আমাদের বর্ষা দারুণ এক ঋতু! কখনো মেঘ-রোদ- বৃষ্টি, কখনো আবিরাম রিনিঝিনি শব্দ, কখনো রঙধনু ও ঝিরিঝিরি বাতাস। এসব কার না ভাল্লাগে! একইসাথে মন মাতানো ফুলের সৌরভ যদি থাকে, তাহলে তো কথা নেই। মুগ্ধতায় ভরে ওঠে মন। এমন মজার দিনে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সুগন্ধি সব ফুল। কদম, কেয়া, কামিনী, বেলি ও বকুলের সুবাসে এখন মুখরিত চারপাশ।
এ সময়ে ফোটা ফুলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কদম, বকুল, স্পাইডার লিলি, দোলনচাঁপা, সুখদর্শন, ঘাসফুল, শাপলা, সন্ধ্যামালতি, কামিনী, গুলনার্গিস, দোপাটি ও অলকানন্দ প্রভৃতি।
বর্ষা মানেই কদম ফুল, বর্ষার অতিথি। গ্রামে গাছে গাছে ফুটে থাকা কদম ফুল এনে দেয় নজরকাড়া সৌন্দর্য। কদম ফুলের আদি নিবাস ভারত, চীন ও মালয়। গ্রামাঞ্চলে নদীর তীরে, খোলা প্রান্তরে কদম গাছ চোখে পড়ে। শহরে দেখা মেলে পার্কে ও উদ্যানে। কদম গাছের ছোট ডালের আগায় গোল হয়ে কলি ও ফুল ফোটে।
তারপর রজনীগন্ধা, মালতিলতা, চালতা, জুঁই ও কেয়া ফুটতে শুরু করে। বর্ষার বৃষ্টিতে চিরসবুজ চালতা গাছের রূপও দারুণ। ফুটে ওঠে তার ফুলের সৌন্দর্যে। আকারে বেশ বড়, সাদা বর্ণের পাপড়ি ও হলদে পরাগকেশরের সমাহারে সমৃদ্ধ। ভরা বাদল দিনে স্বর্ণচাঁপা কিংবা দোলনচাঁপা বাতাসে ছড়ায় অনুপম সৌরভ। ভেজা বাতাসে ভেসে বেড়ায় বেলি ও বকুলের সৌরভ। বকুল ফুল শুকিয়ে গেলেও সুবাস রয়ে যায় অনেক দিন। তাই একে সুবাসিত ফুল বলা চলে। পাঁচ বৃন্তের এ ফুলে অসংখ্য পাপড়ি থাকে।
বর্ষার ফুলের মধ্যে জুঁই ও মালতির কথা আলাদা করে বলতেই হয়। ঘন সবুজ পাতার ভিড়ে থোকা থোকা ছোট জুঁই বা যূথী ফুলের সৌরভ পাগল করে। বাদল বাতাস ভাসে মালতির ঘ্রাণ।
বর্ষাদিনের আরেকটি ফুল ফুরুস। ইংরেজি নাম ক্র‌্যাব ফ্লাওয়ার। গন্ধহীন সাদা, গোলাপি বা বেগুনি রঙের ফুলটি শহরের নানা জায়গায় চোখে পড়ে। অনেকেই একে চেরি বলে ভুল করে। বর্ষা মৌসুমের ফুল দুপুরমণি বা বান্ধুলি। দুপুরবেলা ফোটে বলেই এমন নাম। গন্ধ নেই তবে অতুলনীয় রূপ মুগ্ধ হওয়ার মতোই।
বর্ষার আকর্ষণীয় আরেকটি ফুল দোপাটি। গোলাপি, লাল, বেগুনি, আকাশি, নীল ও সাদাসহ কয়েক রঙের দোপাটি রয়েছে। দোপাটি একক অথবা জোড়ায় জোড়ায় ফুটতে দেখা যায়। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয় বেগুনি রঙা কলমি ফুলও।
বৃষ্টিতে গা ধুয়ে সবুজ পাতার শাড়ি পরে দোলনচাঁপা। সন্ধ্যার সুগন্ধি সাদা ফুল ফোটায়। বড় বড় পাপড়ি দুটি প্রজাপতির ডানার মতো দেখায়। তাই এর ইংরেজি নাম ‘বাটারফ্লাই লিলি’। ফুলটিকে গুলবাকাওলিও বলা হয়। ঘ্রাণ ছড়ানো এ গাছটি টবে লাগালে ঘরময় সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
সুখদর্শন বা টাইগার লিলি, বহুরঙা গ্লোরি লিলি, নানা রঙের পর্তুলিকা, ঘাসফুল, নয়নতারা, মোরগঝুঁটি, কলাবতী ও অলকানন্দারও দেখা মেলে বর্ষাতে।
বর্ষা মানে পানি বা জল। হাওর নদী বিল দীঘি সবই জল থৈ থৈ করে। জল মানেই জলজ ফুলের মেলা। ফুটতে শুরু করেছে শাপলা-শালুক-পদ্মরা। বিল-পুকুর ও জলাশয়ে ফুটে আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা। শাপলার ফুটে থাকার দৃশ্যে গ্রাম-বাংলার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে।
আমাদের দেশে সাদা, গাঢ় লাল, নীল ও গোলাপি রঙের শাপলা বেশি দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন বিলে এখন গোলাপি-পদ্মের মাতামাতি। গোলাপি রঙের পদ্মই বেশি। এছাড়া এ দেশের পুকুর ও বিল-ঝিলে সাদা রঙের পদ্মও মাঝে মধ্যে দেখা যায়। সাদা দুধের মতো এর পাপড়ির রং।
দিন দিন পদ্মরা কমে যাচ্ছে। বর্ষার দিনে বিস্তীর্ণ জলের শান্ত চাতালজুড়ে এখন সাদা রঙের অস্ত্র চাঁদমালা ফুল দেখা যায়। ফুলগুলো খুব সাধারণ হলেও এর মুগ্ধতা অনেক অসাধারণ।
মানুষ গড় আয়ু কিছুটা কমছে। কমছে গাছেরও। কারণে-অকারণে কাটা পড়ছে গাছ। লাভের হিসাব মেলাতে অনেকেই কদম, চালতা গাছ লাগাতে অনীহা প্রকাশ করে। অথচ কদম, চালতা ছাড়া বর্ষা বেমানান। জনমনে বোধোদয় আসুক। দিন দিন বিস্তৃত হোক বর্ষার ফুলের হাসি।

Share.

মন্তব্য করুন