওয়া সিরিজ জয় থেকে ওয়ানডের আগামী দুটি বড় আসরের জন্য আত্মবিশ্বাসের জোগান পাচ্ছে টাইগাররা।
সাউথ আফ্রিকা যুবাদের হারিয়ে যুব টাইগারদের সিরিজ জয়

রোমাঞ্চ ছড়ানো শেষ ওয়ানডে জিতে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ সিরিজ জিতলো ৩-২ ব্যবধানে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠে সিরিজ হারের পর প্রবল সমালোচনা হয়েছিল যুব দলকে নিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গেও যুবাদের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো। চার ম্যাচ শেষে সিরিজ ছিল ২-২ সমীকরণে। শেষ ম্যাচটি অলিখিত ফাইনালে রূপ নিয়েছিলো। সে সহজ ম্যাচটি বাংলাদেশ কঠিন করে জিতে সিরিজ নিশ্চিত করে।
রাজশাহীর শহীদ কামরুজ্জামান স্টেডিয়ামে দক্ষিণ আফ্রিকা আগে ব্যাটিং করে ২১০ রানে গুটিয়ে যায়। জবাবে বাংলাদেশ ১৭ বল হাতে রেখে ৩ উইকেটে জয় পায়। জয়ের ব্যবধান আরও বড় হতে পারত যদি ব্যাটিংয়ে বিপর্যয়ে না পড়ত।
লক্ষ্য তাড়ায় উদ্বোধনী জুটিতে আদিল বিন সিদ্দিক ও রিজওয়ান ৪০ রানের জুটি গড়েন। রিজওয়ানের (১৩) বিদায়ে ভাঙে উদ্বোধনী জুটি। তিনে নামা রিজান হাসান (৩) দ্রুত ড্রেসিংরুমের পথ ধরেন। তৃতীয় উইকেটে দলের হাল ধরেন আদীল ও আরিফুল ইসলাম। দু’জন ৮৭ রানের জুটি গড়ে জয়ের পথ মসৃণ করে দেন। এ সময়ে আদীল তুলে নেন ফিফটি। আরিফুল সেই পথেই এগিয়ে যান।
জয়ের জন্য ১৫৪ বলে ৭৬ রান লাগত স্বাগতিকদের। হাতে ৮ উইকেট। ঠিক ওই সময়ে অতিথি দলের পেসার জেমস ভাঙেন আরিফুল ও আদীলের জুটি। তাতে বাংলাদেশ হোঁচট খায়। আদীল ৭০ বলে ৭ চার ও ১ ছক্কায় ৫৮ রান করে ফেরেন ড্রেসিংরুমে। এরপর নাঈম আহমেদ (১১), শিহাব জেমস (১৭) ও আশরাফুজ্জামান (৩) দ্রুত আউট হন।
উইকেট আগলে টিকে ছিলেন আরিফুল ইসলাম। ফিফটি তুলে নিয়ে ডানহাতি ব্যাটসম্যান জয়ের পথে এগিয়ে যান। মনে হচ্ছিল অধিনায়ক রাব্বীকে নিয়ে আরিফুল জয় নিশ্চিত করে মাঠ ছাড়বেন। কিন্তু রোমাঞ্চ ছড়ায় আরিফুলের বিদায়ে। ৭৬ বলে ৬৮ রান করে আরিফুল আউট হন। ম্যাচসেরা নির্বাচিত হওয়া এ ব্যাটসম্যান ৫ চার ও ১ ছক্কায় সাজান ইনিংসটি। শেষ দিকে দলকে বিপদে পড়তে না দিয়ে জয়ের কাজ সারেন রাব্বী ও রাফি। রাব্বী ১৫ ও রাফি ৭ রানে অপরাজিত থাকেন। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে বল হাতে ২৩ রানে ৪ উইকেট নেন লিয়াম আলডার ও জেমসের পকেটে যায় ৩ উইকেট।
এর আগে বাংলাদেশের বোলিংও ছিল দারুণ। ২টি করে উইকেট নেন বর্ষণ, রিজান ও রাফি। তবে সেরা ছিলেন রাব্বী। ৪৩ রানে ৩ উইকেট নেন বাংলাদেশের অধিনায়ক। স্বাগতিকদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং তেমন ভালো হয়নি। কেবল রান করেছেন ডেভিড টিগার। ৮৯ বলে ৬৩ রান করেন এই ব্যাটসম্যান। এছাড়া অধিনায়ক জেমস ৩২ ও রিচার্ড সেলেটওয়ানের ব্যাট থেকে আসে ২৭ রান। ম্যাচসেরা নির্বাচিত হন আরিফুল। ৬৮ রানের সঙ্গে ১ উইকেটও পান তিনি। এছাড়া সিরিজ সেরা হয়েছেন রাফিউজ্জামান রাফি। ১৪ উইকেটের সঙ্গে ৬৭ রান করেছেন তিনি।

Share.

মন্তব্য করুন