আজকের ছেলেপুলেদের দিকে তাকালেই আমাদের ছোটকালটা সামনে ভেসে ওঠে আয়নার মতো। এখনও মনে হয় ফেলে আসা সেই সময়টাকে খুব পরিষ্কারভাবে দেখতে পাই। আমাদের সময়টাতেও দুষ্টুমি ছিলো এতে কোনো সন্দেহ বা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। কতরকম দুষ্টুমিতে মেতে উঠতাম আমরা সে কথা বলতে হলে কিন্তু আরেকটি বড় লেখা হয়ে যাবে। আজ দুষ্টুমির গল্প বলবো না। বলবো আমরা কেমন করে ছোটবেলা থেকে জীবনের জন্য ভালো ভালো গুণগুলো শিখেছি এবং শিখে সেগুলো নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে পথ চলেছি এবং এখনও চলছি।
আমার খুব মনে আছে আমার বাবা আমাকে প্রথম শিখিয়েছেন- তুমি যখন বড়দের দেখবে আদবের সাথে সুন্দর করে আগেই সালাম দেবে। সালাম মানে- আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। এই বাক্যটি যতটা মধুর করে বলা যায় উচ্চারণ করা যায়- করবে। বাবা কয়েকবার নিজের মুখে আবেগ দিয়ে উচ্চারণ করে দেখিয়ে দিলেন। নিজে দেখিয়ে এরপর আমার মুখেও কয়েকবার উচ্চারণ করে শুনলেন। আমিও খুব আবেগ মিশিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। সেদিন বাবার মুখে আরবি উচ্চারণের সৌন্দর্য শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম। ঠিক বাবার মতো করে আমিও বারবার বলেছি। শুনে শুনে বাবা আমাকে সংশোধনও করে দিলেন। এরকম একটি সুন্দর মনোরম এবং মধুর বাক্য শিখতে পেরে আমার সেকি আনন্দ হলো সেদিন আজও তা প্রকাশ করা কঠিন। সালামের বাক্যটি যখন শুদ্ধ করে সুন্দর করে বলতে শিখলাম মনের মধ্যে খালি একটি বিশেষ বিষয় জাগতো। সেটা হলো কখন কারো সাথে দেখা হবে আর আমি সালাম দিতে পারবো! এরকম একটা মনোভাবের মুহূর্তে যার সাথেই দেখা হতো অনেক দূর থেকে আগেভাগে হাত তুলে সালাম দিয়ে দিতাম। গ্রামের মুরুব্বিরা আমার ওপর ধীরে ধীরে খুব খুশি হতে থেকে। এমনকি আমার বড় যারা তাদেরও খুব সম্মানের সাথে সালাম দিয়ে একটি মুচকি হাসি দিতাম। এতে কী যে আশ্চর্য আকর্ষণ ছিলো আহাহা! সবাই আমাকে কাছে টেনে নিয়ে খুব আদর করতো। বড়দের সালাম দিতে দিতে অভ্যাসটি এমন হলো যে আমার সমান যারা তাদেরকেও সালাম দিতাম একইভাবে। আরও কিছুদিন পরে আমার ছোটদেরকেও দেখলেই আগে সালাম দিয়ে দিতাম। এতে মুরুব্বিরা, আমার বড় যারা, আমার সমবয়সী এবং ছোট যারা সবাই আমাকে আদর ভালোবাসা আর সম্মানের জায়গায় রাখলো। চতুর্দিকে আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়লো যে আমি নাকি অনেক ভদ্র ছেলে। যখন বাবার সাথে মুরুব্বিদের দেখা হয়ে যেতো অমনি বলতেন- আরে আপনার ছেলেটা তো সোনার ছেলে। খুব খুব ভালো ছেলে আপনার। আদব লেহাজে এক নম্বর। আমাদেরকে দেখলেই অনেক দূর থেকে হাত তুলে সালাম দিয়ে দেয়। আর কী নরম করে সালাম বলে! আমরা খুব খুশি আপনার ছেলের ওপর! এমন ছেলে আমাদের মহল্লায় আর তো দেখি না। যা দিনকাল পড়েছে- ছেলেরা মুরুব্বিদের দেখলে চোখ ঘুরিয়ে হনহন করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কলিকালের ছেলেরা বড় বেয়াদব। আরে ময়-মুরুব্বি দেখলে সালাম কালাম দিতে হয় একথাটা বাপ মায়েরা শিখাবে না! কিন্তু শেখায় না তারা। হয় তো শেখায় কিন্তু মুখে সালাম ফোটে না তাদের। এদেরকে বেয়াদব ছাড়া আর কি কিছু বলা