পৃথিবীতে প্রাণিকুলের কল্যাণে মহান আল্লাহর দান হাজারো উদ্ভিদ প্রজাতি। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে এসকল উদ্ভিদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এদের ভিতরে অনেক উদ্ভিদ আছে যাদের ঔষধি গুণ থাকা সত্ত্বেও প্রাণীর জন্য তা ভীষণ ক্ষতিকর এমনকি জীবননাশকও হতে পারে। এ ধরনের বিষাক্ত উদ্ভিদের মধ্যে ধুতুরা অন্যতম। যার বিষময়তার কথা কারো অজানা নয়। অপূর্ব দেখতে ধুতুরা ফুলের প্রতি যে কেউ আকৃষ্ট হবে নিশ্চিত, তবে এর বিষাক্ত চেহারাটা সামনে পড়লে মুহূর্তেই সে মোহময় রূপের তন্দ্রা কেটে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বন বাদাড়ে ক্ষেতের আইল বা পথের ধারে অযত্নে অবহেলায় যত্র তত্র বেড়ে ওঠে এরা। রাঙ্গামাটিসহ পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন পাহাড়ে এদের দেখা মেলে।
এই উদ্ভিদের আঞ্চলিক নাম ধুতুরা। তবে আরো অনেক নামে ডাকা হয় একে। যেমন- ঘণ্টাপুষ্প, কণ্ঠফল, DevilÕs Trumpet বা Downy Thorn, Thorn Apple ইত্যাদি। কেউ কেউ একে নললতা বলেও ডাকে। উদ্ভিদটির ভেষজ নাম Datura metel Linn. ধুতুরা বর্ষজীবী বা বহু বর্ষজীবী উদ্ভিদ যা Magnoliophyta পর্বের Magnoliopsida শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এটি Solanales বর্গ Soanaceae পরিবারের এবং Datura গণের একটি উদ্ভিদ যার প্রজাতি হলো, Datura metel.
এটি নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের একটি গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ এবং এরা উচ্চতায় প্রায় দুই থেকে ছয় ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এরা ৪-৫ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। এর কাণ্ড কোমল, গোলাকা‌র, মসৃণ ও সরল। পাতা কাঁটাযুক্ত ডিম্বাকার ও জালিকা শিরাযুক্ত এবং পাতার বিন্যাস একান্তর। পাতা চওড়া প্রায় ৪ ইঞ্চি এবং লম্বা প্রায় ৭ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। ধুতুরা চাষের সঠিক সময় বর্ষাকাল। সারা হেমন্ত জুড়ে গাছে ফুল ফোটে এবং শোভা বর্ধন করে। সাধারণত পড়ন্ত বিকেলে অলস রোদে ফুল ফুটে ধুতুরার গাছকে করে সৌন্দর্যমণ্ডিত। এ গাছের ফুল একক ভাবে ফোটে অর্থাৎ স্বপরাগায়িত। ফুলগুলো আকারে বড় ও হালকা সাদা। দেখতে মাইক আকৃতির। ফুল ৩ থেকে ৬ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ধুতুরার ফুল পরিপূর্ণ। এদের পাঁচটি সংযুক্ত পাপড়ি হয়ে ফানেলের আকার তৈরি করে। তখন দেখতে মাইকের মতো মনে হয়। ফুলের পুং কেশর পাপড়ির সাথে যুক্ত থাকে। পরাগ ধানীগুলো লম্বা প্রকৃতির হয়। এর দুটি গর্ভপত্র থাকে। অমরা মাতৃ অক্ষের সাথে তির্যকভাবে সংযুক্ত থাকে। শুধু ফুল নয়, এর ফলও বেশ আকর্ষণীয়। ফিকে সবুজ রঙের গোলাকার কাঁটাযুক্ত ফলটি পাতার গোড়া থেকে জন্ম হয়। অর্থাৎ ফল পাতা গাছ সবই সবুজ বর্ণধারী। শুকনা ফল চার ভাগে ফেটে যায়। যার মধ্য গুচ্ছাকারে সাদা বীজগুলো সাজানো থাকে এবং বীজগুলো লঙ্কা বীজের মতো। উদ্ভিদটির বংশ বিস্তার বীজ থেকে ঘটে। বীজ সংগ্রহের সময় জুলাই মাসের শেষের দিকে। কনকধুতুরা নামের এক প্রকার ধুতুরা আছে যার পাতার শিরা, বোঁটা গাছের ও ফুলের রঙ গাঢ় বেগুনি হয়ে থাকে। তবে প্রজাতিতে এরা একই। কুচবিহার অঞ্চলে বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে আর এক ধরনের ধুতুরা জন্মে। এর পাতা দেখতে অনেকটা বাসক পাতার মতো। ফুলগুলো কিছুটা লম্বা। কুচবিহার অঞ্চলে এর নাম গজঘণ্টা ধুতুরা।
ধুতুরার সমস্ত অংশই বিষাক্ত। এতে Tropane Alkaloids নামক বিপজ্জনক মাত্রার বিষ রয়েছে। যা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মস্তিষ্ক বিকৃতি এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে সে কারণেই বোধ হয় অনেক দেশে ধুতুরা উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ। তবে বিষাক্ত হলেও কিন্তু এর রয়েছে দারুণ ঔষধী গুণ। এ উদ্ভিদের মূল, কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফলসহ সমস্ত অংশই অনেক কার্যকর। তাই ভেষজ চিকিৎসায় এর ব্যবহার প্রচুর। চীনে ভেষজ চিকিৎসাশাস্ত্রে বর্ণিত ৫০টি উদ্ভিদের মধ্যে ধুতুরার নাম রয়েছে। জানা যায় কুকুরের কামড়ের বিষ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই গাছের মূলের রস উপকারী। শ্বাসকষ্ট কমানোর জন্য পাতা ফুল ফল ব্যবহার করা হয়। পাতার রস ব্যবহার করা হয় ব্যথার উপশম হিসেবে। জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, চুলকানি, পাঁচড়া, ব্রণ, কফ, কৃমিনাশক, চুল পড়া রোধ, চামড়ার মসৃণতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ঔষধ হিসেবে এই উদ্ভিদের ব্যবহার হয়ে থাকে। ধুতুরার বীজ চেতনানাশক হিসেবে কাজ করে। এর শিকড়ের ট্যানিন সাপের বিষের জন্যও প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনেক নার্সারিতে কীটনাশক হিসেবেও এ উদ্ভিদ রোপণ করা হয়ে থাকে যাতে পোকামাকড় এর রস পান করে মৃত্যুবরণ করে। জন্ডিস, কুষ্ঠরোগ, বোলতা বা ভিমরুলের কামড়ের বিষ, এমনকি মাথার টাক দূর করতেও ধুতুরার ব্যবহারের প্রচলন আছে ভেষজশাস্ত্রে। তবে জীবননাশক ডোজ আর অ্যান্টি ডিজেজ ডোজ খুবই কাছাকাছি। তাই না জেনে এটি ব্যবহারে জীবনের হুমকি থাকতে পারে। সে কারণে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এর কোনো অংশই সেবন বা ব্যবহার করা উচিত নয়। বিষাক্ত হলেও ধুতুরা প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদের সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও যথাযথ ব্যবহার আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান দিতে পারে। অবজ্ঞায় বেড়ে ওঠা আগাছাটি হয়ে উঠতে পারে ঔষধ জগতের অনন্য কাঁচামাল।

Share.

মন্তব্য করুন