যায় বলুন! কাউকে যদি সালাম দেয়ার কথা বলি তো তারা মুখ বাঁকিয়ে এমন একটা ভাব করে মনে হয় সালাম দেয়া একটা অকাজ! কিছুটা চোখ টাটিয়ে হনহন করে চলে যায়। তখন মন চায় কষিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে শিক্ষাটা দিয়ে দেই। কিন্তু পরের ছেলের গায়ে হাত তোলাও বিপজ্জনক! যদি তাদের বাপ মা এসে বলে- আমার ছেলের গায়ে হাত তোলার অধিকার কে দিলো আপনাকে! তখন কোনো জবাব থাকবে না আমার কাছে। তাই দেখে দেখে চুপচাপ করে নিজের পথ ধরি। অথবা ধৈর্য ধরার কঠিন কাজটা করি। আর ভাবতে থাকি- এই ছেলেপুলেগুলো মানুষ হবে কি কোনোদিন।
অবশ্য এখনকার ছেলেমেয়েরা তো আরও একধাপ নয় কয়েক ধাপ এগিয়ে চলছে। আমাদের কিশোরবেলায় দেখতাম ছেলেমেয়েরা মুরুব্বিদের সালাম না দিলেও অন্তত সম্মানের চোখে দেখার চেষ্টা করতো। মুরুব্বিদের পথ ছেড়ে দিয়ে তারপর নিজেরা পথ চলতো। এখন? হায় হায়! কি মুরুব্বি! কি বুড়ো অথবা বুড়া থুত্থুড়ে কাউকেই কোনোরকম পাত্তা দেয়ার বা পরোয়া করার কথা ভাবে না। প্রয়োজনে এসব মুরুব্বিদের ঠেলে ঠুলে এমনকি ধাক্কা দিয়ে যেতেও এদের সামান্যতম বিবেক কাঁপে না। আমাদের ছেলেবেলায় মুরুব্বিরা বলতেন- কলিকাল। এখন তবে কি কাল! এখন তো তারা থাকলে বলতেন- মহা কলিকাল! সত্যি তো মহা কলিকাল! নইলে ছোটরা কেমন করে বড়দের একটুও সম্মান ইজ্জত করে না। বড়রাও মুরুব্বিদের প্রতি সম্মানের চোখে দেখে না মোটেও। তাহলে আমরা কি আমাদের মুসলমানদের যে নিয়মনীতি আর সৌন্দর্য সব হারাতে বসেছি!
তবে এ কথা সত্যি যে যেমন খারাপ স্বভাবের মানুষ আছে আমাদের সমাজে। ঠিক তেমনই অনেক অনেক ভালো স্বভাবের মানুষ। সংখ্যায় হয় তো ভালো মানুষ কম। কিন্তু আজও আছে ভালো মানুষেরা। আজও আছে আদব কায়দা রক্ষা করার মতো ছেলেমেয়েরা। এরা সুন্দর চরিত্র গঠন করার কাজ করছে নিয়মিত। সকল লোভ লালসা আর অসুন্দর থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে সত্য ও সুন্দরের পথে চলার দৃঢ শপথের মাধ্যমে এগিয়ে চলছে।
আমাদের ছেলেবেলায়ও সব খারাপের ভেতর দিয়ে কিছু ভালো ছেলেপুলে সত্যের সৌরভ বুকে নিয়ে পথ চলতো। আমাকেও মুরুব্বিরা সেই কাতারের একজন বলে মনে করতো। তাই যারা ভালো ছেলেমেয়ে নয় তাদের তুলনায় আমার প্রশংসা ছিলো খুব খুব বেশি। খারাপদের কথা বলতে বলতে আমার বাবাকে মুরুব্বিরা বলতেন-
কিন্তু আপনার ছেলেটা মাশাআল্লাহ সোনার টুকরা ছেলে। যেমন আদব লেহাজ তেমনই ভদ্র নম্র ছেলে। ওর জন্য অনেক অনেক দোয়া করি- আল্লাহ ওকে অনেক বড় করুক। অনেক বড় হোক আপনার ছেলেটা। আমাদের সমাজ-নামাজ ও মুখ উজ্জ্বল করুক ও।
এদের এতো কথার জবাবে আমার বাবা কোনো কথা বলতেন না। শুধু চুপচাপ শুনে যেতেন আর মুচকি মুচকি হাসতেন। আমার এতো প্রশংসা শুনে বাবার মুখটা চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠতো! শেষে বলতেন- দোয়া করবেন আমার ছেলেটার জন্য। ও যেনো মানুষের মতো মানুষ হতে পারে। জবাবে মুরুব্বিরা বলতেন- দোয়া দোয়া। অনেক দোয়া করি আপনার ছেলের জন্য। এমন সোনার টুকরা ছেলের জন্য দোয়া নয় তো কি!
আসলে সত্যি হলো- মানুষ যদি ভালো ভালো গুণাবলি অর্জন করে তখন অন্য মানুষ না চাইতে তার জন্য দোয়া করে মন থেকে। ভালো গুণই মানুষকে উন্নত মানুষ করে তোলে।

Share.

মন্তব্য করুন